বিশেষ প্রতিবেদক : গোপালগঞ্জ এস এম মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও তার স্ত্রী একই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম ও দূর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্বামী স্ত্রী মিলে ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিদ্যালয়টিকে অনিয়ম ও দূর্নীতির আখড়ায় পরিনত করেছে। অত্র বিদ্যালয়ে দীর্ঘ ১৩ মাস ধরে অনিয়মের রাজত্ব চালাচ্ছেন প্রধান শিক্ষক মাহাবুব মুন্সী ও তার স্ত্রী সহকারী শিক্ষিকা রুকসানা আক্তার লিরা।

এই শিক্ষক দম্পতির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, তাঁদের প্রতিষ্ঠিত কোচিং সেন্টারে ছাত্র ছাত্রীদের ভর্তিতে বাধ্য করা, ইংলিশ এভরিডে নামক গাইড কিনতে নির্দেশ দিয়ে লাইব্রেরী থেকে আর্থিক সুবিধা নেওয়া। প্রত্যয়ন পত্র বা টিসি দিতে ৩শ হতে ১ হাজার পর্যন্ত টাকা আদায়, বিভিন্ন শ্রেণীতে আসন বাড়িয়ে ১০হাজার হতে ২০হাজার টাকা পর্যন্ত উৎকোচ নিয়ে ভর্তি করা, আইডি কার্ড তৈরির নামে বাড়তি টাকা আদায় করে ভোগ করা, ভারতীয় যাদুবিদ্যার বই কিনতে বাধ্য করে মধ্যস্বত্ত্বভোগী হওয়া, গোপনে স্কুল বাগানের ফল বিক্রয় করে টাকা আত্মসাৎ, বিভিন্ন দপ্তর থেকে পাওয়া বিদ্যালয় উন্নয়নের বরাদ্দ খরচ না করে আত্মসাৎ করা সহ শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সহকারী শিক্ষকদের সাথে দুর্ব্যবহার।

তাদের এ সকল অনিয়ম, দুর্নীতি ও দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে বিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থী অভিভাবক ও সহকারী শিক্ষকগণ। তবে ওই শিক্ষক দম্পতির রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও সামাজিক প্রভাব প্রতিপত্তির ভয়ে প্রকাশ্যে কেউই প্রতিবাদ করতে সাহস পাচ্ছে না।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা দপ্তর সূত্রে জানাগেছে প্রধান শিক্ষক মাহাবুব মুন্সী গত ৫ মার্চ ২০২৪ তারিখে মডেল স্কুলে যোগাযোগ করলেও সহকারী শিক্ষিকা রুকসানা আক্তার লিরা এই স্কুলে একযুগ ধরে শিক্ষকতা করছেন। এই শিক্ষিকার বিরুদ্ধে এর আগেও একাধিকবার কোচিং বাণিজ্য, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সহকারী শিক্ষকদের সাথে ঝগড়া, গালিগালাজ ও দুর্ব্যবহারের অভিযোগে একাধিক প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। আওয়ামী রাজনীতিবিদের সাথে সখ্যতা থাকায় তৎকালীন সময়ে এই শিক্ষিকার বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি শিক্ষা দপ্তর। উল্টো মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা অধিদপ্তরে আওয়ামী নেতাদের মাধ্যমে লবিং করে পুরস্কার হিসেবে নিজের স্বামীকে মডেল স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে পদায়ন করান। এর পর থেকে হয়ে ওঠেন আরো বেসি বেপরোয়া। স্বামী-স্ত্রী মিলে শুরু করেন অনিয়ম ও দুর্নীতির রাজত্ব। জানা গেছে এই শিক্ষক দম্পতি গোপালগঞ্জ শহরের পাচুড়িয়ায় জায়গা কিনে করেছেন আলিশান তিনতলা বাড়ি।
বিদ্যালয়টির সাবেক ৩য় শ্রেণীর শিক্ষার্থীর অভিভাবক মোঃ বাসার হোসেন (আইনজীবী) জানান, প্রধান শিক্ষক মাহাবুব মুন্সীর স্ত্রী সহকারী শিক্ষক রুকসানা আক্তার লিরা কর্তৃক পরিচালিত শহরের চাঁদ মারি এলাকার কোচিং সেন্টারে মডেল স্কুলের শিক্ষার্থীদের পড়তে বাধ্য করেন। তার কোচিং এ না পড়লে বাচ্চাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার সহ ক্লাসে ফেল করানোর ভয় দেখানো হয়। এই অনিয়ম অব্যবস্থাপনা দেখে আমার বাচ্চাকে কিছু দিন আগে অনির্বাণ স্কুলে ভর্তি করেছি। শুনেছি ওই সহকারী শিক্ষিকা এখনো শিক্ষার্থীদের তার পরিচালিত কোচিং সেন্টারে ভর্তি হতে বাধ্য করছে। তার স্বামী বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক হওয়ায় তার বিরুদ্ধে কোন শিক্ষক ও অভিভাবক কথা বলতে সাহস পায় না। বর্তমানে বিদ্যালয়টিতে অধ্যয়নরত কয়েকজন শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, স্কুলে ১ হাজারের উপরে শিক্ষার্থী রয়েছে পরিচয়পত্র দেওয়ার জন্য জনপ্রতি ১০০ টাকা করে আদায় করলেও অত্যন্ত নিম্নমানের কার্ড সরবরাহ করা হয়েছে। এছাড়াও তাদের কোচিং সেন্টারে প্রতি মাসে ১২শ টাকা দিতে হচ্ছে অভিভাবকদের। এই স্কুলটিতে অনেক গরিব অভিভাবকদের সন্তান রয়েছে তারা এ অতিরিক্ত ব্যয় মেটাতে হিমসিম খাচ্ছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এস এম মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একাধিক সহকারী শিক্ষক শিক্ষিকা সূত্রে জানা যায় প্রধান শিক্ষক মাহাবুব মুন্সী ও রুকসানা আক্তার লিরা এতটাই বেপরোয়া যে, তাদের সামনে কোন শিক্ষক শিক্ষিকা তো দূরের কথা অভিভাবকরাও কথা বলতে ভয় পান। স্কুলের কোন শিক্ষকের সাথেও ভালো ব্যবহার করেন না।
স্কুলের উন্নয়নের দিকে তাদের নজর নেই, কিভাবে তাদের কোচিং সেন্টারে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করা যায় এবং অভিভাবকদের কাছ থেকে কোন কৌশলে বাড়তি টাকা আদায় করা যায় সেই পলিসি আটে। এবছর ৫ম শ্রেণী থেকে যে সকল শিক্ষার্থী পাস করেছে তাঁদের টিসি দেওয়ার সময় বাধ্যতামূলক ভাবে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত উৎকোচ আদায় করেছে। শিক্ষকদের কাছ থেকে বিভিন্ন অজুহাতে ১০০ হতে ৫০০ টাকা উৎকোচ আদায় করে। এছাড়াও একেক দিন একেক শিক্ষিকাকে তাঁদের (স্বামী -স্ত্রী)’র জন্য ভালো ভালো খাবার রান্না করে আনার অর্ডার দেয়। সম্প্রতি বিদ্যালয় উন্নয়নের জন্য জেলা পরিষদ থেকে অনুদান পাওয়া ২লাখ টাকার কোন কাজ করেনি। অর্থ বছর ঘুরে গেলে এই টাকা পুরোটাই আত্মসাৎ করে ফেলবে শিক্ষক দম্পতি। এর আগেও এই ধরনের বরাদ্দ আত্মসাৎ করেছেন তারা। এই শিক্ষক দম্পতির অনিয়মের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমে উচ্চতর তদন্ত কমিটি গঠন করে প্রকাশ্যে এবং গোপনে তদন্ত করার দাবি জানিয়েছেন বিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকগণ।
এসকল অভিযোগের বিষয়ে শিক্ষক দম্পতি মাহাবুব মুন্সী ও রুকসানা আক্তার লিরা দাবি করেন তাদের বিরুদ্ধে ওঠা সকল অভিযোগ ভিত্তিহীন ও বানোয়াট।
এবিষয়ে গোপালগঞ্জের জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার জ্যোৎস্না খাতুন জানান, এটি জেলার একটি স্বনামধন্য প্রাথমিক বিদ্যালয় এধরনের অনিয়ম বিশৃংখলার সত্যতা পাওয়া গেলে সবোর্চ্চ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণেরন জন্য শিক্ষা অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করা হবে।