বিশেষ প্রতিবেদক : একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং নতুন মন্ত্রী সভা গঠনের মাধ্যমে দেশবাসিকে চমক দেখিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একইভাবে প্রয়াত সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান মোল্লার মৃতুতে শূন্য হওয়া ঢাকা-৫ উপনির্বাচনে দক্ষ, উচ্চ শিক্ষিত-সৎ ও মেধাবী ক্লীন ইমেজের প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়ে চমক দেখাবেন দলীয়প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে এই চমকের জন্য আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে এই আসনের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের। যদিও অনেকে বলছেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পুত্রবধু শহীদ সুলতানা কামালের ভাতিজি, আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য নেহরীন মোস্তফা দিশি।
আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা-৫ আসনে দলের মনোনয়ন পেতে আওয়ামী লীগ ও শরিক দল এবং বিএনপি জোটের অন্তত ডজন প্রার্থী ইতিমধ্যে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। প্রতিদিন সকাল-বিকাল কিংবা গভীর রাত পর্যন্ত হাইকমান্ড এবং কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের বাসা-অফিসে মনোনয়ন পেতে তদবির শুরু করেছেন। দেখা করতে কিংবা নেতাদের মন জয়ে এহেনকাজ নেই যা তারা করছেন না। সঙ্গে নিচ্ছেন আম-জাম,কাঠাল ও লিচুসহ সিজনাল নানা ধরনের ফল। কিন্তু নেতাদের সাফকথা এবার ঢাকা-৫ আসনে সিদ্ধান্ত নেবেন দলীয়প্রধান শেখ হাসিনা। সেক্ষেত্রে নেত্রীর সিদ্ধান্তকেই স্বাগত ও সমর্থন জানাবেন কেন্দ্রীয় নেতারা। তবে কেন্দ্র যে সিদ্ধান্তই দেন না কেন,নিজেদের শক্তি ও সমর্থন জানান দিতে এরইমধ্যে নিজ নিজ দলের মনোনয়ন পেতে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়ে মাঠে নেমেছেন সম্ভাব্য মনোনয়ন প্রত্যাশীরা। একইসাথে পাড়া-মহল্লায় তাদের পোস্টার ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে হাট-ঘাট ও মাঠ। তবে কেন্দ্র কিংবা দলীয়প্রধান শেখ হাসিনা যে সিদ্ধান্তই দিবেন একবাক্যে মেনে নিবেন ঢাকা-৫ আসনের সম্ভাব্য মনোনয়নপ্রত্যাশীরা।
এদিকে ঢাকা-৫ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের আমলনামা এরইমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার টেবিলে রয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে। এছাড়াও এই আসনটিতে প্রত্যেক মনোনয়নপ্রত্যাশীর আমলনামা বেশ কয়েকটি সংস্থা যাচাই-বাছাই করছে। ঢাকা-৫ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে যাদের নাম শোনা যাচ্ছে তারা হলেন, প্রয়াত হাবিবুর রহমান মোল্লার বড় ছেলে ডেমরা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান সজল, আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য ও শহীদ শেখ কামালের স্ত্রী শহীদ সুলতানা কামালের ভাতিজি নেহরীন মোস্তফা দিশি, যাত্রাবাড়ী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি কাজী মনিরুল ইসলাম মনু ও যাত্রাবাড়ী থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদ মুন্না, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি কামরুল হাসান রিপনসহ অন্তত এক ডজন প্রার্থী। জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পাটির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও মাতুয়াইলের সন্তান মীর আব্দুস সবুর আসুদ, ১৪ দলের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এর কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি মো. শহীদুল ইসলাম আলোচনায় রয়েছেন। তৃনমূল ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, ঢাকা-৫ আসনের দলীয় গ্রুপিং আছে। এই গ্রুপিং এর কারণে মোল্লা পরিবার থেকে কাউকে মনোনয়ন না দিলে ঐক্যের প্রতীক হিসেবে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা আবু আহমেদ মন্নাফী ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদকে প্রার্থী করা হতে পারে। তবে এসব কেবল দলীয় নেতাকর্মীদের ধারণা। সবকিছু নির্ভর করছে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপর।
আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য ও শহীদ শেখ কামালের স্ত্রী শহীদ সুলতানা কামালের ভাতিজি নেহরীন মোস্তফা দিশি নির্বাচনে প্রার্থী হবেন এবং তাকেই দলীয় ভাবে মনোনয়ন দেবে এমন প্রত্যাশাও রয়েছে ঢাকা-৫ এর জনগণের মাঝে। তাছাড়া পারিবারিক ঐতিহ্য, রাজনৈতিক অবস্থান ও আপদে-বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কারণে দল থেকে এই আসনে তাকে মনোনয়ন দেওয়া হবে এমনটি প্রত্যাশা নেহরীন মোস্তফা দিশি। শেখ পরিবারের এই সদস্য বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশে উন্নয়নের ধারায় এগিয়ে যাচ্ছে। ওই উন্নয়ন কাজের সাথে নিজেকে সম্পৃত্ত করতে পারলে আমি নিজে কে ধন্য মনে করবো। এই এলাকার উন্নয়নে ঐহিত্যগতভাবে আমার দাদা মরহুম দবির উদ্দিন আহমেদ মৃধা ২৫ বছর বৃহত্তর মাতুয়াইল ইউনিয়নের নেতৃত্ব দিয়েছেন সফলতার সাথে, যা ঐতিহ্যবাহী মাতুয়াইলে ইতিহাস হয়ে আছে এবং এ অঞ্চলের আপামর জনসাধারনের অন্তরে গেঁথে আছে। আমার বড় চাচা রফিক মৃধা ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের কোষাধক্ষ্য ছিলেন। পুরো ঢাকা-৫ নির্বাচনী এলাকায় তিনি ছিলেন বটবৃক্ষের মতো। তিনি বলেন, ওই এলাকার সাধারণ মানুষ আমাদের পরিবার থেকে যে সহযোগীতা পেয়েছে তা বিফলে যাবে না। তবে এই আসনে নেতৃত্বের পরিবর্তন চাইছেন অনেকেই। সেক্ষত্রে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দীর্ঘ দিনের পরীক্ষিত সৈনিক যাত্রাবাড়ী থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদ মুন্না। প্রয়াত সাংসদ হাবিবুর রহমান মোল্লার সাথে দীর্ঘদিন রাজনীতি করা এ নেতা বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে অসংখ্যবার নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। রাজপথের কর্মসূচিতেও সর্বদাই সরব ছিলেন। বিরোধী দলে থাকাকালীন সময় যাত্রাবাড়ী এলাকায় দলকে সংগঠিত রেখে হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি নিজে উপস্থিত থেকে বাস্তবায়ন করেছেন। তাই এবার উপ-নির্বাচনে ঢাকা-৫ আসনের প্রার্থী দেওয়ার ক্ষেত্রে তাকে মূল্যায়ন করা হবে বলে আশাবাদী হারুনুর রশিদ মুন্না। তবে যাত্রাবাড়ি থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি কাজী মনিরুল ইসলাম মনু’র সমর্থকদের দাবি, এবার ঢাকা-৫ আসনে নৌকার মনোনয়ন পাবেন কাজী মনিরুল ইসলাম মনু।
জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও জাতীয় যুব সংহতির সাবেক সভাপতি আব্দুস সবুর আসুদ। তিনি জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে জড়িত। তিনি ২০০৮ ও ২০১৪ সালে জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়ন চেয়েছিলেন। এবার উপনির্বাচনেও তিনি মনোনয়ন পাবেন বলে প্রত্যাশা করেন। জাতীয়র পার্টি বিরোধী দল হলেও মহাজোটগতভাবে তিনি মনোনয়ন পাবেন বলে প্রত্যাশা তার। মীর আব্দুস সবুর আসুদ বলেন, আমি দীর্ঘদিন যাবৎ জাতীয় পার্টির রাজনীতির সাথে জড়িত-আশা করি এই আসনটি মহাজোটকে ছেড়ে দেবে। জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে এলাকার মানুষের কল্যাণে কাজ করে যেতে চাই।
ঢাকা-৫ আসনে একাদশ জাতীয় সংসদ (গত নির্বাচনে) নির্বাচনে হাবিবুর রহমানের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিএনপির প্রার্থী নবীউল্লাহ নবী। এবারও বিএনপির প্রার্থী হিসেবে তাকেই বেছে নিচ্ছে রাজপথের বিরোধী দলটি। এরইমধ্যে এমন আভাস পাওয়া গেছে বিএনপির একাধিক সূত্রে। স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীরাও মনে করছেন হারানো আসনটি পুনরুদ্ধার করতে হলে নবীউল্লাহ নবী’র বিকল্প নেই। কারণ গত নির্বাচনে বিএনপির অনেক প্রার্থী রাজপথেই নামেননি। ফলাফলে অনেক হেভিওয়েট প্রার্থীর জামানত পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত হয়। অথচ তিনি প্রায় ৭০ হাজার ভোট পান। এই আসনে বিএনপি প্রার্থী নবীউল্লাহ নবী ছিলেন পুরোপুরি ব্যতিক্রম। তফসিল ঘোষণার পরপরই চষে বেড়িয়েছেন গোটা নির্বাচনী এলাকা। প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগও তার নির্বাচনী প্রচারণা দেখে কিছুটা অস্বস্তিতে ছিলেন। সব মিলিয়ে এবারের উপনির্বাচনে নবীউল্লাহ নবীই যে বিএনপির প্রার্থী হচ্ছেন তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। এ বিষয়ে কথা হয় বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী নবীউল্লাহ নবী সাথে। তিনি বলেন, দেশের এই মহামারীর সময় উপনির্বাচন কখন হবে কিংবা আমাদের দল অংশ নিবে কিনা তা এখনও ঠিক হয়নি। তবে দল যদি সিদ্ধান্ত নেয় আমি প্রস্তুত। আগেও আমি মাঠে ছিলাম, আছি এবং আগামীতেও থাকবো। তাছাড়া গত নির্বাচনের পর থেকেই মাঠে আছি। অত্র এলাকায় সাংগঠনিক কার্যক্রম আরো জোরদার করেছি। নিয়মিত সমন্বয়সভা করে চলেছি। করোনাকালীন এই সময়ে ডেমরা-যাত্রাবাড়ীর বিভিন্ন এলাকায় দুস্থদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করছি।
প্রসঙ্গত, সরকার দলীয় এমপি হাবিবুর রহমান মোল্লার মৃত্যুতে শূন্য হওয়া ঢাকা-৫ আসনের উপনির্বাচন নভেম্বরের মধ্যে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। ইসির সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর স্বাক্ষরিত কমিশনের একটি প্রজ্ঞাপন গত ২২ জুন জারি করা হয়েছে। এরআগে গত ১০ মে রোববার সংসদের সিনিয়র সচিব ড. জাফর আহমদ খান স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে ঢাকা-৫ সংসদীয় আসনটি শূন্য ঘোষণা করে সংসদ সচিবালয়। গত ৬ মে বার্ধক্যজনিত কারণে হাবিবুর রহমান মোল্লা মারা যান। ফলে ওইদিন আসনটি শূন্য হয়েছে বলে এরই মধ্যে গেজেট প্রকাশ করেছে জাতীয় সংসদ সচিবালয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ঢাকা-৫ আসনের উপনির্বাচন আগামী ৩ আগস্টের মধ্যে সম্পন্ন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু করোনার কারণে এ সময়ের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব হবে না। তাই পরবর্তী ৯০ দিন অর্থাৎ আগামী নভেম্বরের মধ্যে এ আসনের উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সংবিধান অনুযায়ী, কোনো আসন শূন্য হওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে ওই আসনের ভোটগ্রহণ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেই হিসেবে আগামী ৩ আগস্টের মধ্যে ভোট গ্রহণের কথা। কিন্তু করোনার কারণে সব নির্বাচন স্থগিত রেখেছে ইসি। এ ক্ষেত্রে দৈব-দুর্বিপাকজনিত কারণে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের হাতে সংরক্ষিত পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করবে সংস্থাটি।