৮-১০ ফুট জলোচ্ছ্বাস
ঘূর্ণিঝড়ে ৪ জনের মৃত্যু
নিজস্ব প্রতিবেদক : অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় আম্পান উপকূল আঘাত হেনেছে। ঘূর্ণিঝড় আম্পান, অতিক্রম করবে ৪ ঘণ্টায়। মংলা ও সুন্দরবন অতিক্রম করছে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় আম্পান। এর আগে ঘূর্ণিঝড়টি বিকাল ৫টার দিকে উপকূলের বাংলাদেশ অংশে পৌঁছে। ভারতের সাগরদ্বীপের পাশ দিয়ে সুন্দরবন ঘেঁষে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের ভূভাগে উঠে আসে।
ঘূর্ণিঝড় আম্পান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ উপকূলে আছড়ে পড়ার পর স্থলভাগে তা-ব চালাতে চালাতে অগ্রসর হচ্ছে কলকাতার দিকে, এর বিস্তার প্রবেশ করেছে বাংলাদেশেও।
এ বিষয়ে আবহাওয়াবিদ আবদুল মান্নান বলেন, ঘূর্ণিঝড় আম্পান বিকাল ৫টার দিকে উপকূলের বাংলাদেশ অংশে পৌঁছেছে। ভারতের সাগারদ্বীপের পাশ দিয়ে সুন্দরবন ঘেঁষে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের ভূভাগে উঠে আসছে। ওই সময় এর কেন্দ্রের কাছে বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৬০ থেকে ১৮০ কিলোমিটার, যা দমকা বা ঝেড়ো হাওয়ার আকারে ২০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছিল।
ঘূর্ণিঝড় আম্পানের ব্যস প্রায় ৪০০ কিলোমিটার জানিয়ে মান্নান বলেন, পুরোপুরি স্থলভাবে উঠে আসতে ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা লাগতে পারে। এর প্রভাবে বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত ভারী বর্ষণ হতে পারে।
এবিষয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সামছুদ্দীন আহমেদ বলেন, ঘূর্ণিঝড় আম্পান উপকূল অতিক্রম করা শুরু করেছে। আজ রাত ৮ টার মধ্যে এটা উপকূল অতিক্রম করে যাবে।
সামছুদ্দীন আহমেদ জানান, অতিক্রমের সময় বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ১৬০ থেকে ১৮০ কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে। আর এসময় জলোচ্ছ্বাস হবে ১০ থেকে ১৫ ফুট। তিনি বলেন, বিকেল চারটা থেকে রাত আটটার মধ্যে আম্পান বাংলাদেশের সাতক্ষীরা, খুলনা অঞ্চল অতিক্রম করবে। এ সময় বাতাসের গতিবেগ ক্রমান্বয়ে কমতে থাকবে।
এদিকে কোভিড-১৯ মহামারীর মধ্যে ঘূর্ণিঝড় ‘আম্পান’ বাংলাদেশ-পশ্চিমবঙ্গ উপকূলের দিকে এগিয়ে আসতে থাকায় ২৩ লাখ ৯০ হাজার ৩০৭ জন মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। এছাড়া ৫ লাখ ১৭ হাজার ৪৩২টি গবাদিপশুকে নিরাপদ স্থানে সরানো হয়েছে বলে বলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান জানিয়েছেন।
লোকসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় আশ্রয় কেন্দ্রের সংখ্যা ১২ হাজার ৭৮টি থেকে বাড়িয়ে ১৪ হাজার ৩৩৬টি করা হয়েছে। বাংলাদেশে ঝড়ের মধ্যে সরিয়ে নেওয়া মানুষের সংখ্যা এটাই সর্বোচ্চ বলে জানিয়েছেন ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী। এরআগে ঘূর্ণিঝড় ফণির সময় ১৮ লাখ এবং বুলবুলের সময় ২২ লাখ মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছিল।
এরআগে ঘূর্ণিঝড় আম্পান পশ্চিমবঙ্গ উপকূলে আঘাত হানার পর স্থলভাগে উঠে আসতে শুরু করেছে। স্থলভাগে উঠে আসার প্রক্রিয়ার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকায় তা-ব চালিয়েছে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় আম্পান। সেই সঙ্গে ভারত ও বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকাজুড়ে চলছে তুমুল বৃষ্টি।
ঘূর্ণিঝড় আম্পানে ৪ জনের মৃত্যু : ঘূর্ণিঝড় আম্পানের কারণে ভোলায় দুজনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া পটুয়াখালীতে আরো দুজনসহ মোট চারজেরন মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার মানিকা ইউনিয়নের চর কচ্ছপিয়া গ্রামের সিদ্দিক ফকির (৭০) বাড়ির পাশে গাছের নিচে চাপা পড়েন। তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রুহুল আমিন।
এর আগে সকালে চট্টগ্রামে শ্রমিক হিসেবে কাজ করা মোহাম্মদ রাফিকুল ইসলাম (৩৫) ফিরছিলেন। লক্ষ্মীপুরের মজু চৌধুরীর ঘট থেকে ট্রলারে করে ভোলার ইলিশা ঘাটে আসার পথে মেঘনায় ট্রলার উল্টে নিহত হন তিনি। লকডাউন অমান্য করার কারণে পরিবারের লোকজন তার মৃত্যুর ঘটনা শুরুতে গোপন রাখেন।
বুরহান উদ্দিন থাকার ওসি এনামুল হক জানান, নিহতের লাশ বিকালে তার বাড়ি হাসান নগর ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডে আনার পর পুলিশ ঘটনাটি জানতে পারে।
৮-১০ ফুট জলোচ্ছ্বাস : সুপার সাইক্লোন আম্পানের প্রভাবে দেশের বেশ কয়েকটি এলাকায় জলোচ্ছ্বাস হয়েছে। এ সময় ঘূর্ণিঝড়ের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৬০ কিলোমিটার।
জলোচ্ছ্বাস হওয়া এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে, সাতক্ষীরা, মোংলা, হাতীয়া ও বিভিন্ন চর এলাকা। এসব এলাকায় ৮ থেকে ১০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস হয়েছে। মূল আঘাত পশ্চিমবঙ্গমুখী হওয়ায় দেশে বেশি প্রভাব পড়েনি।
এদিকে সুপার সাইক্লোন আম্পান শুরুতেই উত্তর চব্বিশ পরগনায় ৫০০০ কাঁচা বাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছে। কলকাতায় ১১০ কিলোমিটার বেগে কলকাতায় আছড়ে পড়েছে ভয়ংকর আম্পান। মিনিটে মিনিট ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম নিউজ ১৮ এর খবরে বলা হয়েছে, মারাত্মক জোরে হাওয়া, বৃষ্টিতে নাজেহাল কলকাতা, দুই ২৪ পরগনা ও মেদিনীপুর। ইতোমধ্যেই শহরের বহু রাস্তায় গাছপালা ভেঙে পড়েছে। তুফান হাওয়ায় তটস্থ ঘরবন্দি মানুষ৷
স্থানীয় আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী, কলকাতায় ঝড়ের বেগ থাকবে ১২০ থেকে ১৩০ কিমি প্রতি ঘণ্টায়। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে এ ঘূর্ণিঝড়ে। পূর্ব মেদিনীপুর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণায় সবচেয়ে ভয়ংকর হতে চলেছে আম্পান। ঘণ্টায় এর গতিবেগ থাকতে পারে ১৬০ কিমি।
কক্সবাজারে তা-ব : ঘূর্ণিঝড় আম্পান থেমে থেমে তা-ব চালাচ্ছে কক্সবাজারে। বিশেষ করে বিকেল থেকে এ তা-ব শুরু হয়। সাগর উত্তালের সাথে সাথে বয়ে যাচ্ছে ঝড়ো হাওয়া ও বৃষ্টি। ইতোমধ্যে কক্সবাজারের উপকূল থেকে ১৮ হাজার মানুষকে নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়েছে। কিন্তু কক্সবাজার শহরের উপকূলীয় এলাকার প্রায় ৪০ হাজার মানুষকে এখনো নিরাপদ আশ্রয়ে আনা যায়নি।
তবুও স্বেচ্ছাসেবকরা মাইকিং ও সতর্কতা বার্তা অব্যাহত রেখেছেন। তবে কেউ না আসতে চাইলে তাকে জোর করে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসা হবে বলে জানিয়েছে প্রশাসন।
বুধবার বিকেল ৩টা, শুরু হয় ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তা-ব। যা চলে ১০ মিনিট পর্যন্ত। এরপর আবারও বিকেল ৪টার দিকে শুরু হয় দ্বিতীয় দফা তা-ব। বয়ে যাচ্ছে ঝড়ো হাওয়া ও ঝড়ো বৃষ্টি। ঝড়ো বাতাসে ভেঙে যাচ্ছে গাছপালা। এরপর বিকেল ৫টায় তৃতীয় দফা শুরু হয় তুমুল বৃষ্টি। যা অব্যাহত রয়েছে।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে উত্তাল রয়েছে সাগর। জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ থেকে ১০ ফুট উচ্চতায় প্রবাহিত হয়ে আঘাত করছে উপকূলে।
কক্সবাজার আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ মো. আবদুর রহমান বলেন, ঘূর্ণিঝড় আম্পান কক্সবাজার উপকূল থেকে ৪৩০ কি.মি. দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থান করছে। যার কারণে মাঝে মাঝে ঝড়ো হাওয়া, ঝড়ো বৃষ্টি ও ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এটি সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করবে। বিশেষ করে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পেয়ে ১০ থেকে ১৫ ফুট উচ্চতায় প্রবাহিত হতে পারে। তাই উপকূলের লোকজনকে নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্রে থাকার প্রয়োজন বলে তিনি জানান।
এদিকে কক্সবাজার শহরের সমুদ্র উপকূলবর্তী ১০টি গ্রাম। যেখানে বসবাস করছে ৪০ হাজারের বেশি মানুষ। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাব পড়লেও আশ্রয়কেন্দ্রে আসছে না এসব মানুষ। কিন্তু স্বেচ্ছাসেবকরা চালিয়ে যাচ্ছে মাইকিং ও সতর্কতামূলক প্রচারণা। তারপরও তাদের কথায় কান দিচ্ছে উপকূলের এসব মানুষ।
সমিতির পাড়ার বাসিন্দা মোস্তফা সরওয়ার বলেন, ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেত শুনে এখন যদি আমরা শহরের উঁচু স্থানে চলে যায় তাহলে এখানে যে আমাদের সহায় সম্বল আছে সেগুলো নিরাপত্তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। এখানে থাকা সহায় সম্বলগুলো চুরি-ছিনতাই হয়ে যাবে।
চরপাড়ার শুক্কুর বলেন, ছোট বেলা থেকে ৮, ৯ ও ১০ সংকেত নিয়ে আমরা যুদ্ধ করছি। সুতরাং পরিস্থিতি এবং সংকেত আরও বাড়লে তারপর নিরাপদ আশ্রয় চলে যাব।
কুতুবদিয়ার পাড়ার সিরাজুল ইসলাম বলেন, একদিনে করোনা প্রভাব অন্যদিকে ঘূর্ণিঝড় আম্পান দুটি ভয়াবহ। কিন্তু তারপরও মনে হচ্ছে এই ঘূর্ণিঝড়ে কিছুই হবে না।
সময়ের সাথে সাথে ভয়াবহ হয়ে উঠছে ঘূর্ণিঝড় আম্পান। তারপরও লোকজন নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার কোন আগ্রহ নেই বলে জানালেন সিপিপির ১১ নং ইউনিয়নের টিম লিডার সিকাদার আবু জাফর।
তিনি বলেন, ৬ নং বিপদ সংকেত দেয়ার পর থেকে কক্সবাজার শহরের উপকূলীয় এলাকায় মাইকিং করছি। সাথে সাথে প্রতিটি ঘরে ঘরে গিয়ে মানুষকে বুঝানো চেষ্টা করছি ঘূর্ণিঝড় আম্পান বিষয়টি। কিন্তু তারপরও তারা আমাদের কথা শুনছেন না। বরং কেউ কেউ ঝগড়া শুরু করে দিয়েছেন। তারপরও আমরা প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, ইতোমধ্যে উপকূলের ১৮ হাজার মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে আনা হয়েছে। তাদেরকে করোনার কারণে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সব ব্যবস্থা করা হয়েছে। খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তাও দেয়া হচ্ছে। এখন যারা আসবে না তাদেরকে জোর করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে আসা হবে।
কক্সবাজারের ৮টি উপজেলায় ৫৭৬টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এর পাশাপাশি ২২১টি স্কুল-কলেজকেও আশ্রয় কেন্দ্র ঘোষণা করা হয়েছে।