ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে করোনা

এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন সারাদেশ স্বাস্থ্য

*নতুন আক্রান্ত ২৬৯৫, মৃত্যু ৭৪৬
*হোমিও ওষুধে সুফল মিলছে

 

মহসীন আহমেদ স্বপন : করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বিশ্বব্যাপী ভয়াবহভাবে বাড়তে থাকলেও অর্থনীতি সচল রাখতে লকডাউন শিথিল করতে শুরু করেছে বিভিন্ন দেশ। এ মুহূর্তে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ হলেও দেশের মানুষের স্বার্থে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারকে গুরুত্ব দিচ্ছে দেশ। চাকরি সন্ধানী তরুণ জনগোষ্ঠী নিয়ে বিপাকে পড়ছে ফ্রান্স সরকার। লকডাউন শিথিল করলেও ভারতে বাড়ছেই করোনা পজিটিভ রোগীর সংখ্যা। এরমধ্যে ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থা মুডিস পূর্বাভাস দিয়েছে, চলতি বছর এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির এ দেশের ঋণের বোঝা বাড়বে, কমবে প্রবৃদ্ধি।
প্রায় একই পূর্বাভাস আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের। অর্থনীতিতে ধ্বস ঠেকাতে তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে খুলেছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
মোদি সরকার বলছে, এ মুহূর্তে করোনা পরিস্থিতি গুরুতর হলেও দেশের সাধারণ মানুষের কথা ভেবে অর্থনীতিকে প্রাধান্য দিতেই শিথিল করা হয়েছে লকডাউন। এদিকে কাগজের নোট থেকে করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে আগামী বছরই ভার্চুয়াল মুদ্রার দিকে যাচ্ছে চীন। যা স্থান দখল করবে বিটকয়েন আর ডলারের।
এরমধ্য দিয়ে চীনে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক আধ্যিপত্য কমবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। পাশাপাশি ওয়াশিংটনের হস্তক্ষেপ ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আছে এমন দেশগুলোর সাথে বাণিজ্য পরিচালনা করতে পারবে চীন। স্মার্টফোন নম্বর এবং একটি অ্যাপের মাধ্যমে ডিজিটাল ইউয়ান ব্যবহার করতে হবে।
এদিকে করোনা সংকটে যাত্রীবাহী বিমান চলাচল বন্ধ থাকায় এয়ারবাস আর বোয়িংকে বিমানের সরবরাহ স্থগিত করার আবেদন জানিয়েছে কাতার এয়ারওয়েজ। তা মানতে নারাজ দুই বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। বিশ্বের শীর্ষ দুই বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের কাছে শত কোটি ডলারের বিমানের অর্ডার আছে কাতার এয়ারওয়েজের। মহামারীর কারণে বেশিরভাগ বিমানই এখন অলস পড়ে আছে।
আগামী সময়টা দেশের তরুণ জনগোষ্ঠীর জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং হিসেবে দেখছে ফ্রান্স সরকার। অনেক তরুণ এ সময়টায় পড়াশোনা শেষ করে চাকরির খোঁজ করবেন। এক্ষেত্রে ফ্রান্স সরকার বলছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশিক্ষণমূলক শিক্ষা কার্যক্রম আরও বাড়ানো উচিত। করোনা মহামারির কারণে চলতি বছর দেশটির অর্থনীতি ১১ শতাংশ পর্যন্ত সংকুচিত হতে পারে। ধীরে ধীরে বিভিন্ন স্থান থেকে লকডাউন তুলে নিচ্ছে দেশটির সরকার।
এ দিকে বিশ্বব্যাপী মহামারি রূপ নেয়া করোনাভাইরাসে প্রতিদিনই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। বাংলাদেশেও প্রতিদিনই আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যায় রেকর্ড ভাঙছে। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে আরও ২ হাজার ৬৯৫ জন করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এ নিয়ে দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল সংখ্যা ৫৫ হাজার ১৪০ জন। এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৩৭ জনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মোট মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ৭৪৬ জনে।
দুই মাসের বেশি চলা সাধারণ ছুটির পর চতুর্থ কর্মদিবসে বুধবার দুপুরে করোনা ভাইরাস নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত অনলাইন বুলেটিনে এ তথ্য জানান সংস্থাটির অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা।
তিনি জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা শনাক্তে ১৫ হাজার ১০৩টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে ৫০টি ল্যাবে পরীক্ষা করা হয় ১২ হাজার ৫১০টি নমুনা। এ নিয়ে দেশে মোট নমুনা পরীক্ষা করা হলো ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৫৮৩টি। নতুন নমুনা পরীক্ষায় আরও ২ হাজার ৬৯৫ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে দেশে মোট আক্রান্ত হয়েছেন ৫৫ হাজার ১৪০ জন। আক্রান্তদের মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৩৭ জনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মোট মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ৭৪৬ জনে।
নাসিমা সুলতানা আরও জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৪৭০ জন সুস্থ হয়েছেন। এ নিয়ে মোট সুস্থ হয়েছেন ১১ হাজার ৫৯০ জন।
এর আগে সাধারণ ছুটি শেষে রোববার (৩১ মে) প্রথম কর্মদিবসে সর্বোচ্চ আক্রান্ত ও মৃত্যুর খবর দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সাধারণ ছুটি শেষে অফিস খোলার তৃতীয় দিন মঙ্গলবার আরও ২ হাজার ৯১১ জন করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হন। এছাড়া আরও ৩৭ জনের মৃত্যু হয়।
ডিসেম্বরে প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকে বেশিরভাগ দেশই ভাইরাসটিতে তেমন পাত্তা দেয়নি। অনেক দেশই ধারণা করেছিল, এটি চীনা ভাইরাস এবং এর সংক্রমণ হয়তো ইউরোপ-আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়বে না। এজন্য সেখানকার দেশগুলো তেমন কোনো পদক্ষেপও নেয়নি। ফলও দিতে হচ্ছে তাদের। কারণ সংক্রমণ সংখ্যার দিক থেকে প্রথম দেশগুলোর তালিকার মাঝেই নেই চীন।
বাংলাদেশে গত ৮ মার্চ প্রথম করোনা ভাইরাসের রোগী শনাক্ত হলেও প্রথম মৃত্যুর খবর আসে ১৮ মার্চ। দিন দিন করোনা রোগী শনাক্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ায় নড়েচড়ে বসে সরকার। ভাইরাসটি যেন ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্য ২৬ মার্চ থেকে বন্ধ ঘোষণা করা হয় সব সরকারি-বেসরকারি অফিস। কয়েক দফা বাড়ানো হয় সেই ছুটি। এ ছুটি আরেক দফা বাড়িয়ে ৩০ মে পর্যন্ত করা হয়।
ছুটি শেষে করোনার বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যেই ৩১ মে থেকে দেশের সরকারি-বেসরকারি অফিস খুলে দেয়া হয়। তবে বন্ধ রাখা হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
এদিকে বুধবাবার সকাল ৯টা পর্যন্ত করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের সংখ্যা ও প্রাণহানির পরিসংখ্যান রাখা ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্যানুযায়ী বিশ্বে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৩ লাখ ৮২ হাজার ৪১২ জন। এছাড়া এ ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে ৬৪ লাখ ৮৫ হাজার ৫৭১ জনের শরীরে।
আক্রান্তদের মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৩০ লাখ ২৩ হাজার ৬৩৮ জন। বর্তমানে চিকিৎসাধীন ৩০ লাখ ৭৯ হাজার ৫২১ জন। এদের মধ্যে ৩০ লাখ ২৪ হাজার ৯৯৩ জনের শরীরে মৃদু সংক্রমণ থাকলেও ৫৪ হাজার ৫২৮ জনের অবস্থা গুরুতর।
হোমিও ওষুধে সুফল মিলছে : বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের স্বীকৃত কোনো ওষুধের সন্ধান এখনও মিলেনি। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসটি থেকে রক্ষা পেতে টিকা ও কার্যকরী ওষুধ আবিষ্কারের চেষ্টা চলছে বিশ্বজুড়ে। এর মধ্যে প্রাচীন হোমিও পদ্ধতি করোনার চিকিৎসায় কার্যকরী ভূমিকা রাখছে বলে আলোচিত হচ্ছে।
করোনা পরিস্থিতিতে সম্মুখ সমরে থাকা পুলিশ বাহিনীর পাঁচ হাজারের বেশি সদস্য ইতিমধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের মূল চিকিৎসা চলছে এলোপ্যাথিক পদ্ধতিতে। তবে এর বাইরে পুলিশের অনেক সদস্য আগ্রহী হয়ে উঠেছেন হোমিও চিকিৎসায়। ইতিমধ্যে একজন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক অনানুষ্ঠানিকভাবে জড়িত হয়েছেন কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে। হাসপাতালের আউটডোরে তিনি একটি ডিসপেনসারিও দিয়েছেন। তার চিকিৎসায় করোনায় আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের অনেকেই সুফল পাচ্ছেন বলে জানা গেছে।
হোমিও চিকিৎসক রাশিদুল হক সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদনে গত ১৬ মে থেকে পুলিশ হাসপাতালের সঙ্গে জড়িত হয়েছেন। তিনি বলেছেন, তিনি করোনার কোনো চিকিৎসা করছেন না, তবে প্রতিরোধমূলক ওষুধ দিচ্ছেন যা কার্যকর হচ্ছে বলে দাবি করছেন তিনি।
রাশিদুল হক বলেন, আমি এক হাজারের বেশি পুলিশ সদস্যকে প্রতিরোধমূলক ওষুধ দিয়েছি। তাদের কেউ এখনো করোনা পজিটিভ হননি। আর ৫০ জন কোভিড-১৯ রোগীকে ওষুধ দিয়েছি যা সেবন করে এসব রোগী তুলনামূলক দ্রুততম সময়ে সুস্থ হয়েছেন।
রাশিদুল বলছেন, তিনি যে ওষুধ দিচ্ছেন তা প্রতিরোধমূলক এবং এটি নিয়ম মতো সেবন করলে দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আরও সক্রিয় হয়ে উঠে এবং মানুষের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়।
ইতিমধ্যেই পুলিশ হাসপাতাল ছাড়াও স্বরাষ্ট্রসহ কয়েকটি মন্ত্রণালয়েও তিনি চাহিদা পেয়ে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ সরবরাহের দাবি করেছেন। তিনি বলেন, করোনার কোনো নির্ধারিত চিকিৎসা নেই। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকল অনুযায়ী বাংলাদেশে এর চিকিৎসা হচ্ছে এবং অনেকেই সুস্থ হয়ে উঠছেন।
রাশিদুল বলেন, হোমিওপ্যাথিক ঔষধ রোগীরা প্রচলিত এলোপ্যাথিক চিকিৎসার পাশাপাশি নিতে পারছেন এবং এর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। যারা আগ্রহী হন তাদেরকেই আমি ওষুধ দিচ্ছি এবং অনেকেই জানিয়েছেন তারা উপকার পেয়েছেন।
হোমিও চিকিৎসক বলেন, করোনার যেসব লক্ষণ অর্থাৎ জ্বর, গলা ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, কাশি-এসবের চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথি বাংলাদেশে অনেক আগে থেকেই বেশ জনপ্রিয়। এখন করোনায় আক্রান্তদের ক্ষেত্রেও এসব উপসর্গের যেটি বেশি সেটিকে ধরে আমরা ওষুধ দিচ্ছি। তাতে অনেকে উপকার পাচ্ছে। আর যারা আক্রান্ত হননি তাদের জন্য প্রতিরোধমূলক পথ্য দেয়া হচ্ছে।’ হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় খরচ খুবই কম হওয়ায় রোগীরা সহজেই তা নিতে পারছেন বলে জানান তিনি।
তবে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম শান্ত বলছেন, পুলিশ হাসপাতালে কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার জন্য তারা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রটোকল ও গাইডলাইন অনুসরণ করছেন।
তিনি বলেন, হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার সাহেব নন কোভিড জোনে বসছেন। তবে কোভিড-১৯ রোগীদের কাছে তার যাওয়ার সুযোগ নেই। তাই করোনায় আক্রান্তরা তার ওষুধে কেউ সেরে উঠেছেন এটা বলা যাবে না। আর কেউ যদি নিজ উদ্যোগে তার ওষুধ নিয়েও থাকেন তাহলে তাতে তিনি কী ফল পেয়েছেন তাও আমরা জানি না।
তবে আনুষ্ঠানিকভাবে কর্মকর্তাদের কাছ থেকে এমন বক্তব্য এলেও পুলিশ হাসপাতালেরই কয়েকজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন হোমিওপ্যাথিক ওষুধ বিভিন্নভাবে রোগীদের চাহিদা অনুযায়ী তাদের কাছে পাঠানো হচ্ছে।


বিজ্ঞাপন