নাজুক অবস্থা

এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন সারাদেশ স্বাস্থ্য

*কঠোর লকডাউনের পরামর্শ
*বাড়ছে আক্রান্ত-মৃতের সংখ্যা

 

মহসীন আহমেদ স্বপন : দেশে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণ যেভাবে বাড়ছে তা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে ব্যাপক প্রাণহানির পাশাপাশি অর্থনীতিরও ক্ষতি হবে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, করোনা সংক্রমণ রোধে দেশে সাধারণ ছুটি দিয়ে লাভ নেই, এখন প্রয়োজন দুই থেকে তিন সপ্তাহের কঠোর লকডাউন বা কারফিউ। বৃহস্পতিবার ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ‘রিসার্জেন্ট বাংলাদেশ: রোডম্যাপ টু রিকভারি’ শিরোনামে এক সংলাপের আয়োজন করা হয়। সেখানে অংশ নিয়েছিলেন উন্নয়ন গবেষক আহসান এইচ মনসুর, এমসিসিআই সভাপতি ব্যারিস্টার নিহাদ কবির, ডিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, সাবেক মুখ্য সচিব আব্দুল করিম ও সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমানসহ আরও কয়েকজন অংশগ্রহণ করেন। এতে শ্রীলঙ্কায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত রিয়াজ হামিদুল্লাহও অংশ নেন।
ওই আলোচনায় বক্তরা এই বিষয়ে একমত হন যে, আমাদের দেশে এই মুহূর্তে করোনা সংক্রমণ রোধ করাটা সবচেয়ে বেশি জরুরি। তাই দেশের সকল নাগরিকের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পরই অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। এজন্য ১৫-২০ দিনের একটি কড়া লকডাউনের দাবি জানান বক্তারা।
এ নিয়ে রাজধানীর স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের প্রায় সবাই কড়া লকডাউন বা আক্রান্ত এলাকায় কারফিউ আরোপের পরামর্শ দিয়েছেন।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অর্থনীত সচল করার স্বার্থে সবকিছু খুলে দেয়ার কারণে দেশে আক্রান্তের সংখ্যা আরো বাড়বে। এতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর তৈরি হবে বাড়তি চাপ। তাই তারা মহামারি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে আরো কঠোর লকডাউন এবং অধিক সংক্রমিত এলাকায় কারফিউ দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
এ নিয়ে শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে করোনা পরিস্থিতি নিয়ে আমরা হিমশিম খাচ্ছি। বাংলাদেশের একটা জেনারেল কন্ডিশন হলো, ভাইরাসটা আগে আগে যাচ্ছে বাংলাদেশে পিছে পিছে। এতে আমাদের ভুগতে হবে। অনেক মানুষ সংক্রমিত হয়ে যাবে। মানুষ সংক্রমিত হয়ে গেলে তাদের হাসপাতালের বেড বাড়াতে হবে, সুবিধা বাড়াতে হবে। সেদিক থেকেও আমরা খুব বেশি অগ্রগতি সাধিত করতে পারি নাই।
প্রসঙ্গত, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেয়া তথ্যমতে বাংলাদেশে কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য এখন পর্যন্ত ১১২টি হাসপাতালে বেড রয়েছে ১৩ হাজার ৯৮৪টি। আর সারাদেশের কোভিড রোগীদের জন্য বরাদ্দ আছে সব মিলিয়ে ৪০০টি আইসিইউ বেড, ৩০০টি ভেন্টিলেটর আর ১১২টি ডায়ালাইসিস ইউনিট।
একই কথা বলছেন একটি বেসরকারি হাসপাতালের কর্ণধার এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী।
তিনি মনে করেন, করোনা ঠেকাতে যখন আরো কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজন তখন সবকিছু খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত মহামারি পরিস্থিতি আরো জটিল করবে।
তার ভাষায়, এর মধ্যেই করোনা চিকিৎসা করতে গিয়ে বাংলাদেশ একটি নাজুক অবস্থায় পড়ে গিয়েছে। আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি ঢাকাতে একটি আইসিইউ বেড পাওয়ার জন্য করোনা রোগীর আত্মীয় স্বজনেরা পাগলের মতো ছোটাছুটি করছে, কিন্তু পাচ্ছে না। তার মানে হচ্ছে যে, যখন এই সংক্রমণ বেড়ে যাবে। আমাদের এই নাজুক স্বাস্থ্য এবং চিকিৎসা ব্যবস্থাটি এই চ্যালেঞ্জটা বহন করতে পারবে কিনা এটি নিয়ে আমি প্রবলভাবে সন্দিহান।
বাংলাদেশের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট আইইডিসিআর জানাচ্ছে, সবকিছু খুলে দেয়ার ফলে সংক্রমণ বাড়বে। তবে জুনের মাঝামাঝি থেকে সংক্রমণ কমতে শুরু করতে পারে।
ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে সারাদেশের আক্রান্ত এলাকায় লাল, হলুদ ও সবুজ অঞ্চলে ভাগ করার যে পরিকল্পনা জানানো হয়েছে সেখানে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানার সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।
এ নিয়ে আইইডিসিআর এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর বলেন, ঢাকা এবং সারাদেশের জেলা উপজেলা পর্যায়ে এটা করতে হবে। আমরা এলাকা অনুযায়ী ছোট ছোট জায়গায় সম্পূর্ণ লকডাউন, সেটা বাড়ি থেকে বের হওয়া, দোকান-পাট অফিস আদালত সবকিছু বন্ধ রেখেই এ কাজটা করতে চাচ্ছি।
এদিকে অঘোষিত লকডাউন তুলে দেয়ার পর পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে কিছু এলাকায় কারফিউ দিতে হবে বলে মনে করেন অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, সরকারকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে, হয়তো কোনো কোনো জায়গায় কারফিউ দিতে হবে।
তবে আইইডিসিআর’র প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর মনে করেন, কারফিউ না দিয়েও পরিস্থিতি মোকাবেলা করা যায়। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে শিবচর। করোনা মহামারির শুরুর দিকে ওই জেলায় কঠোর লকডাউন দিয়ে সফলতা এসেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেও প্রতি মিলিয়নে সবচেয়ে কম পরীক্ষা করছে বাংলাদেশ। তাই আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা আরো অনেক বেশি বলেই আশঙ্কা স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সবধরনের গণপরিবহন চালু এবং অফিস আদালত, দোকানপাট খুলে দেয়ার কারণে সংক্রমণ কতটা বৃদ্ধি পায় সেটি বোঝা যাবে আগামী ৭-১০ দিনের মধ্যেই।
এ দিকে বিশ্বব্যাপী মহামারি রূপ নেয়া করোনাভাইরাসে প্রতিদিনই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। বাংলাদেশেও প্রতিদিনই আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যায় রেকর্ড ভাঙছে। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে আরও ২ হাজার ৮২৮ জন করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এ নিয়ে দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ৬০ হাজার ৩৯১ জন। এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৩০ জনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মোট মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ৮১১ জনে।
শুক্রবার দুপুরে করোনা ভাইরাস নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত অনলাইন বুলেটিনে এ তথ্য জানান সংস্থাটির অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা।
তিনি জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা শনাক্তে ১৪ হাজার ৬৪৫টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে ৫০টি ল্যাবে পরীক্ষা করা হয় ১৪ হাজার ৮৮টি নমুনা। এ নিয়ে দেশে মোট নমুনা পরীক্ষা করা হলো ৩ লাখ ৭২ হাজার ৩৬৫টি। নতুন নমুনা পরীক্ষায় আরও ২ হাজার ৮২৮ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে দেশে মোট আক্রান্ত হয়েছেন ৬০ হাজার ৩৯১ জন। আক্রান্তদের মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৩০ জনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মোট মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ৮১১ জনে।
তিনি সবাইকে স্বাস্থ্য পরামর্শ মেনে ঘরে থাকার আহ্বান জানান। পাশাপাশি তিনি পুষ্টিকর খাবার গ্রহণেরও পরামর্শ দেন। একই সাথে যারা করোনার এই মহামারিতে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন তাদের ধন্যবাদ দেন নাসিমা।
প্রত্যেককে মাস্ক ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে নাসিমা সুলতানা বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে মাস্ক একটি বড় হাতিয়ার। তাই সবার এখন মাস্ক ব্যবহার করা উচিত। বয়স্ক ব্যক্তিদের কাছে যাওয়ার আগে মাস্ক ব্যবহার করা উচিত বলেও পরামর্শ দেন তিনি।
৫০টি ল্যাবরেটরিতে নমুনা পরীক্ষার তথ্য তুলে ধরে তিনি জানান, করোনাভাইরাস শনাক্তে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ১৪ হাজার ৬৪৫টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। পরীক্ষা করা হয় ১৪ হাজার ৮৮টি নমুনা। এ নিয়ে দেশে মোট নমুনা পরীক্ষা করা হলো তিন লাখ ৭২ হাজার ৩৬৫টি। নতুন নমুনা পরীক্ষায় করোনায় আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন আরও দুই হাজার ৮২৮ জন। ফলে দেশে মোট আক্রান্ত হয়েছেন ৬০ হাজার ৩৯১ জন। আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে আরও ৩০ জনের। ফলে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ৮১১ জনে। গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন আরও ৬৪৩ জন। এ নিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠা রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল ১২ হাজার ৮০৪ জনে। দেশে ভাইরাসটিতে শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ২১ দশমিক ২০ শতাংশ, শনাক্ত বিবেচনায় মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
মৃত ৩০ জনের মধ্যে ২৩ পুরুষ এবং ৭ জন নারী। তাদের মধ্যে ৩১ থেকে ৪০ বছরের তিনজন, ৪১ থেকে ৫০ বছরের ৭ জন, ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে ১১ জন, ৬১ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে ছয়জন, ৭১ থেকে ৮০ বছরের দুজন এবং আশি ঊর্ধ্ব একজন।
এদের মধ্যে ঢাকা বিভাগের রয়েছেন ১১ জন, চট্টগ্রামের বিভাগের ১২ জন, সিলেটে তিনজন, রাজশাহী দুজন, বরিশাল এবং রংপুর বিভাগে একজন করে মারা গেছেন। এদের মধ্যে হাসপাতালে মারা গেছেন ১৭ জন এবং আর বাড়িতে মারা গেছেন ১৩ জন।
এর আগে সাধারণ ছুটি শেষে অফিস শুরুর প্রথম সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস বৃহস্পতিবার দেশে আরও ২ হাজার ৪২৩ জনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। এছাড়া ওইদিন ৩৫ জনের মারা যাওয়ার কথা জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
তার আগে মার্চ থেকে দেশে শুরু হওয়া সাধারণ ছুটি শেষ হয় গেল শনিবার। রোববার (৩১ মে) থেকে শুরু হয় কর্মদিবস। সাধারণ ছুটি চলাকালীনই দেশে স্বাস্থ্যবিধি না মানার বিষয়টি বারবার আলোচনায় আসছিল। আর কর্মদিবস শুরুর পর থেকে সেই নির্দেশনা চরমভাবে লঙ্ঘনের বিষয়টি সামনে আসছে।
আর এই সময়ের মধ্যে করোনা শনাক্তও হচ্ছে আগের চাইতে তুলনামূলক বেশি মানুষের শরীরে। সাধারণ মানুষ যদি সরকারের নির্দেশনা অমান্য করেন তবে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলেও বারবার হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলছে। এখন পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৯৩ হাজার ১৪২ জন। এছাড়া এ ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে ৬৬ লাখ ৯৮ হাজার ৩৭০ জনের শরীরে। আক্রান্তদের মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৩২ লাখ ৪৪ হাজার ৫৭৪ জন। বর্তমানে চিকিৎসাধীন ৩০ লাখ ৬০ হাজার ৬৫৪ জন। এদের মধ্যে ৩০ লাখ ৫ হাজার ১৯৪ জনের শরীরে মৃদু সংক্রমণ থাকলেও ৫৫ হাজার ৪৬০ জনের অবস্থা গুরুতর।
গত বছরের ডিসেম্বরে চীন থেকে এই মহামারি শুরু হলেও ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি তা-ব চালিয়েছে করোনাভাইরাস। এখন এর কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে রাশিয়া, ব্রাজিল ও ব্রিটেন। এর মধ্যে বৃস্পতিবার শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রেই প্রাণ হারিয়েছেন আটশোর বেশি মানুষ। ব্রাজিলেও হু হু করে বাড়ছে করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। শেষ ২৪ ঘণ্টায় দেশটিতে ১৪৯২ জনের মৃত্যু হয়েছে আর আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ৩১ হাজারের বেশি।
এদিকে বৃহস্পতিবারই রাশিয়ায় ১৬৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৮ হাজার ৮শ’। এছাড়া যুক্তরাজ্যে করোনায় একদিনে প্রাণ হারিয়েছেন ১৭৬ জন। আর নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ১৮০৫ জন।


বিজ্ঞাপন