নিজস্ব প্রতিবেদক : সাউথইস্ট ব্যাংকের সাবেক পরিচালক, ফ্যাসিস্ট দোসর ও ব্যাংকের সাবেক ২০ বছরের চেয়ারম্যান আলমগীর কবিরের ছেলে রাইয়ান কবিরকে আইনের আওতায় আনতে আবেদন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের চেয়ারম্যান, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান ও এনবিআরের চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করা হয়েছে।

সোমবার (১৬ জুন) সাউথইস্ট ব্যাংকের গ্রাহক শিমুল সর্দারের জমা দেওয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, সাউথইস্ট ব্যাংকের সাবেক পরিচালক রাইয়ান কবির একজন মহা দুর্নীতিবাজ ও প্রতারক। তাই নিয়ম বহির্ভূতভাকে পরিচালক হওয়ায় সাউথইস্ট ব্যাংক থেকে ২০২২ সালের ৩১ মে রাইয়ান কবিরকে পর্ষদ থেকে অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। রাইয়ান কবির সাউথইস্ট ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আলমগীর কবিরের ছেলে। রাইয়ান কবিরের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে অনেক অভিযোগ জমা পড়ে। অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হওয়ায় রাইয়ান কবিরকে পর্ষদ থেকে অপসারণের নির্দেশ দেওয়া হয়।

১৯৯৫ সালে সাউথইস্ট ব্যাংকের যাত্রা শুরু হয়। কোনো উদ্যোক্তা না হয়েও ২০০২ সালে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে যুক্ত হন পেশাদার হিসাববিদ আলমগীর কবির। ২০০৪ সালে তিনি চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব নিয়ে ২০ বছর ধরে বিরতিহীন পদে আসীন তিনি। ছেলে রাইয়ান কবির ২০০৩ সালে সাউথইস্ট ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগে চাকরিতে নিযুক্ত হন। সেই ছেলেকেও বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে পরিচালক বানিয়েছেন আলমগীর কবির। আলমগীর কবির ও রাইয়ান কবিরের স্বেচ্ছাচারিতা, হরিলুট, জালিয়াতি, দুর্নীতি এবং অর্থপাচারের মতো অভিযোগ চরম শঙ্কায় ফেলেছে হাজার হাজার গ্রাহকের আমানতকে।

নিয়ম বহির্ভূতভাবে একটানা ২০ বছর চেয়ারম্যান থেকে দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করেছেন বেসরকারি সাউথইস্ট ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আলমগীর কবির। এ সময়ে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ঋণ কেলেঙ্কারি, শেয়ার কারসাজিসহ নানাভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থপাচারের মাধ্যমে ব্যাংকটির হাজার হাজার গ্রাহকের আমানতকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছেন।

আলমগীর কবিরে ২০ বছর ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় অনৈতিকভাবে কমিশন বাণিজ্যের মাধ্যমে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। তিনি বে-আইনী কর্মকান্ড সাউথইস্ট ব্যাংকের বোর্ড সভায় পাস করিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে সভায় কম সংখ্যক এজেন্ডা আলোচনা করা হলেও, ডাইরেক্টরদের উপস্থিত দেখিয়ে সবগুলো এজেন্ডা পাস দেখান। আবার এজেন্ডার শেষ দিকে Miscellaneous নামে একটা এজেন্ডা থাকে, যেখানে নিজের ইচ্ছামত সব এজেন্ডা ঢুকিয়ে বোর্ড মিটিং এ পাস হওয়া মেমোতে নিজের পছন্দমত পাতা পরিবর্তন করে নিতেন। তাতে মেমোর শর্ত, ঋণের পরিমান ও মেয়াদ পরিবর্তন করে দিতেন। এসবই চলছে আলমগীর করিব ও তার ছেলের প্রত্যক্ষ নির্দেশে।
ব্যাংকটির চেয়ারম্যান আলমগীর কবিরের পরিবার নিয়ন্ত্রিত বে লিজিং এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড (বিএলআই) থেকে ২০২০ সালে ১৫ অক্টোবরে মুনিরুজ্জামান সাউথইস্ট ব্যাংকের পরিচালক হন। তার আগে সাউথইস্ট ব্যাংক বিএলআই’এর কোন ঋণ ছিল না। ওই বছরের ২৪ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংক এনওসি দেয়। কিন্তু সে সময় সাউথইস্ট ব্যাংক থেকে ২১০ কোটি টাকা ঋণ ছিল বিএলআই ক্যাপিটাল লি. এর, যা গুরুতর অপরাধ।
সাউথইস্ট ব্যাংকের কল মানি’র ১৩০০ কোটি টাকা হতে শুধু বে লিজিং এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড(বিএলআই) ঋণ পায়। অথচ বিএলআই-এর বর্তমানে মোট প্রায় ৪০০ কোটি টাকার ঋণ সাউথইস্ট ব্যাংকের ব্যালেন্স শিটে দেখানো হয় না বলেও অভিযোগ পর্ষদের। যা ব্যাংকিং খাতে এটি খুবই গুরুতর অপরাধ।
বিএলআই-কে আরও ১২ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়। সাউথইস্ট ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন ১১৮৮ কোটি টাকা, পরিচালক হিসেবে বিএলআই-এর অংশ ২.৩৫ শতাংশ। অর্থাৎ প্রায় ২৭ কোটি টাকা। আইন অনুযায়ী পরিচালক বিএলআই শুধুমাত্র ১৩.৫ কোটি টাকা ঋণ পাওয়ার যোগ্য। অথচ বিএলআই প্রায় ৪০০ কোটি টাকার ঋণ সুবিধা ভোগ করেছে।
পাঁচ বছরে ঋণের বিপরীতে সুদ দিতে হবে না গ্রাহককে, এই বলে মধ্যে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেন সাউথইস্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যান আলমগীর কবির। তারপরও ক্লায়েন্ট এর ঋণ এর “সুদ মুক্ত ব্লকড একাউন্ট” এ দিয়ে দেওয়া হয়। এভাবে তিনি জাজ ভুঁইয়াকে ৩০০ কোটি টাকা, সুয়াদ গার্মেন্টকে ১৫ কোটি, ফাহমী নিটকে ৩০০ কোটি টাকা, কেয়া গ্রুপকে ৯০০ কোটি টাকা, মাহাবুব স্পিনিং কে ১৫০ কোটি টাকার ঋণ দিয়ে Single Borroer Exposer Limit cross করা হয়েছে। তবে এই কারসাজির মাধ্যমে ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে তিনি শত কোটি টাকা কমিশন নিয়েছেন বলে দাবি পর্ষদ সদস্যদের।
আলমগীর কবিরের পুত্র রাইয়ান কবির সিংগাপুরে আর এন্ড এন ট্রেড হোল্ডিং’কে, ইএক্সচেঞ্জ সিঙ্গাপুর প্রাইভেট লি. আর এন্ড এন মেরিন এন্ড শিপ ট্রেড প্রাইভেট লি. নামীয় তিনটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে প্রায় ২০ কোটি টাকার অধিক অর্থ শেয়ার মানি ইকুইটি হিসেবে বিনিয়োগ করেছেন এবং প্রতিবছর বিভিন্ন উপায়ে এদেশ থেকে অর্থ পাচার করে কোম্পানিগুলোর নেট ইক্যুইটি বৃদ্ধি করছেন। যা রাইয়ান কবিরের আয় হিসেবে ঘোষণা নেই। বৈধ উৎসবিহীন এত বড় অঙ্কের অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এর অনুমতি ছাড়া অবৈধ পন্থার বিদেশে পাচার করা হয়েছে।
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বে লিজিংয়ের শেয়ার লেনদেনে সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘনের দায়ে সাউথইস্ট ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আলমগীর কবিরকে ১২ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। একই ঘটনায় তাঁর স্ত্রী সুরাইয়া বেগমকে পাঁচ কোটি টাকা ও জামাতা তুষার এল কে মিয়াকে আড়াই কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। সব মিলিয়ে এই তিনজনকে সাড়ে ১৯ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
রাইয়ান কবির নতুন করে আবারও সাউথইস্ট ব্যাংকের পরিচালক হতে দৌড়ঝাপ শুরু করেছেন। তিনি পরিচালক পদে নিয়োগ পেতে বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করেছেন। ২০২৫ সালের মার্চের ১১ তারিখে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর BRPD পদে আবেদন করেন।
ব্যাংক কেলেঙ্কারির হোতা আলমগীর কবিরের ছেলে রাইয়ান কবির পুনরয় সাউথইস্ট ব্যাংকে পরিচালক পদে নিয়োগ পেলে ব্যাংকটি ধ্বংসের দারপ্রান্তে চলে যাবে। তাই তাকে যেন কোনা অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক দায়মুক্তি না দেয় সে বিষয়ে আপনার হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়। অনতি বিলম্বে তাকে আইনের আওতায় আনতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের চেয়ারম্যান, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান ও এনবিআরের চেয়ারম্যানের সুদৃষ্টি কামনা করা হয়।