রিমান্ডে আসামি স্বামী প্রভাবশালী স্ত্রীর প্রভাব

অপরাধ আইন ও আদালত

করোনার জাল সনদের ব্যবসা

 

নিজস্ব প্রতিবেদক : করোনাকে পুঁজি করে ডাক্তার স্ত্রীর প্রভাবেই মাদকাসক্ত স্বামী করোনার জাল সনদের ব্যবসা খুলেছিলেন। তার নাম আরিফুল ইসলাম চৌধুরী। আর স্ত্রী ডাক্তার সাবরিনা আরিফ চৌধুরী। করোনার মহামারির সময়ে জেকেজি হেলথকেয়ার নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান খুলে জাল সনদের ব্যবসা করতে গিয়ে ধরা খেয়েছেন। থানায় পুলিশ রিমান্ডে থেকেও আরিফু চৌধুরীর বিরুদ্ধে মাস্তানি করার অভিযোগ উঠেছে।
গত ২৩ জুন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে আরিফুল চৌধুর ও তার সহযোগিসহ ৫জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গ্রেফতারকৃত আরিফুল চৌধুরি জেকেজি হেলথকেয়ারের প্রধান নির্বাহী (সিইও) আর তার স্ত্রী ওই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হিসেবে পরিচয় দিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দাপট খাটাতেন।
জানা গেছে, আরিফুল হক চৌধুরীসহ পাঁচজনকে তেজগাঁও থানা পুলিশের গ্রেফতারের পর প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম কর্ণধার হিসেবে আরিফুল চৌধুরীর স্ত্রী ডা. সাবরিনা আরিফের নাম প্রকাশ পায়। কিন্তু এখন তিনি দাবি করছেন, গত দুই মাস ধরে তার ওই প্রতিষ্ঠানের কোনো সম্পর্ক নেই। জেকেজি প্রতিষ্ঠানটির শুরুর দিকে ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী জড়িত ছিলেন। তিনি তিতুমীর কলেজে নিজেদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ব্যবহারের সময় থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময় জেকেজির চেয়ারম্যান হিসেবে পরিচয় ব্যবহার করতেন। আর প্রতিষ্ঠানটির এমডি আরিফুল চৌধুরী তার স্বামী।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জেকেজি হেলথকেয়ারের অনুমোদনসহ প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকান্ডে ডাক্তার সাবরিনা চৌধুরী জড়ি ছিলেন। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও তার এবং তার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করেছেন। চলতি মাসের শুরুর দিকে তিতুমীর কলেজের হামলার ঘটনা ঘটে। সেখানে গভীর রাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে তার প্রতিষ্ঠানের স্বেচ্ছাসেবীদের সাথে কথিত হামলার বিচার দাবি করেছিলেন।
তেজগাঁও থানার একজন পুলিশ সদস্য জানান, আরিফুল চৌধুকে পুলিশ আটক করে থানায় আনার পর থেকেই তার স্ত্রীর প্রভাবে পুলিশের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে ছিলেন। শুধু তাই নয়, তাকে থানা থেকে ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য কয়েকটি গাড়ি যোগে তার প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা থানা ভীড় জমিয়েছিলেন। কিন্তু তখন তারা কোন তদবির চালিয়েও সুবিধা করতে পারেনি।
জানা গেছে, ডাক্তার সাবরিনা চৌধুরীর প্রভার ও আরিফুল চৌধুরী দাপটের মধ্যেই মামলাটি তদন্ত চলছে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে হুমায়ন নামে জেকেজির এক কর্মকর্তা ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। করোনাভাইরাসের জাল সনদ সৃজন করা, নমুনা সংগ্রহ করে তা ফেলে দেয়া ও বাসায় গিয়ে অনৈতিকভাবে নমুনা সংগ্রহ করার কথা তারা স্বীকার করেছেন। শুধু তাই নয়, জেকেজির আরেক কর্মকর্তা সাঈদ চৌধুরী আরিফুল হকের মাদকাসক্তের স্বীকার করে।
আর অভিযানে অংশ নেওয়া একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আমরা অভিযানে গিয়ে জেকেজি হেলথ কেয়ারের কার্যালয়ে করোনা সনদ জাল করার বিভিন্নরকম প্রামাণিক দলিল পেয়েছি। এছাড়া ইয়াবা খাওয়ার সরঞ্জামাদি পাওয়া গেছে। এসময় আরিফুল চৌধুরীর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি চরম ক্ষীপ্ত হয়ে খারাপ আচরণ করতে ছিলেন।
অভিযানের পর তেজগাঁও জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) হারুন অর রশীদ বলেছেন, ‘আমরা যাদেরকে প্রথমে আটক করি তারা বাসায় গিয়ে অনৈতিকভাবে নমুনা সংগ্রহ করার বিষয়টি স্বীকার করে। আর এই ব্যবসা করতে গিয়ে তারা করোনার জাল সনদ বানাতো তাও স্বীকার করে। আর বিষয়ে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। তারা বলে আরিফুল হক চৌধুরীর অফিসে তারা গ্রাফিক্সের কাজ করত। সেখান থেকেই তারা জাল সনদ বানাতো।’
অপর এক সূত্র জানায়, পুলিশ তাদের আটক করার পর থেকেই ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করতে থাকে। প্রথমে ছয় থেকে সাতটা মাইক্রোবাস যোগে এসে তারা সিনক্রিয়েট করার চেষ্টা করে। তাদের প্রতারণার বিষয়টি অত্যান্ত গুরুত্ব দিয়ে পুলিশ তদন্ত করছে। পরে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করে। পরে আদালত তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেয় তদন্তকারী কর্মকর্তা। কিন্তু রিমান্ডে এসেও আরিফুল হক চৌধুরী হাজতখানার লাইট ভেঙে ফেলে। শুধু তাই নয়, হাজতখানার সিসি টিভি ভেঙে ফেলেছে। আর আরিফুল চৌধুরীকে থানায় রিমান্ডে আনার পর সে ইয়াবা চেয়েছিলেন বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন পুলিশ সদস্য জানিয়েছেন।
সূত্রটি আরো জানায়, গত এপ্রিল মাসে দেশে করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার জন্য জোবেদা খাতুন সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা বা জেকেজি হেলথকেয়ার অনুমোদন পায়। আর নমুনা পরীক্ষায় টেকনোলজিস্ট ও স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণের জন্য রাজধানীর মহাখালীস্থ তিতুমীর কলেজে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের জায়গা করা হয়। এরপর গত ১২ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ জেকেজির প্রস্ততি দেখতে তিতুমীর কলেজেন যান।ওই দিনও ডাক্তার সাবনিা আরিফ চৌধুরী সেখানে উপস্থিত থেকে নিজেকে জেকেজির চয়ারম্যান পরিচয় দেন।
সংশ্লিষ্ঠরা জানান, কার্ডিয়াক সার্জন ও ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরীর উদ্যোগেই মূলত জেকেজি হেলথকেয়ার বুথ স্থাপনের কাজ পায়।এরপর তাদের সম্পর্ক নিয়ে আরিফুল চৌধুরী আপত্তি জানালে সেখানেই শুরু হয় টানাপোড়েন। সরকারি চাকরি কওে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান পদে থাকার বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক একজন চিকিৎসক জানান, যারা সরকারি হাসপাতালে চাকরি করেন তারা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কোনো পদেই থাকতে পারেন না।
এবিষয়ে ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী গণমাধ্যমে বলেছেন, তিতুমীরের ঘটনার পর থেকে তিনি আর ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নেই। আমি দুইমাস ধরে আমার বাবার বাসায় অবস্থান করছি। আমি আসলে দুইমাস ধরেই নাই। কিন্তু তিতুমীরে যখন ঘটনাটা ঘটে আমি সেখানে যাই। কারণ এই স্বাস্থ্যকর্মীদেরকে আমি ট্রেনিং দিয়েছিলাম। এজন্য তাদের সাথে একটা ঘটনা শুনতে পেরে আমি সেখানে ছুটে গিয়েছিলাম। কিন্তু তখনও আমি আমার বাবার বাসায় ছিলাম।
জাল সনদের বিষয়ে তিনি বলেছেন, আমি আসলে স্বেচ্ছা শ্রমের ভিত্তিতে সেবা দিতাম। স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজ শেখানো বা পড়া বা প্লানিং করে যে, কী করবো- স্যারদের সাথে আলোচনা করা কীভাবে কী করবো- এগুলো আমি করতাম। ওদের ম্যানেজমেন্টের সাথে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। কাগজ কলমে আমি কোথাও নেই। কোনো মালিকানাতেও আমি নেই। কিছুতেই আমি নেই। আমি এমনি খাটতাম। কিন্তু এটা দুঃখজনক। আমার মনে হয় না কেউ এতো খারাপ কাজ করতে পারেন।
সূত্র জানায়, রাজধানীর কল্যাণপুরের একটি বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক কামাল হোসেনের অভিযোগের ভিত্তিতে হুমায়ুন কবীর ও তার স্ত্রীকে প্রথম গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতারকৃত হুমায়ুন কবীর ছিলেন জেকেজির গ্রাফিক ডিজাইনার। আর তানজীনা নামের অপর একজন রাজধানীর পান্থপথের ন্যাশনাল নার্সিং ইনস্টিটিউটের ইনস্ট্রাক্টর ছিলেন। তারা সেখান থেকে জেকেজির চিফ নার্সিং অ্যাডভাইজার পদে যোগদান করেন। গত ১২ এপ্রিল তারা দুজনই জেকেজি থেকে চাকরি ছেড়ে চলে আসেন।
পুলিশ জানায়, বাড়ি বাড়ি গিয়ে নমুন সংগ্রহের জন্য জেকেজি বুকিং বিডি ও হেলথ কেয়ার নামে আরও দুটি প¬্যাটফর্ম চালু করে। সেবাগ্রহীতারা যাতে যোগাযোগ করতে পারেন, সে তারা জন্য পাঁচ-ছয়টি হটলাইন নম্বর চালু করেছিলেন। আর করোনার উপসর্গ থাকা ব্যক্তিরা ওই নম্বরগুলোতে বাড়ি গিয়ে নমুনা সংগ্রহের জন্য জেকেজির সঙ্গে ফোন করতেন। তারা নমুনা সংগ্রহের জন্য সাধারণ নাগরিকদের কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছ থেকে ১০০ ডলার বা ৮ হাজার ৬০০ টাকা নেয়া হতো। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের গ্রেফতারকৃত হুমায়ুন ও তানজীনা দাবি করেছেন জেকেজির সিইও আরিফুল হক তাদের এই কাজে বাধ্য করেছেন। চাকরি ছেড়ে দেয়ার পর হুমায়ুনকে জেকেজিতে আটকে রাখা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে কাজ করতে রাজি হলে তাকে ছাড়া হয়। এ বিষয়ে কথা বলতে তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. কামাল উদ্দীন এর সেল ফোনে বার বার ফোন করা হলেও তিনি তার ফোনটি রিসিভ করেননি।
উল্লেখ্য গত ২৩ জুন জেকেজি নামক প্রতিষ্ঠানে তেজগাঁও থানা পুলিশ অভিযান চালিয়ে ৩৭টি করোনা পরীক্ষার ভুয়া সনদ ও সনদ তৈরীর সরঞ্জামসহ ৫জনকে গ্রেফতার করে।


বিজ্ঞাপন