ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা হলেও নেই সামাজিক দূরত্ব
সংক্রমণ ছড়ানোর খনি কারওয়ান বাজার
করোনা ঝুঁকি বাড়াচ্ছে কাঁচাবাজার
মহসীন আহমেদ স্বপন : সমগ্র বাংলাদেশকে করোনা সংক্রমণের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। একইসঙ্গে সংক্রমিত এলাকার জনসাধারণকে ঘরে অবস্থান করা, এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় স্থানান্তরে কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং সন্ধ্যা ৬টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত ঘরের বাইরে বের না হওয়াসহ তিন নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বিশ্বজুড়ে মারণঘাতি করোনা ভাইরাসের ২১ লাখের বেশি মানুষ সংক্রমিত হয়েছে। মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে লাখ। বাংলাদেশেও এ রোগের সংক্রমণ আশঙ্কাজনক। প্রতিদিন আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে সমগ্র দেশকে করোনা সংক্রমনের ঝুকিঁপূণ ঘোষণা করলো স্বাস্থ্য অধিদফতর।
অধিদফতরের মহাপরিচালকের ঘোষণায় বলা হয়, সংক্রামক রোগ আইন ২০১৮ এর ১১ এর ১ ধারার ক্ষমতাবলে পুরো দেশকে সংক্রমণের জন্য ঝুকিঁপূর্ণ ঘোষণা করা হলো। যেখানে সংক্রমিত এলাকার জনসাধারণকে ৩ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
প্রথম নির্দেশ-করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রশমনে জনগণকে অবশ্যই ঘরে থাকতে হবে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হওয়া যাবে না। দ্বিতীয় নির্দেশ- এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। তৃতীয় ও সবশেষ নির্দেশ- সন্ধ্যা ৬টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত কেউ ঘরের বাইরে যেতে পারবে না। স্বাস্থ্য অধিদফতরের এ আদেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে সংক্রামক রোগ আইন ২০১৮ অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার হুশিঁয়ারিও দেয়া হয়েছে ঘোষণায়। তারপরও থেমে নেই মানুষের আনাগোনা।
রাজধানীর কাঁচাবাজারগুলো করোনার ঝুঁকি মারাত্মক ভাবে বৃদ্ধি করছে। কাঁচাবাজারগুলোতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মানুষের ভিড় লেগে থাকে। সেখানে সামাজিক দূরত্ব একেবারেই মানা হচ্ছে না। বাজারের ছোট ছোট গলিতে শত শত মানুষ একে অন্যের গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বাজার করছে। প্রতিটি দোকানের সামনে ১২/১৪ জন ক্রেতা এক সঙ্গে জটলা করে সওদা কিনছে। দেশের সব কিছু বন্ধ রেখে অর্থাৎ লকডাউনে রেখে কাঁচাবাজারগুলো এভাবে নিয়ন্ত্রণহীন রাখার ফলে ঝুঁকি রাড়তেই থাকবে।
রাজধানীর মানিকনগর, মুগদা, খিলগাঁও, মালিবাগ, রামপুরা, বাড্ডা, শান্তিনগর, কাওরানবাজার সেগুনবাগিচাসহ আরও কয়েকটি কাঁচাবাজারে দেখা গেছে মানুষের ভিড়। বাজারে আসা ক্রেতারা মানছেন না সামাজিক দূরত্বের বিধি নিষেধ। অনেক বিক্রেতারও ব্যক্তিগত সুরক্ষার জন্য নেই মুখে মাস্ক হাতে গ্লাভস। খালি হাতেই টাকা লেনদেন ও পণ্য দেয়া নেয়া চলছে।
খিলগাঁও রেললাইনের পাশঘেষা বাজারের প্রথম গলিতে বেকারি আইটেম থেকে শুরু করে মশলা, মুদির দোকান, দা বটির দোকান, কসমেটিক, কাপড় ও পশু পাখির খাবারের দোকান রয়েছে। বাজারের বাইরে সবজি ফলমূলের দোকান। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ছোট এই গলিতে শত শত ক্রেতা আসা যাওয়া করছেন। বলতে গেলে পা ফেলার জায়গা নেই। প্রতিটি দোকানের সামনে ভিড় করছেন ক্রেতারা।
মানিকনগরের আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এক সপ্তাহ পর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে বাসা থেকে বের হলাম। বাজারে এসে দেখি মানুষের ভিড়। তাই বাজারে প্রবেশের সাহস পাচ্ছি না। শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনির বাসিন্দা সায়েম আহমেদ বলেন, নিজে সুরক্ষা সামগ্রী ব্যবহার করছি। কিন্তু বাজারে আসা অনেকেই সুরক্ষা সামগ্রী ব্যবহার করছেন না। কার শরীরে করোনা সংক্রমন আছে তা আমরা জানি না। তাই বাজারের এমন চিত্র দেখে ভয় পাচ্ছি। কিছু পণ্য কেনার জন্য বাজারে না এসে উপায় নেই। তাই এসেছি। তবে বাজারের এই বেহাল অবস্থার প্রতি প্রশাসনের এ বিষয়ে নজর দেয়া প্রয়োজন বলে তারা জানান।
মালিবাগ বাজারেও দেখা যায় ক্রেতাদের ভিড়। সুরক্ষা সামগ্রী ছাড়াই বাজারে এসেছেন অনেকে। একইভাবে শান্তিনগরসহ আরও কিছু বাজারে চিত্র একই। ওদিকে ঢাকার সবচেয়ে বড় কাঁচাবাজার নামে খ্যাত কাওরানবাজারের অবস্থা সবচেয়ে ভয়াবহ। সবজি, ফলমূল ও অন্যান্য পণ্যের পাইকারি বাজার হওয়াতে এখানে রাতদিন হাজার হাজার মানুষের আনাগোনা। বিশেষকরে রাত হলে এ বাজারের পরিবেশ জমজমাট হয়ে উঠে।
সন্ধ্যার পর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পণ্যবাহী গাড়ি আসতে শুরু করে। তারপর থেকে ক্রেতা বিক্রেতাদের ভিড় বাড়তে থাকে। একই অবস্থা থাকে পরদিন সকাল পর্যন্ত। এই সময়টা কাওরানবাজারে পা ফেলার উপায় থাকে না। করোনা পরিস্থিতিতে কিছুটা কম হলেও এ বাজারে ঝুঁঁকি চরমে। শহরের বিভিন্ন এলাকার পাইকারি পণ্য কিনতে যাওয়া ব্যবসায়ীরা সুরক্ষা সামগ্রী ব্যবহার করেন না। এছাড়া আড়তের কর্মচারীদের একই অবস্থা।
ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা হলেও নেই সামাজিক দূরত্ব : নভেল করোনাভাইরাস (কভিড-১৯) ছড়িয়ে পড়েছে রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায়। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের না হবার নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তারপরেও মহানগরের রাস্তায় অপ্রয়োজনে অনেক মানুষ চলাফেরা করছে। এই সুযোগে বাজারগুলোতেও দেখা যাচ্ছে উপচে পড়া ভিড়। কেউই মানছে না সামাজিক দূরত্ব।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সারা দেশকেই করোনাভাইরাসের সংক্রমণের জন্য ঝুঁকিপুর্ণ হিসেবে ঘোষণা করলেও রাজধানীতে মানা হচ্ছে না সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব। এই সুযোগে ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এই ভাইরাস।
দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ১৫ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে মহামারি করোনাভাইরাস। ফলে ভাইরাসটিতে এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৭৫ জনের। করোনায় আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন আরও ২৬৬ জন। ফলে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল এক হাজার ৮৩৮ জনে। শুক্রবার দুপুরে স্বাস্থ্য অধিদফতরের করোনাভাইরাস সংক্রান্ত নিয়মিত হেলথ বুলেটিনে এ তথ্য জানানো হয়। অনলাইনে বুলেটিন উপস্থাপন করেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা। এতে নিজের বাসা থেকে সংযুক্ত হন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ও আইইডিসিআরের পরিচালক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান, করোনা শনাক্তে গত ২৪ ঘণ্টায় দুই হাজার ১৯০টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। এতে আরও ২৬৬ জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়েছে। ফলে দেশে মোট করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা হয়েছে এক হাজার ৮৩৮ জন। আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে মারা গেছেন আরও ১৫ জন। এতে মৃতের সংখ্যা হয়েছে ৭৫। আক্রান্তদের মধ্যে আরও নয়জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন, ফলে মোট সুস্থ হয়েছেন ৫৮ জন।
সংক্রমণ ছড়ানোর খনি কারওয়ান বাজার : করোনা ভাইরাসের কারণে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতে জোর দিলেও রাজধানীর পাইকারি বাজারে উল্টো চিত্র। অনেকটা ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়েই দৈনন্দিন কাজ করছেন সব শ্রেণির ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্টরা। এতে শুধু রাজধানী নয়, ঢাকার বাইরেও সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে সচেতন থেকেই ব্যবসা করার দাবি ক্রেতা-বিক্রেতার। নিরাপত্তা নিশ্চিতে মনিটরিং জোরদারের পরামর্শ বাজার বিশ্লেষকদের।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের শুক্রবার ভোর সাড়ে ৪টা। বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাসে দেশে প্রতিদিনই সংক্রমণ ও মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হলেও এ যেন ইচ্ছেকৃত সংক্রমিত হওয়ার মিলনমেলা। ক্রেতা-বিক্রেতাদের বেশিরভাগই নিজেদের নিরাপত্তার বিষয়ে উদাসীন।
বাজারে কাজ করা একজন শ্রমিক জানান, যদি আল্লাহ তায়ালা আমার ক্ষতি দেন, তাহলে এমনই হবে।
বাজার কমিটির কারো দেখা না মিললেও মনিটরিং এ থাকা একজন জানালেন, সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছেন তারা।
বাজার মনিটরিংয়ে দায়িত্ব থাকা একজন জানান, বাজারের ভেতরে যারা মাস্ক পরছেন না। তাদেরকে মাস্ক পরার বিষয়ে বলা হচ্ছে। নিরাপদ দূরত্বে থাকার বিষয়ে বলা হচ্ছে। সংবাদ সংগ্রহে দীর্ঘ দুই ঘণ্টা বাজারে থাকলেও চোখে পড়েনি প্রশাসনের উপস্থিতি।
মনিটরিং জোরদার করা ছাড়া এ অবস্থার উন্নতি সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন।
তিনি বলেন, ট্রাকগুলো যে পয়েন্ট দিয়ে ঢুকছে, সেখানে ট্রাকগুলো যদি কন্ট্রোল করা যায় এবং কমে কমে ছাড়া যায়। একই সঙ্গে যে ক্রেতারা কিনতে আসবে তাদেরকে যদি কন্ট্রোল করে ছাড়তে পারেন, ভেতরেও যদি লোক সমাগম কম হয়। এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর যদি ভিতরে নিরাপদ দূরত্ব নিশ্চিত করতে পারে তাহলেই রক্ষা পাবেন।
এরইমধ্যে দুইজন ব্যবসায়ী করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ায় কারওয়ান বাজারের একাংশ লকডাউন করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।