লকডাউনে হাঁপিয়ে উঠছে গৃহবন্দী মানুষ

জীবন-যাপন

নিজস্ব প্রতিবেদক : ছোট্ট শিশু মাইশা। পড়ছে রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আজিমপুর শাখায়। তৃতীয় শ্রেণির এ ছাত্রী পরিবারের সাথে থাকে আজিমপুরে। মাইশার বাবা একজন পাইকারি কাপড় ব্যবসায়ী। মাইশার দাদু অবসরে যাওয়ার পর ব্যবসা দেখাশোনা করছের এখন তার বাবা। এক মাসের লকডাউনে সবকিছুই বন্ধ। ফলে এক প্রকার গৃহবন্দী পুরো পরিবার।
করোনাভাইরাস (কোভিড ১৯) প্রাদুর্ভাবে দেশের প্রতিটি পরিবারই একই অবস্থায় রয়েছে। ফলে হাঁপিয়ে উঠছে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার সব বয়সী মানুষ।
দেশে গত ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়, যা কয়েক দফা বাড়ানোর পর আগামী ৫ মে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। আকাশ, নৌ, সড়ক ও রেলসহ সকল প্রকার যানচলাচল বন্ধ। জরুরি জিনিসপত্রের প্রতিষ্ঠান ব্যতীত বাকি সব কিছু বন্ধ। ফলে পুরো দেশে অচলাবস্থ। করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকানোর একটা পদক্ষেপ হিসাবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং স্বেচ্ছায় নিজেকে আলাদা করে রাখার অর্থাৎ সেলফ আইসোলেশনের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এ নির্দেশনা মানা হচ্ছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা ধীরে ধীরে লকডাউন উঠিয়ে দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। পরিস্থিতি বিবেচনায় বিভিন্ন দেশ এরই মধ্যে লকডাউন তুলে দিতে শুরু করেছে।
লকডাউন প্রসঙ্গে শিশু মাইশা বলে, স্কুল বন্ধ, কোচিং বন্ধ। কোন বন্ধু-বান্ধবের সাথে দেখা হচ্ছে না। সারাদিন বাসার ভেতরে থাকতে আর ভালো লাগছে না। মাঝে মাঝে একটু ছাদে যাওয়া ছাড়া বাইরে বের হতে পারছি না। খুবই খারাপ লাগছে।
টানা লকডাউনে বিঘিœত হচ্ছে উচ্চশিক্ষা। অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে ক্লাস চালু চালু রাখার সিদ্ধান্ত নিলেও সেটি বাস্তবায়ন সম্পূর্ণভাবে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো পর্যন্ত অনলাইনে ক্লাস নেয়ার সিদ্ধান্তে পৌঁছায়নি। ফলে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী রাশেদুজ্জামান রনি। জসিম উদ্দিন হলের আবাসিক ছাত্র রনি জানান, লকডাউনের কারণে ক্লাস পরীক্ষা বন্ধ। এই পরিস্থিতি ঠিক কবে নাগাদ স্বাভাবিক হবে সেটিও বলা যাচ্ছে না। ফলে শিক্ষার্থীদের স্বার্থে কর্তৃপক্ষকে বিকল্প চিন্তা করা উচিত।
রাজধানীর নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী আব্দুল খালেক। খুচরা ও পাইকারি চশমা বিক্রি করেন তিনি। লকডাউনের কারণে নিউমার্কেট ১ নম্বর গেট সংলগ্ন দোকানটি প্রায় ১মাস বন্ধ। পরিবারের একমাত্র কর্মজীবী চল্লিশোর্ধ খালেক জানান, এভাবে লকডাউন চলতে থাকলে পরিবার পরিজনসহ না খেয়ে মরতে হবে। জমানো অর্থ দিয়ে এখনো পর্যন্ত চলছি, কিন্তু কত দিন এভাবে চলা যায়। তার উপর আবার ব্যাংক ঋণও আছে। সব মিলিয়ে বিপদে রয়েছি।
রাজধানীর মিরপুরে পরিবার নিয়ে বাস করেন সোলাইমান মিয়া। পেশায় তিনি সিএনজি চালক। লকডাউনের কারণে কাজে নামতে পারছেন না। ঘরে খাবারের সংকটের কারণে ত্রাণের আশায় বের হয়েছেন। সোলাইমান জানান, লকডাউনে সব থেকে বিপদে পড়েছি আমরা। রাস্তায় নামলে ইনকাম হয়, না নামলে হয় না। এখন তো সেটাও সম্ভব হচ্ছে না। শুনেছি অনেকে সাহায্য করছেন, সেই আশায় বাসা থেকে বের হয়েছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গার্হস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের একদল গবেষক দেখিয়েছেন, লকডাউনের কারণে বাংলাদেশে দিনে প্রায় ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। গত ১৮ এপ্রিল তাঁরা এই গবেষণার প্রাথমিক ফল প্রকাশ করেন। এই গবেষণা শুধু কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের ক্ষতি ধরে এই হিসাব করা হয়েছে।
গবেষকেরা বলেছেন, লকডাউন অব্যাহত থাকলে দৈনন্দিন ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে। পুরো মে মাস পর্যন্ত লকডাউন থাকলে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ৯ শতাংশ।
করোনাভাইরাসের কারণে অভ্যন্তরীণ ও রপ্তানিমুখী বাণিজ্য দুটিই মার খাচ্ছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলেছে, করোনাভাইরাসের কারণে আগামী তিন মাসে বিশ্বে ১৯ কোটি মানুষ চাকরি হারাবে। এর মধ্যে ১২ কোটি এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসগরীয় অঞ্চলের। বাংলাদেশেও দেড় কোটি মানুষ বেকার হতে পারে বলে আভাস দিয়েছেন কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ।


বিজ্ঞাপন