বিশেষ প্রতিবেদক : রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী সংগঠন আরাকান আর্মি (এএ) কর্তৃক সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজরে এসেছে। মায়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী আর্মি রোহিঙ্গাদের জাতিগত পরিচয় অস্বীকার করে তাদেরকে ‘বাঙালি মুসলিম সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করে দমন শুরু করে। মার্চ ২০২৪ থেকে নভেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত রাখাইন রাজ্যের মংডু, বুথিডং ও রাথিডং টাউনশিপে রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংস হামলা চালানো হয়। এই প্রতিবেদনে আরাকান আর্মির সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হলো।
আরাকান আর্মির অপরাধসমূহের তালিকা : নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড (Mass Murder): আনুমানিক ৬,০০০ রোহিঙ্গা নিহত। অপহরণ (গুম): কমপক্ষে ১১৮ জন রোহিঙ্গা অপহৃত। নির্বিচারে আটক: রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর নির্বিচারে আটক ও নির্যাতন। ধর্ষণ: রোহিঙ্গা নারীদের ওপর যৌন সহিংসতা। চলাচলে বাধা প্রদান: রোহিঙ্গাদের স্বাধীন চলাচলে বাধা সৃষ্টি।জোরপূর্বক বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ: আনুমানিক ২ লাখ রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত। বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ: কমপক্ষে ১১টি গ্রামে অগ্নিসংযোগ। চাঁদাবাজি ও লুণ্ঠন: রোহিঙ্গাদের থেকে জোরপূর্বক অর্থ আদায় ও সম্পদ লুট। জোরপূর্বক স্বেচ্ছাশ্রম: রোহিঙ্গাদের বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োজিত করা। মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার: সংঘর্ষের সময় রোহিঙ্গাদের মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার। জোরপূর্বক আরাকান আর্মিতে যোগদানে বাধ্য করা: কিশোর ও যুবকদের সন্ত্রাসী সংগঠনে যোগদানে বাধ্য করা।
নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড ও আহতদের বিবরণ : নগত মার্চ ২০২৪ থেকে নভেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত সময়ে আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংস হামলা চালিয়েছে। উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো হলো: ৬ এপ্রিল ২০২৪: থি হো কিউন গ্রামে আর্টিলারি বোমা হামলায় ৬ জন রোহিঙ্গা নিহত ও ৭ জন আহত হন। ২ জুন ২০২৪: বুথিডং টাউনশিপে ১ জন রোহিঙ্গাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ৬ জুন ২০২৪: মংডু টাউনশিপের হোরি তুল্লাহ গ্রামে ড্রোন হামলায় ১টি মসজিদ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ৩ জন রোহিঙ্গা আহত হন। ৮ জুন ২০২৪: নাছিডং রোহিঙ্গা পাড়া থেকে ১৭ জন রোহিঙ্গাকে অপহরণ করে হত্যা করা হয়। ১৯ জুন ২০২৪: মংডু টাউনশিপে ড্রোন হামলায় ২ জন রোহিঙ্গা নিহত ও কয়েকজন আহত হন; একই পরিবারের ৪ জন আহত হন। ২৫ জুন ২০২৪: মংডু শহরে মর্টার শেলের আঘাতে ২ জন রোহিঙ্গা নিহত ও ১১ জন গুরুতর আহত হন। ৩০ জুলাই ২০২৪: ড্রোন হামলায় ২ জন রোহিঙ্গা নিহত ও ৪ জন আহত হন। গত ৪ আগস্ট ২০২৪: আয়থা লিয়া গ্রামের লাথা পাড়ায় ড্রোন হামলায় ২ শিশু নিহত ও ৪ জন আহত হন। গত ৫ আগস্ট ২০২৪: নাফ নদীর তীরে অপেক্ষমাণ আনুমানিক ২০০ রোহিঙ্গাকে গুলিবর্ষণ করে হত্যা করা হয়। ২০ আগস্ট ২০২৪: ড্রোন হামলায় ৫ রোহিঙ্গা শিশু নিহত হয়। ১০ অক্টোবর ২০২৪: কাই পিউ দাউং গ্রামে ৩০০ জন রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়; তাদের মধ্যে ৩০ জনকে হত্যা করা হয়। ৩ নভেম্বর ২০২৪: থা ইয়েত ওকে গ্রাম থেকে বাংলাদেশে আসার পথে ড্রোন হামলায় ১৭ জন রোহিঙ্গা নিহত হন।
অপহরণ ও গুমের ঘটনা : আরাকান আর্মি ধারাবাহিকভাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যদের অপহরণ করে অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছে। ১৭ এপ্রিল ২০২৪: থা ইয়েত ওক গ্রামে ৫ জন রোহিঙ্গাকে অপহরণ; পরে তাদের মৃতদেহ পাওয়া যায়। ২৩ এপ্রিল ২০২৪: নূর মোহাম্মদ নামে একজন রোহিঙ্গাকে অপহরণ করা হয়। ৩০ মে ২০২৪: কিয়াওক হ্লাই খার গ্রাম থেকে ৩ জন ব্যবসায়ীকে অপহরণ করা হয়। ২৪ জুন ২০২৪: মাইও উ গ্রাম থেকে ১৪ জন রোহিঙ্গাকে অপহরণ করা হয়; তাদের মধ্যে ৮ জন মসজিদে নামাজরত ছিলেন। জুন ২০২৪: বুথিডং এর বিভিন্ন গ্রাম থেকে মোট ২৩০ জন রোহিঙ্গাকে অপহরণ করা হয়।
ধর্ষণ ও নির্যাতন : সন্ত্রাসী সংগঠন আরাকান আর্মি রোহিঙ্গা নারীদের ওপর যৌন সহিংসতা এবং সাধারণ জনগণকে নির্যাতন করেছে। ৩১ মে ২০২৪: আশ্রয়হীন রোহিঙ্গাদের তাঁবুতে হামলা, লুটপাট, নারীদের লাঞ্ছিত করা এবং ১৭ জনকে ধরে নিয়ে নির্যাতন। ১৮ মে ২০২৪: বুথিডং টাউনশিপে রোহিঙ্গা গ্রামসমূহে লুট, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ও খুন। ২৪ জুন ২০২৪: মংডু জেলা শহরে সংঘর্ষের পর শত শত রোহিঙ্গা খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হন।
বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ : আরাকান আর্মি পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে অগ্নিসংযোগ করেছে, ১৭ মে ২০২৪: বুথিডং শহরের ৩৫টি গ্রাম আগুনে পুড়িয়ে ১,৭০,০০০ রোহিঙ্গাকে বাস্তুচ্যুত করা হয়। ১৫ আগস্ট ২০২৪: মাগি চং, পা দিন, পান তাউ পিয়িন গ্রামে অগ্নিসংযোগ করা হয়। ২৪ আগস্ট ২০২৪: মুন্নি পাড়া নামক গ্রামে অগ্নিসংযোগ করা হয়।২৯ সেপ্টেম্বর, ৯ অক্টোবর ও ১৯ নভেম্বর ২০২৪: আলেল থান ক্যাও এলাকায় পরিত্যক্ত ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়।
জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত ও উচ্ছেদ : রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমি থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করা হয়েছে, গত ১৮ জুন ২০২৪: ঈদ-উল-আযহার পূর্বে মংডু টাউনশিপ থেকে রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক বিতাড়ন করা হয়। ৬ মে ২০২৪: পাউং জার এবং লা বাও জার গ্রামে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক বিতাড়ন করা হয়। ১৭ মে ২০২৪: ২ লাখ রোহিঙ্গাকে বুথিডং টাউনশিপ থেকে বিতাড়ন এবং তাদের বাসস্থানে অগ্নিসংযোগ করা হয়।
চাঁদাবাজি ও লুণ্ঠন : আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের থেকে জোরপূর্বক অর্থ আদায় ও সম্পদ লুণ্ঠন করেছে: ৩০ অক্টোবর ২০২৪: উ শে কিয়া গ্রামে ১৫টি রোহিঙ্গা পরিবারের কাছ থেকে জনপ্রতি ১ লাখ কিয়াট চাঁদা আদায় করা হয়। ৫ নভেম্বর ২০২৪: নগা খুয়া গ্রামের বাজার কমিটির সদস্যদের থেকে ১ লাখ ১০ হাজার কিয়াট চাঁদা দাবি করা হয়।
জোরপূর্বক আরাকান আর্মিতে যোগদানে বাধ্য করা : কিশোর ও যুবকদের সন্ত্রাসী সংগঠন আরাকান আর্মিতে যোগদানে বাধ্য করা হয়েছে: ৯ আগস্ট ২০২৪: সাইন দাউং গ্রামের ১৫০ জন রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়; তাদের মধ্যে অধিকাংশই ৬-১২ বছরের শিশু।
অক্টোবর ২০২৪: বুথিডং টাউনশিপে রোহিঙ্গাদের আরাকান আর্মিতে যোগদানের জন্য নির্যাতন করা হয়; ৪০০ জন রোহিঙ্গা পালিয়ে পন্নাহ কিউন টাউনশিপে আশ্রয় নেন।
মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার : সংঘর্ষের সময় রোহিঙ্গা নাগরিকদের মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও জেনেভা কনভেনশনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
অন্য উপজাতির অনুপ্রবেশ : আরাকান আর্মির নির্যাতনের কারণে মায়ানমারের অন্যান্য উপজাতি গোষ্ঠীর আনুমানিক ৪০০ জন বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছেন। তারা চাকমা, বড়ুয়া, মুরং, খুমি, বম ইত্যাদি উপজাতির মানুষ।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া ও দাবি : এই অপরাধসমূহের পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আরাকান আর্মিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করার দাবি জানিয়েছে। স্বাধীন তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানানো হয়েছে। ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইনভেস্টিগেটিভ মেকানিজম ফর মায়ানমার (IIMM) এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC) এর মাধ্যমে আরাকান আর্মির সংঘটিত গণহত্যার তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করা হয়েছে।
সর্বশেষ : রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আরাকান আর্মির এই নৃশংস সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের ফলে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং লক্ষাধিক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে এই সংকটের সমাধান করা এবং নির্যাতিতদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। আরাকান আর্মিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া এখন সময়ের দাবি।
( তথ্য সুর ও ছবি : ইনফো-বাংলা)