শ্রমিক ছাঁটাইয়ের হিড়িক

অর্থনীতি জাতীয় জীবন-যাপন

বিশেষ প্রতিবেদক : করোনাভাইরাসের কারণে দেশের পোশাক কারখানায় কত শ্রমিক ছাঁটাইয়ের শিকার হয়েছেন, তার সঠিক সংখ্যা নেই সরকারের কাছে। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন ও মালিক পক্ষ থেকেও পাওয়া গেছে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য। কোনো কোনো শ্রমিক সংগঠনের দাবি, এরই মধ্যে ৩০ থেকে ৪০ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছে। কেউ বলছেন, এই সংখ্যা ১০ থেকে ২০ হাজার। সব তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে সংখ্যাটি ৩০ হাজারের কম হবে না বলেও ইঙ্গিত দিয়েছে শ্রমিক সংগঠন। এদিকে, পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র তথ্যমতে, গত এক মাসে ১৫ হাজারের বেশি শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছে। পোশাক কারখানার মালিকদের আরেক সংগঠন বিকেএমএই বলছে, তাদের একটি কারখানায় ৫০০ শ্রমিক ছাঁটাই হলেও পরে তাদের পুনঃনিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় ছাঁটাইয়ের সঠিক সংখ্যা জানতে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতর এবং গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের অপেক্ষায় রয়েছে সরকার।
নভেল করোনাভাইরাস দেশের সমৃদ্ধির পথ ব্যাহত করেছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আমরা দেশটাকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম। এ নভেল করোনাভাইরাস আমাদের সেই যাত্রা অনেকটাই ব্যাহত করেছে। কিন্তু তার পরও আমাদের থেমে থাকলে চলবে না। আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানায় গত ১০ এপ্রিল একদিনেই কাজ হারান ৪০৬ জন শ্রমিক। বিজিএমইএর সদস্য কারখানাটি জার্সিসহ নানা ধরনের স্পোর্টসওয়্যার তৈরি ও রফতানি করে। এর আগে ৭ এপ্রিল গাজীপুরেরই আরেকটি পোশাক কারখানায় কাজ হারিয়েছেন ১৭০ জন শ্রমিক। শুধু গাজীপুর নয়, গত ২৬ মার্চ সাধারণ ছুটি শুরুর পর থেকেই পোশাকসহ দেশের সব শিল্প এলাকার কারখানাগুলোতেই কম-বেশি শ্রমিক ছাঁটাইয়ের পরিকল্পনা চলছিল। এ ধারাবাহিকতায় কারখানা মালিকরা এখন পর্যন্ত সাড়ে আট হাজারেরও বেশি শ্রমিক ছাঁটাই করেছেন।
শ্রম ও শিল্পসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, আসন্ন মন্দা মোকাবেলায় শিল্প-কারখানাগুলো ব্যয় সংকোচন পরিকল্পনা নিয়েছে। এ কারণে ধীরে ধীরে বাড়ছে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঘটনা। নভেল করোনাভাইরাসজনিত সংকটে শ্রমিক ছাঁটাই না করার বিষয়ে সরকারের দিকনির্দেশনা থাকলেও ছাঁটাই এরই মধ্যে আট হাজার ছাড়িয়েছে। আইন অনুসরণ করে ‘রিট্রেঞ্চমেন্ট’ বা ছাঁটাইয়ের মাধ্যমে ব্যয় সংকোচনের বিষয়টি স্বীকার করেছেন মালিকরাও। দেশের শিল্প এলাকাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছে আশুলিয়া ও গাজীপুরে। এছাড়া চট্টগ্রাম, খুলনা, ময়মনসিংহে কোনো ছাঁটাইয়ের তথ্য না থাকলেও ৫০০ শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঘটনা আছে নারায়ণগঞ্জে। আশুলিয়ায় মোট ৪৮টি কারখানায় শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে পোশাক শিল্প মালিক সংগঠন বিজিএমইএ সদস্য কারখানা ৩৮টি, বিকেএমইএ সদস্য কারখানা পাঁচটি। অন্যান্য খাতের কারখানা পাঁচটি। সব মিলিয়ে ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকের সংখ্যা ৬ হাজার ৪৩০।
গাজীপুর এলাকার ১০টি কারখানা শ্রমিক ছাঁটাই করেছে। এর মধ্যে বিজিএমইএ সদস্য কারখানা সাতটি ও অন্যান্য খাতের কারখানা তিনটি। এসব কারখানায় ছাঁটাইকৃত শ্রমিকের সংখ্যা মোট ১ হাজার ৬২৩। নারায়ণগঞ্জ এলাকায় মোট সাতটি কারখানায় শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে বিজিএমইএ সদস্য কারখানা একটি ও বিকেএমইএ সদস্য কারখানা চারটি। এছাড়া রফতানি প্রক্রিয়াকরণ কর্তৃপক্ষের আওতাধীন ও অন্যান্য খাতের দুটি কারখানায় শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়েছে।
বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক এ বিষয়ে বলেন, আমাদের তালিকা দেখে উত্তর দেব। এর আগে এপ্রিলে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঘটনা ঘটলে তিনি বলেছিলেন, কাজের বয়স এক বছরের নিচে এমন শ্রমিকদের আইনসম্মত ‘রিট্রেঞ্চমেন্ট’ হতে পারে। কিন্তু আমাদের প্রতিটি সদস্যকে এমনটা না করতে অনুরোধ করেছি।
এদিকে খাতসংশ্লিষ্ট সংগঠনের অনুরোধের পাশাপাশি করোনা প্রাদুর্ভাবকালে শ্রমিক ছাঁটাই না করার বিষয়ে নির্দেশনা আছে সরকারেরও। সর্বশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে রোববার। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ওই নির্দেশনায় বলা হয়, ৪ মে প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঈদুল ফিতরের আগে মালিকপক্ষ কোনো শ্রমিক ছাঁটাই বা লে-অফ ঘোষণা করবেন না। এছাড়া সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৬৫ শতাংশ হারে শ্রমিকের মজুরি পরিশোধের মাধ্যমে সভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের নির্দেশনা দিয়েছে শ্রম মন্ত্রণালয়।
কিন্তু শ্রমিক ছাঁটাই না করতে সরকারের নির্দেশনা যেমন পরিপালন হয়নি, তেমনি সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৬৫ শতাংশ হারে মজুরি পরিশোধকালে অনেক কারখানার শ্রমিক তা মানছেন না বলেও শিল্পসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। ৯ মে আশুলিয়া ও গাজীপুরে মোট ৩৫টি কারখানায় শতভাগ মজুরির দাবিতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন শ্রমিকরা। রোববারও গাজীপুর, আশুলিয়া ও চট্টগ্রাম এলাকায় শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটেছে, যার অধিকাংশই হয়েছে শতভাগ মজুরির দাবিতে।
গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার বৃহস্পতিবার (৭ মে) বলেন, স্মারকলিপিতে আমরা ২৫ হাজার শ্রমিক ছাঁটাইয়ের কথা বলেছিলাম। এখন এই সংখ্যা ৪০ হাজারে দাঁড়িয়েছে।
জানতে চাইলে বিকেএমইএ’র প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, যারা ৩০ থেকে ৪০ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই হওয়ার কথা বলছেন, তাদের বলব এই রিপোর্টটি আমাদের কাছে জমা দিতে। ছাঁটাই কিভাবে হয়েছে, কোন প্রেক্ষাপটে হয়েছে, তা আমরা খতিয়ে দেখব। যদিও ছাঁটাই মালিকের আইনগত অধিকার, তবে করোনার এই সময়ে আমরা আমাদের সব সদস্যকে অনুরোধ করেছি কোনো শ্রমিককে ছাঁটাই না করতে। আর তারা যে ৩০ থেকে ৪০ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই হওয়ার কথা বলছেন, সেটি বিশ্বাসযোগ্য না হওয়ার কারণেই আমরা তালিকা দেখতে চাই।’
সংগঠনটির পরিচালক ফজলে শামীম এহসান বলেন, আমাদের সংগঠনের একটি সদস্য কারখানায় ৫০০ শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছিল। পরে তাদের আবার পুনঃনিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কোনোভাবেই এর বেশি শ্রমিক ছাঁটাই হয়নি। আমাদের পক্ষ থেকে কঠোর অবস্থান নেওয়া হয়েছে। যারা সংখ্যাটি বাড়িয়ে বলছে, তারা ভুল বলছে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি ও বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ’র সদস্যভুক্ত কোনো কারখানা তার কর্মীদের এখন ছাঁটাই করছে না। যারা ওই কথাগুলো বলছে, সেগুলো বানানো কথা। শ্রমিকদের উসকানি দিয়ে তারা পোশাক খাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। যদি শ্রমিক ছাঁটাই হয়ে থাকে, তবে কোন কারখানায়, কী কারণে এবং কারখানাটি কোন সংগঠনের, তা উল্লেখ করতে হবে। শ্রমিক একেবারেই ছাঁটাই হয়নি, তাও নয়। ছাঁটাই হয়েছে, কিন্তু সেটা ৩০ থেকে ৪০ হাজার এটি কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।


বিজ্ঞাপন