মে মাসে আক্রান্ত হবে ১ লাখ!

এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন সারাদেশ স্বাস্থ্য

*দুই লাখ মানুষ কোয়ারেন্টাইনে
*আক্রান্তের সংখ্যা ছয় হাজার ৪৬২
*হটলাইনে ২৪ ঘণ্টায় ৭২ হাজার কল

 

মহসীন আহমেদ স্বপন : দেশে করোনাভাইরাসের বিস্তার বেড়েই চলেছে। দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৬১ জেলায় ইতোমধ্যে হানা দিয়েছে অতি সংক্রামক এই ভাইরাস। রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আগামী সপ্তাহ থেকে সংক্রমণ বিস্তারের গতি ঝড়ে রূপ নিতে পারে। আর তাতে মে মাসের মধ্যেই দেশে নভেল করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে পৌঁছাতে পারে এক লাখে। যদি লকডাউনসহ পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়া হয়, তাহলেও আক্রান্ত হতে পারে কমপক্ষে ৫০ হাজার মানুষ। আর প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে দেশে ৮০০ থেকে ১ হাজারের মতো মানুষ মারা যেতে পারেন।
খোদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে এই আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উচ্চ পর্যায়ের ওই বৈঠকে একাধিক মন্ত্রী ও সচিবসহ বিভিন্ন পর্যায়ের শীর্ষ ব্যক্তিরা উপস্থিতি ছিলেন। বৈঠকের কার্যবিবরণীতে এই আশঙ্কার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত বুলেটিনে স্বাস্থ্য মন্ত্রীসহ কর্তা ব্যক্তিরা যতই পরিস্থিতি নিয়ে তুষ্টির ঢেঁকুর তুলেন না কেন বাস্তব পরিস্থিতি মোটেও সেরকম নয়। অবশ্য সামনের দিনগুলো যে অনেক চ্যালেঞ্জিং ও কঠিন সে আভাস প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময়ে দিয়েছেন। আর এই সম্ভাব্য সঙ্কট এড়াতে দেশের মানুষকে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন। তবে কতটা চ্যালেঞ্জিং হতে পারে ওই পরিস্থিতি সে সম্পর্কে দায়িত্বশীল কোন পর্যায় থেকে ধারণা দেওয়া হয়নি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওই বৈঠক সূত্রে মোটামুটি ধারণা পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, গত ২১ এপ্রিল করোনাভাইরাস সংক্রমণ মোকাবেলায় আন্তঃমন্ত্রণালয় এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ সম্ভাব্য সংক্রমণ ও মৃত্যু সম্পর্কে কিছু ধারণা দেন। বৈঠকে তিনি একটি সাধারণ মডেল ও অপর একটি রক্ষণশীল মডেলের তথ্য তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, বিশেষজ্ঞরা দু’টি প্রক্ষেপণ করেছেন। প্রথম প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, ৩১ মে পর্যন্ত দেশে ৪৮ হাজার থেকে ৫০ হাজার মানুষ করোনায় আক্রান্ত হতে পারেন। আর এ সময়ের মধ্যে করোনায় মৃত্যু হতে পারে ৮০০ থেকে ১০০০ মানুষের। আর দ্বিতীয় প্রক্ষেপণ অনুসারে আক্রান্তের সংখ্যা হতে পারে প্রায় এক লাখ মানুষ।
সভায় তিনি জানান, এই খারাপ পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে আমাদের সর্বোচ্চ সক্ষমতা অনুযায়ী স্বাস্থ্যসেবার প্রস্তুতি গ্রহণ করা হচ্ছে। এই সব প্রক্ষেপণে অনেকগুলো ফ্যাক্টর বিবেচনা ও ব্যবহার করা হয়েছে (যেমন-লকডাউন, জনসচেতনতা, সামাজিক দূরত্ব ইত্যাদি এবং এগুলোর বর্তমান পর্যায়)।
প্রক্ষেপণ দুটি বিবেচনায় রেখেই করোনা নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসার প্রস্তুতি গৃহীত হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডিজি আরো জানান, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সর্বশেষ নির্দেশনা অনুসারে আক্রান্তদের মধ্যে ২০ শতাংশ রোগীর হাসপাতাল সেবা প্রয়োজন।
ওই সভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন, তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান, শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ান এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিব, পুলিশের আইজি, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবরা উপস্থিত ছিলেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সভাপতিত্বে এ সভায় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব, ডিজিএফআই ডিজি ও এনএসআই ডিজিসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অংশ নেন।
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে করোনা মোট ১৫৫ জনের প্রাণ কেড়ে নিলো। আক্রান্ত হিসেবে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন আরও ৫৪৯ জন। ফলে দেশে করোনায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছয় হাজার ৪৬২।
মঙ্গলবার দুপুরে স্বাস্থ্য অধিদফতরের করোনাভাইরাস সংক্রান্ত নিয়মিত হেলথ বুলেটিনে এ তথ্য জানানো হয়। অনলাইনে বুলেটিন উপস্থাপন করেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা। তিনি জানান, করোনাভাইরাস শনাক্তে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও চার হাজার ৩৩২টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। সব মিলিয়ে নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ৫৪ হাজার ৭৩৩টি। নতুন যাদের নমুনা পরীক্ষা হয়েছে, তাদের মধ্যে আরও ৫৪৯ জনের দেহে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। ফলে মোট করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ছয় হাজার ৪৬২ জন। আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে মারা গেছেন আরও তিনজন। ফলে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫৫ জনে। এছাড়া সুস্থ হয়ে উঠেছেন আরও আটজন। সব মিলিয়ে সুস্থ হয়েছেন ১৩৯ জন।
করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে সবাইকে ঘরে থাকার এবং স্বাস্থ্য অধিদফতর ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ-নির্দেশনা মেনে চলার অনুরোধ জানানো হয় বুলেটিনে।
প্রায় চার মাস আগে চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস এখন গোটা বিশ্বে তা-ব চালাচ্ছে। চীন পরিস্থিতি অনেকটাই সামাল দিয়ে উঠলেও এখন মারাত্মকভাবে ভুগছে ইউরোপ-আমেরিকা-এশিয়াসহ বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চল। এ ভাইরাসে বিশ্বজুড়ে আক্রান্তের প্রায় পৌনে ৩১ লাখ। মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে দুই লাখ ১১ হাজার। তবে সোয়া নয় লাখের মতো রোগী ইতোমধ্যে সুস্থ হয়েছেন।
গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। এরপর প্রথম দিকে কয়েকজন করে নতুন আক্রান্ত রোগীর খবর মিললেও এখন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে এ সংখ্যা। বাড়ছে মৃত্যুও।
প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার। নিয়েছে আরও নানা পদক্ষেপ। যদিও এরই মধ্যে সীমিত পরিসরে ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকার কিছু পোশাক কারখানা সীমিত পরিসরে খুলতে শুরু করেছে। তবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা নিশ্চিত করা না গেলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে কি-না, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
হটলাইনে ২৪ ঘণ্টায় ৭২ হাজার কল : করোনা ভাইরাস সংক্রমণের এ সময়ে গত ২৪ ঘণ্টায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের হটলাইনে ৭২ হাজার ৪৪৭টি ফোনকল এসেছে। করোনা সংক্রমণের পর এ পর্যন্ত সর্বমোট ৩৫ লাখ ৫৮ হাজারের বেশি ফোনকল রিসিভ করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
মঙ্গলবার দুপুরে স্বাস্থ্য অধিদফতরের করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত নিয়মিত হেলথ বুলেটিনে এ তথ্য জানান অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা।
তিনি আরও বলেন, ‘মোবাইল ফোন ও ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ৩১ হাজার ১২৪ জনকে স্বাস্থ্য পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত ১৫ লাখ ৩৬ হাজার ২১৭ জনকে এসবের মাধ্যমে স্বাস্থ্য পরামর্শ দেয়া হয়েছে।’
ডা. নাসিমা সুলতানা বলছেন, ‘আমরা কোভিড-১৯ বিষয়ক যেসব স্বাস্থ্যবিধি নিয়মিত বলে থাকি, এগুলো সবাই যথাযথভাবে পালন করবেন। তা না হলে আক্রান্তের সংখ্যা কমাতে পারব না। এটা প্রতিনিয়তই বেড়ে যাবে।’
গত ২৪ ঘণ্টায় বিমান, স্থল ও সমুদ্রবন্দর দিয়ে ৫০১ জন এসেছে বলেও জানান তিনি।
নাসিমা সুলতানা বলেন, ‘গত ২৪ ঘণ্টায় আসাদের মধ্যে বিমানবন্দর দিয়ে ৩১৪, স্থলবন্দর দিয়ে ৬১ এবং সমুদ্রবন্দর দিয়ে ১২৬ জন এসেছেন। তাদের সবাইকে স্ক্রিনিং করা হয়েছে। এ পর্যন্ত সর্বমোট স্ক্রিনিং করা হয়েছে ছয় লাখ ৭৫ হাজার ৭৮২ জনকে।’
আজকের স্বাস্থ্য বুলেটিনের তথ্যমতে, করোনার কারণে দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে করোনায় মৃত্যু দাঁড়ালো মোট ১৫৫ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে করোনা শনাক্ত হয়েছেন ৫৪৯ জনের দেহে। ফলে দেশে করোনায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ালো ছয় হাজার ৪৬২ জন। আর গত একদিনে সুস্থ হয়েছেন তিনজন। এ নিয়ে সুস্থ রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩৯-এ।
দুই লাখ মানুষ কোয়ারেন্টাইনে : গত ২৪ ঘণ্টায় হোম এবং প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে আছেন ২ হাজার ৩৯২ জন। ২৪ ঘণ্টায় ছাড় পেয়েছেন ৩ হাজার ২৩১ জন। বর্তমানে মোট হোম এবং প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে আছেন ১ লক্ষ ৮১ হাজার ৭৯২ জন।
দেশে ৬৪ জেলার সকল জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনের জন্য প্রস্তুত করা আছে ৬০১টি প্রতিষ্ঠান এবং তাৎক্ষণিকভাবে কোয়ারেন্টিন সেবা প্রদান করা যায় ৩০ হাজার ৬৩৫ জনকে।
মঙ্গলবার দুপুরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনাভাইরাস সংক্রান্ত নিয়মিত হেলথ বুলেটিনে এ তথ্য জানানো হয়। অনলাইনে বুলেটিন উপস্থাপন করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা। তিনি বলেন, যারা দেশবাসীর পাশে বিভিন্ন দাঁড়িয়েছেন তাদের সবার প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ।
তথ্যমতে, দেশের ৬৪ জেলার ৬০টিতেই করোনা রোগী পাওয়া গেছে। সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে ঢাকা জেলায়। যেখানে মোট রোগীর প্রায় ৭৩ শতাংশ শনাক্ত হয়েছে। ঢাকার চার জেলার মধ্যে পর্যাক্রমে সংক্রামণে হার বেশি নায়ারণগঞ্জে। এরপর রয়েছে গাজীপুর। গাজীপুরের পর সংক্রামণের হারে এগিয়ে কিশোরগঞ্জ এবং চতুর্থ জেলা নরসিংদী।


বিজ্ঞাপন