পোঁয়াবারো মধ্যস্বত্বভোগীদের

অর্থনীতি এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন রাজধানী সারাদেশ

বাড়তি না কেনার আহ্বান শুনছে না কেউ

 

এম এ স্বপন : অহেতুক আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে বাজারের ওপর চাপ সৃষ্টি করবেন না, বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চাহিদার অতিরিক্ত পণ্য কিনে বাজার অস্থির না করার অনুরোধ জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। আর সাধারণ ব্যবসায়ীসহ সুপার মার্কেট অ্যাসোসিয়েশন নেতারা আশ্বস্ত করে বলেছেন, পণ্যের পর্যাপ্ত মজুত আছে, অতিরিক্ত পণ্য কিনে রাখার প্রয়োজন নেই। তবে এই আহ্বান, অনুরোধ বা পরামর্শ কাজে আসছে না। সম্ভাব্য লকডাউন আতঙ্কে চাহিদার কয়েকগুণ বেশি চাল, ডাল, তেল, লবণ, পেঁয়াজ, চিনি, শিশুখাদ্যসহ ডায়াপার ও জীবাণুনাশক কিনছেন সাধারণ মানুষ। এর প্রভাব পড়েছে রাজধানীসহ সারাদেশের বাজারে। এই সুযোগে জিনিসপত্রের বাড়তি দাম নিচ্ছেন কিছু অসাধু ব্যবসায়ী।
নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে পাইকার বা মধ্যস্বত্বভোগীদের পোয়াবারো। গত কয়েক দিনে তারা ক্রেতাদের পকেট থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। করোনা দুর্যোগে পণ্য মূল্যবৃদ্ধিতে উৎপাদনকারী কৃষকরা লাভবান হতে পারেননি। পেঁয়াজের ভরা মৌসুমে পাইকাররা কৃষকদের কাছ থেকে ১৫ থেকে সর্বোচ্চ ১৮ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ কিনেছেন। সেই পেঁয়াজ এখন বাজারে বিক্রি করছেন ৭০/৮০ টাকা দরে বিক্রি করছেন। এ ছাড়া চালের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। কৃষকদের কাছ থেকে ২৫/২৬ টাকা কেজি চাল কিনে সেই চাল আড়তদাররা বিক্রি করতো ৩০/৩২ টাকা কেজি। এবার করোনার অজুহাতে সেই চাল বিক্রি করছে ৪০/৪৫ টাকা কেজি। কোনো কোনো চাল আরও বেশি দামেও বিক্রি করছে।
রাজধানীর বাজারে ৫/৬ দিন আগেও প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী কিছুটা স্বাভাবিক দরে বিক্রি হয়েছে। এখন বাজারে চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, আদা, আলুসহ বেশিরভাগ জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে ৫ টাকা থেকে ৩০ টাকা। ব্যবসায়ীরা সব ধরনের সেদ্ধ চালের দাম কেজিপ্রতি ৫ থেকে ৭ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়েছেন। আর পেঁয়াজের দামও বেড়েছে ২০ টাকা পর্যন্ত। রাজধানীর কাওরান বাজার, সেগুন বাগিচা, রামপুরা, শাহজাহানপুর বাজার ঘুরে এবং ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এ সব তথ্য জানা যায়।
বাজারে নিত্যপণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়লেও নিয়ন্ত্রণে রাখার দায়িত্বে থাকা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেলের কোনো তৎপরতা নেই। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরও তাদের সারাবছরের কার্যক্রমের মতোই গতানুগতিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। অভিযান চালিয়ে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা আর বন্ধ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ তাদের কার্যক্রম। রোববার র‌্যাব বেশ কয়েকস্থানে অভিযান চালিয়েছে। তারপরও বাজার স্থিতিশীল হচ্ছে না। সরকারের প্রচার-প্রচারণা যেমন ক্রেতাদের মজুদ করা থেকে থামাতে পারছে না, তেমনি মূল্য বৃদ্ধিও ঠেকাতে পারছে না। কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর অভিযোগ সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। বাজারে সরকারের কোন তদারকি নেই। ব্যবসায়ীরা ইচ্ছা মতো বিভিন্ন পণ্যে দাম বাড়াচ্ছে।
সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হচ্ছে, দেশে পর্যাপ্ত খাদ্যপণ্যের মজুদ রয়েছে। চাহিদার অতিরিক্ত পণ্য না কিনতে আহ্বান জানানো হয় ক্রেতাদের। সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠানে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার জানান, দেশে চাল ও গমের মজুদ প্রয়োজনের চেয়ে বেশি রয়েছে। এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে কেউ দাম বাড়াতে চাইলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার আমদানি ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বেশি। তাই আমদানি করা পণ্যের সংকট হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুই মন্ত্রীর বক্তব্য তেমন কোন প্রভাব পড়েনি বাজারে বা ক্রেতাদের ওপরে। করোনাভাইরাস আতঙ্কে গত দু’দিন ধরে বাজারে ক্রেতারা হুমড়ি খেয়ে পড়লেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেলের কার্যক্রম দেখা যায়নি। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের কার্যক্রমও জোরালো নয়। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে সব দোকানের চার্টে দাম নির্ধারণের নির্দেশ দিলেও সাধারণ মানুষের অভিযোগ, প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ না নেয়ার এমনটি হচ্ছে।
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের প্রভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ এখন প্রায় বিচ্ছিন্ন। অনেক দেশ থেকে ফ্লাইট আসা-যাওয়া বন্ধ করা হয়েছে। স্থলবন্দরগুলোয়ও আমদানি-রফতানি কার্যক্রম বন্ধের উপক্রম। ইতোমধ্যে দেশের একটি অঞ্চল লকডাউন করা হয়েছে।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের ধারণা, যেকোনও সময় দেশের আরও অঞ্চল হয়তো লকডাউন করা হবে। বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে যোগাযোগ ব্যবস্থাও। স্থলবন্দরের কার্যক্রম বন্ধ থাকলে, বিমান রুট বন্ধ হয়ে গেলে খাদ্যপণ্যের সংকট দেখা দিতে পারে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাড়তে পারে পণ্যের দাম। এমন আশঙ্কা থেকে তারা আগামী কয়েক মাসের জন্য খাদ্যসামগ্রী সংরক্ষণ করছেন।
তবে সরকার বলছে, এমন পরিস্থিতি হওয়ার সুযোগ নেই। বাজারে পণ্য সরবরাহ পরিস্থিতি ভালো রয়েছে। প্রয়োজনে এমন পরিস্থিতিতে টিসিবিকে কাজে লাগানো হবে। তেমন প্রস্তুতিও রয়েছে।
তবে সরকারের এ কথা আমলে নিচ্ছে না সাধারণ মানুষ। তাদের ভাষ্য, সরকারের লোকজন সবসময়ই এ ধরনের কথা বলে, পরে যা হওয়ার তা-ই হয়। অসাধু ব্যবসায়ীরা অযৌক্তিক দাম বাড়িয়ে অতিরিক্ত মুনাফা করেন। সরকারের নির্দেশনা মানতে গিয়ে পরে বেশি দামে পণ্য কিনতে হয়।
রাজধানীর একটি বেসরকারি কলেজের শিক্ষক বলেন, ‘গত সেপ্টেম্বরে ভারত রফতানি বন্ধ করে দিলে পেঁয়াজ নিয়ে সরকারের আহ্বান শুনে ঠকেছি। পরে ঠিকই কিনেছি, কিন্তু বেশি দাম দিয়ে।’ তিনি বলেন, ‘সরকারের আহ্বান, অনুরোধ, হুঙ্কার, হুঁশিয়ারি, ধমক, সতর্কবাণী কোনও কাজে আসেনি। ৫০ টাকা কেজি দরের পেঁয়াজ সাধারণ মানুষকে ২৮০ টাকা দিয়েও কিনতে হয়েছে।’
রাজধানীর সেগুনবাগিচা বাজারের এক দোকানদার বলেন, আতঙ্কিত ক্রেতারা অতিরিক্ত চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, রসুন, আটা, লবণ, শুকনা মরিচ কিনছেন। গত এক সপ্তাহ ধরেই এ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘গত দুদিন ধরে বেশি রাত পর্যন্ত দোকান খুলে রেখে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছি। পাইকারি বাজার থেকে পণ্য আনছি আর বিক্রি করছি।’
পাইকারি বাজার থেকে পণ্য পেতে কোনও সমস্যা হচ্ছে না জানিয়ে এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘এখনও কোথাও পণ্য সংকটের কোনও আলামত বা সংবাদ পাইনি।’
এ বিষয়ে বাণিজ্য সচিব ড. জাফর উদ্দিনও বলেন, এই মুহূর্তে বাজারে কোনও পণ্যের সংকট নেই। তিনি বলেন, ‘প্রয়োজনে টিসিবির মাধ্যমে রোজার জন্য আনা পণ্যগুলো তাৎক্ষণিকভাবে বাজারে ছেড়ে দেওয়া হবে। ভোক্তাদের প্রতি এখনও অনুরোধ করছি, কোনোভাবেই আতঙ্কিত হয়ে বাড়তি পণ্য কিনে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করবেন না।’
সুপার মার্কেটগুলোর মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সুপার মার্কেট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশেনের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেনের সই করা বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সুপার মার্কেটগুলোতে পণ্যের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। অতিরিক্ত পণ্য কেনার প্রয়োজন নেই।
চালের দাম বাড়ায় চিন্তিত : চালের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে চিন্তিত সাধারণ মানুষ। কারণ ব্যবসায়ীরা কোন অজুহাতে একবার যদি জিনিসের দাম বাড়াতে পারে তবে তার দাম পরে আর কমে না। করোনাভাইরাস আতঙ্কে হঠাৎ করে সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। কেজিতে ৩ টাকা কোনোটা ৫ টাকা আবার কোনোটা ৭ টাকা এমনকি কোনটা ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ৫৩ টাকায় বিক্রি হওয়া মিনিকেট চাল এখন বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকায়। এদিকে ৩৬ টাকায় বিক্রি হওয়া আটাশ চাল বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৪২ টাকায়। পাইজাম ৫ টাকা দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৪৫ টাকায়। নাজিরশাইল যে চাল ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি হতো তা এখন ৬০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।
মানিকনগরের আমিনুল বলেন, অন্য সময়ের চেয়ে বস্তায় চালের দাম বেড়েছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। এখন আমাদের বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে। তাই বিক্রিও করতে হচ্ছে বেশি দামে। কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত চালের দাম বেড়েছে বলে জানান এই বিক্রেতা।
কাওরান বাজারের একাধিক চালের আড়তে দেখা গেছে, মিনিকেট প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) বিক্রি হচ্ছে ২৬০০ টাকা, আটাশ বিক্রি হচ্ছে ২১০০ টাকা ও মানভেদে নাজিরশাইল ২৩০০ থেকে ৩১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মেসার্স হাজী ইসমাইল অ্যান্ড সন্সের মালিক জসিম উদ্দিন বলেন, বস্তায় চালের দাম বেড়েছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। গত দুই তিন দিন খুব বিক্রি ছিলো। আজ কিছুটা কম। তবে অন্য সময়ের চেয়ে বিক্রি তুলনামূলকভাবে বেশি।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *