মৃত্যুর সংখ্যা কমেছে, বেড়েছে শনাক্ত

এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন সারাদেশ স্বাস্থ্য

লকডাউনেই হবে সংক্রমণের গতিরোধ

 

নিজস্ব প্রতিবেদক : করোনাভাইরাসের সংক্রমণের হার যাতে না বাড়ে এবং আক্রান্ত রোগী যাতে নিয়ম মেনে সুস্থ হয়ে ওঠেন, সেজন্যই রেড জোন ঘোষণা করে লকডাউনের পথ বেছে নিয়েছে সরকার। একই সঙ্গে লকডাউনের আওতাভুক্ত এলাকায় বসবাসকারী জনসাধারণ যাতে কোনও হয়রানির স্বীকার না হন, সেজন্যই সরকার রেড জোন ঘোষিত এলাকায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে। লকডাউন হওয়া বিভিন্ন জেলার সিভিল সার্জন ও জেলা প্রশাসকরা আশা করছেন রেড জোনের মাধ্যমে কার্যকর করা এই লকডাউনে করোনার সংক্রমণ কমবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের নির্দেশনা অনুযায়ী দেশের যেসব এলাকায় একটি নির্দিষ্ট তারিখ থেকে গত ১৪ দিনে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রতি লাখে ১০ জন বা এর অধিক পাওয়া যাবে, সেসব এলাকাকে রেড জোনের আওতায় ফেলে সেখানে সংক্রমণ যাতে আর না বাড়ে সেজন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুমোদন নিয়ে লকডাউনের সুপারিশ করবেন সংশ্লিষ্ট জেলার সিভিল সার্জন। সিভিল সার্জনের পরামর্শক্রমে লকডাউন বাস্তবায়ন করবেন স্থানীয় জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন। জনপ্রতিনিধিদেরও একাজে সম্পৃক্ত থাকার কথা বলেছে সরকার। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী দেশের ১৫টি জেলার বিভিন্ন এলাকায় লকডাউন চলছে। এই জেলাগুলো হচ্ছে- চট্টগ্রাম, বগুড়া, চুয়াডাঙ্গা, মৌলভীবাজার, নারায়ণগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, কুমিল্লা, যশোর, মাদারীপুর, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী ও কুষ্টিয়া।
এসব জেলার কিছু কিছু এলাকায় কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রতি লাখে ১০ জন ছাড়িয়ে গেছে বিধায় রেড জোন ঘোষণা করে সেখানে ২১ দিনের জন্য লকডাউনের সুপারিশ করেছে জেলার সিভিল সার্জন। জেলার সিভিল সার্জনের সুপারিশের ভিত্তিতে লকডাউন কার্যকর করেছে স্থানীয় প্রশাসন।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. শেখ ফজলে রাব্বী জানিয়েছেন, জেলার একটি মাত্র এলাকায় লকডাউন চলছে। ১৭ জুন রেড জোন হিসেবে ঘোষণা করে ২১ দিনের জন্য লকডাউন শুরু হয়েছে। সেখানে ৮ জুলাই পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তিনি জানান, ১১০ জন রোগী নিয়ে এলাকাটি লকডাউন করা হয়েছে। গত ছয় দিনে নতুন করে আরও ছয় জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে। তিনি জানান, লকডাউনের পর সংক্রমণের এ হার নিম্নগতি বলে মনে হচ্ছে। যদিও চূড়ান্ত মূল্যায়ন করতে ২১ দিন অপেক্ষা করতে হবে। আশা করছি সংক্রমণের হার কমবে।
এদিকে বগুড়ার সিভিল সার্জন ডা. মো. গওসুল আজিম জানিয়েছেন, এ জেলার ৯টি এলাকায় লকডাউন চলছে। শুরুতে এই ৯ এলাকায় ২০০ জনের বেশি রোগী নিয়ে লকডাউন শুরু হয়েছে। আশা করছি ২১ দিনের মধ্যে আক্রান্ত রোগীরা সুস্থ হবেন। এতে সংক্রমণের হার ধীরে ধীরে কমে আসবে। একদিন অবশ্যই আমরা কোভিড শূন্য হবো।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিভিল সার্জন ডা. মোহম্মদ একরাম উল্লাহ জানিয়েছেন, জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনসহ সবাইকে নিয়ে লকডাউন শতভাগ কার্যকর করা হয়েছে। আশা করছি এভাবে পুরো ২১ দিন চলতে পারলে অবশ্যই সুফল পাবো। তবে চূড়ান্ত মূল্যায়নের জন্য ২১ দিন সময় দিতে হবে। লকডাউনের মধ্যখানে আত্মতৃপ্তি পাওয়ার সুযোগ নেই। তবে আমরা চাই না, নতুন করে কেউ সংক্রমিত হোক।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন জানিয়েছেন, জেলার একটি মাত্র এলাকায় লকডাউন চলছে। সেখানে সাধারণ ছুটিও ঘোষণা করা হয়েছে। এতে সেখানে যারা সরকারি বেসরকারি অফিসের স্টাফ রয়েছেন তারা অফিস নিয়ে কোনও ধরনের হয়রানির স্বীকার হচ্ছেন না। একই সঙ্গে ওই এলাকায় যে সকল সরকারি বেসরকারি অফিস রয়েছে, সেসব অফিসের স্টাফ যারা ওই এলাকার বাইরে রয়েছেন তারাও অফিস নিয়ে কোনও ধরনের নাজেহাল হচ্ছেন না। মূলত এ ধরনের হয়রানি বা নাজেহাল ঠেকাতেই রেড জোন ঘোষিত এলাকায় লকডাউন চলাকালীন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার।
তিনি জানান, শুধু তাই নয় লকডাউন করা এলাকায় বসবাসকারী সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন অত্যাবশ্যকীয় চাহিদা পূরণের জন্য সব ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। দিন আনে দিন খায় এমন খেটে খাওয়া মানুষের খাদ্য সরবরাহ করা হচ্ছে।
মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, লকডাউন চলাকালীন সংশ্লিষ্ট এলাকায় বসবাসকারী মানুষ যাতে কোনও ধরনের সমস্যা, হয়রানি বা নাজেহাল না হয় সেদিকে নজর রাখা হচ্ছে। আর সাধারণ ছুটি ঘোষণা করায় সে সম্ভাবনা একেবারেই নেই বলে জানান তিনি।
এদিকে দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৩৭ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯)। এ নিয়ে ভাইরাসটিতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল এক হাজার ৫৮২ জনে। একই সময়ে করোনায় আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন আরও তিন হাজার ৪৬২ জন। ফলে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল এক লাখ ২২ হাজার ৬৬০ জনে।
বুধবার দুপুরে স্বাস্থ্য অধিদফতরের করোনাভাইরাস বিষয়ক নিয়মিত হেলথ বুলেটিনে এ তথ্য জানানো হয়। অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা অনলাইনে বুলেটিন পড়েন।
তিনি নতুন যুক্ত একটিসহ ৬৬টি ল্যাবে নমুনা পরীক্ষার তথ্য তুলে ধরে বলেন, করোনাভাইরাস শনাক্তে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ১৭ হাজার ২৪৫টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। পরীক্ষা করা হয় ১৬ হাজার ৪৩৩টি। এ নিয়ে দেশে মোট নমুনা পরীক্ষা করা হলো ছয় লাখ ৬০ হাজার ৪৪৪টি। নতুন নমুনা পরীক্ষায় করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে আরও তিন হাজার ৪৬০ জনের মধ্যে। ফলে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল এক লাখ ২২ হাজার ৬৬০ জনে। আক্রান্তদের মধ্যে মারা গেছেন আরও ৩৭ জন। এ নিয়ে ভাইরাসটিতে মোট মারা গেলেন এক হাজার ৫৮২ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন আরও দুই হাজার ৩১ জন জন। সব মিলিয়ে মোট সুস্থ রোগীর সংখ্যা এখন ৪৯ হাজার ৬৬৬ জন।
গত ২৪ ঘণ্টায় যারা মারা গেছেন তাদের ৩৪ জন পুরুষ, তিনজন নারী। এদের মধ্যে ১১ থেকে ২০ বছরের একজন, ২১ থেকে ৩০ বছরের দুজন, ত্রিশোর্ধ্ব দুজন, চল্লিশোর্ধ্ব তিনজন, পঞ্চাশোর্ধ্ব ১২ জন, ষাটোর্ধ্ব নয়জন এবং সত্তরোর্ধ্ব আটজন রয়েছেন। ১০ জন ঢাকা বিভাগের, নয়জন চট্টগ্রাম বিভাগের, ছয়জন রাজশাহী বিভাগের, সাতজন খুলনা বিভাগের, তিনজন ময়মনসিংহ বিভাগের এবং একজন করে বরিশাল ও রংপুরে বিভাগের। ৩৪ জন মারা গেছেন হাসপাতালে এবং তিনজনের মৃত্যু হয়েছে বাসায়।
গত মঙ্গলবারের বুলেটিনে জানানো হয়, ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় ৪৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। ১৬ হাজার ২৯২টি নমুনা পরীক্ষায় করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে আরও তিন হাজার ৪১২ জনের মধ্যে। সে হিসাবে আগের ২৪ ঘণ্টার তুলনায় গত ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু কমলেও বেড়েছে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা। দেশে একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড আছে ৫৩ জনের। সে তথ্য জানানো হয় ১৬ জুনের বুলেটিনে। আর সর্বোচ্চ শনাক্তের রেকর্ড আছে চার হাজার আট জনের। এ তথ্য জানানো হয় ১৭ জুনের বুলেটিনে।
বুধবারের বুলেটিনে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষার তুলনায় রোগী শনাক্তের হার ২১ দশমিক ০৭ শতাংশ। এখন পর্যন্ত রোগী শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৪০ দশমিক ৪৯ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার ১ দশমিক ২৯ শতাংশ।
করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষিত থাকতে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানান ডা. নাসিমা সুলতানা।
এদিকে বিশ্বব্যাপী মহামারি করোনাভাইরাসে বিশ্বে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৪ লাখ ৮০ হাজার ছাড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক জরিপকারী সংস্থা ওয়ার্ল্ডোমিটার এ তথ্য জানিয়েছে।
সংস্থাটির তথ্যানুযায়ী, বিশ্বজুড়ে করোনায় এ পর্যন্ত মোট মৃতের সংখ্যা ৪ লাখ ৮০ হাজার ৯৫ জন। আক্রান্ত হয়েছেন ৯৩ লাখ ৬৯ হাজার ২২৭ জন। এছাড়া সুস্থ হয়ে উঠেছেন ৫০ লাখ ৬০ হাজার ৬০০ জন।
এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় সারাবিশ্বে করোনায় মৃত্যু হয়েছে ৫ হাজার ৪৬৫ জন। নতুন শনাক্ত হয়েছেন ১ লাখ ৬২ হাজার ৯৯৪ জন।
চীন থেকে ছড়িয়ে পড়া এই ভাইরাসটিতে এ পর্যন্ত বিশ্বের ২১৫টি দেশ ও অঞ্চল আক্রান্ত হয়েছে। আক্রান্ত ও মৃত্যু উভয় সংখ্যার দিক থেকেই বিশ্বে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে এখন পর্যন্ত ২৪ লাখ ২৪ হাজার ১৬৪ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১ লাখ ২৩ হাজার ৪৭০ জনের।
মৃতের হিসাবে তালিকার দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে ল্যাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিল। দেশটিতে করোনায় মোট মৃত্যু হয়েছে ৫২ হাজার ৭৭১ জনের। আর আক্রান্ত হয়েছেন ১১ লাখ ৫১ হাজার ৪৭৯ জন।
তৃতীয় স্থানে এবং ইউরোপের শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাজ্য। দেশটিতে করোনায় মৃতের সংখ্যা ৪২ হাজার ৯২৭ জন। মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৩ লাখ ৬ হাজার ২১০ জন।
এছাড়া ইতালিতে করোনায় মৃতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ৬৭৫ জনে দাঁড়িয়েছে। আর মোট আক্রান্ত হয়েছে ২ লাখ ৩৮ হাজার ৮৩৩ জন। ফ্রান্সে করোনায় ২৯ হাজার ৭২০ জনের মৃত্যু ও ১ লাখ ৬১ হাজার ২৬৭ জন আক্রান্ত হয়েছেন।
বাংলাদেশে গত ৮ মার্চ প্রথম করোনা ভাইরাসের রোগী শনাক্ত হলেও প্রথম মৃত্যুর খবর আসে ১৮ মার্চ। দিন দিন করোনা রোগী শনাক্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ায় নড়েচড়ে বসে সরকার। ভাইরাসটি যেন ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্য ২৬ মার্চ থেকে বন্ধ ঘোষণা করা হয় সব সরকারি-বেসরকারি অফিস। কয়েক দফা বাড়িয়ে এ ছুটি ৩০ মে পর্যন্ত করা হয়। ছুটি শেষে করোনার বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যেই ৩১ মে থেকে দেশের সরকারি-বেসরকারি অফিস খুলে দেয়া হয়। তবে বন্ধ রাখা হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।


বিজ্ঞাপন