নিজস্ব প্রতিবেদক : বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষকে করোনার রিপোর্ট পেতে গড়ে ১০ থেকে ১৫ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে। অথচ রাজনীতিবিদ ও পেশাজীবীরা পদ-পদবি ব্যবহার করে তাদের অনেকেই দিনের মধ্যেই ফল পেয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। দিনে দিনে পরীক্ষার ফল পেতে সংশ্লিষ্টদের বিভিন্ন হুমকি-ধমকিও দেয়া হচ্ছে। শুধু চট্রগ্রামেই না এসব ঘটনা ঘটছে সারা দেশে।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, মানুষ দিনভর লাইনে দাঁড়িয়েও নমুনা দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। ল্যাবগুলো স্বল্পতার কারণে একটি কিট ব্যবহার করে দুটি নমুনা পরীক্ষা করছে। অথচ পেশাজীবী ও ব্যবসায়ী সংগঠনের নামে প্রতিষ্ঠিত বুথে গণহারে নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস (বিআইটিআইডি) ল্যাব ইনচার্জ অধ্যাপক ডা. শাকিল আহমেদ বলেন, ‘চট্টগ্রামে করোনা পরীক্ষার ল্যাবের সক্ষমতার তুলনায় নমুনা সংগ্রহ বেশি হয়। সংগ্রহ করা সব নমুনা একদিনে পরীক্ষা করা সম্ভব না হওয়ায় প্রতিদিন কিছু নমুনা জমা থাকছে। তার ওপর আবার বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা-সরকারি কর্তারা দিনে দিনেই নিজেদের ও স্বজন বা পরিচিতজনদের নমুনা পরীক্ষার ফল পেতে চাপ দেন। এর ব্যতিক্রম ঘটলেই আসে হুমকি-ধামকি। এ কারণে দিনরাত পরিশ্রম করেও সাধারণ মানুষকে সময়মতো তাদের নমুনার ফলাফল জানানো সম্ভব হয় না।’
করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) উপসর্গ নিয়ে দীর্ঘ একমাসের বেশি সময় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন চট্টগ্রামের বিশিষ্ট চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. শহীদুল আনোয়ার। কিন্তু এই একমাসে অনেক চেষ্টা করেও তার করোনা পরীক্ষা করানো সম্ভব হয়নি। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও বিআইটিআইডি ল্যাবে দুইবার সিরিয়াল দেয়া হলেও আইসিইউতে থাকা এই প্রবীণ চিকিৎসকের নমুনা সংগ্রহে একমাসেও কাউকে রাজি করানো যায়নি। ওই অবস্থাতেই ২৪ জুন দিবাগত রাতে চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
তার ছেলে আব্দুল আহাদ বলেন, ‘একমাসের বেশি সময় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শ্বাসকষ্ট নিয়ে চিকিৎসাধীন ছিলেন বাবা। এ একমাস শত চেষ্টা করেও বাবার করোনা টেস্ট করতে পারিনি। চমেকের চিকিৎসকরা বাবার চিকিৎসার বিষয়ে এবং করোনা টেস্টের বিষয়ে গুরুত্ব দেয়নি। দেশের একজন স্বনামধন্য চক্ষু বিশেষজ্ঞ হয়েও তিনি যথাযথ চিকিৎসা পাননি।’
চট্টগ্রামের সিনিয়র সাংবাদিক শাইফুল ইসলাম শিল্পী বলেন, চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. শহীদুল আনোয়ারের পরিবারের অনুরোধে তার করোনা টেস্ট এবং সুচিকিৎসার জন্য বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) নেতাদের এবং চমেকের কয়েকজন চিকিৎসকে ফোন করে অনুরোধ করার পরও তার করোনা টেস্ট করাতে ব্যর্থ হয়েছি।
এর আগে গত ৩ জুন চট্টগ্রামের একটি ল্যাবে নমুনা জমা দেন জ্বর-শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত ফিলিপাইনের নাগরিক রুয়েল ই কাতান। ১৭ দিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে চট্টগ্রাম বন্দরে কর্মরত এই বিদেশি নাগরিক ১৯ জুন রাতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। চট্টগ্রামের ফিলিপাইন কনস্যুলেট জেনারেল অফিসের চিফ অব স্টাফ শেখ হাবিবুর রহমান জানিয়েছেন, তার নমুনা প্রতিবেদন এখনও পাওয়া যায়নি!
চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারহানা জাহান উপমা। নিজের গাড়িচালক ও বাসার তত্ত্বাবধায়ক করোনাভাইরাসে (কোভিড) আক্রান্ত। গত ৮ জুন নিজের নমুনা জমা দেন। ২০ দিন পার হয়ে গেলেও আজ পর্যন্ত তিনি নমুনা পরীক্ষার ফলাফল পাননি। এই অবস্থায় ইউএনও ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টাইন শেষ করে ২২ জুন থেকে এক প্রকার বাধ্য হয়েই কাজে যোগ দিয়েছেন।
চট্টগ্রামে করোনার নমুনার পরীক্ষার রিপোর্ট পেতে সাধারণ মানুষের এই যখন অবস্থা; তখন এর বিপরীত চিত্রও রয়েছে। গত ৭ মে ঢাকা থেকে ফেরার পথে জ্বরে আক্রান্ত হন শিক্ষা উপমন্ত্রী মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের ছোট ভাই বোরহানুল হাসান চৌধুরী সালেহীন। ১০ মে বিআইটিআইডি ল্যাবে নমুনা পরীক্ষায় তার করোনা পজিটিভ ফলাফল পাওয়া যায়। এর দুইদিন পরে ১২ মে উপমন্ত্রীর মা হাসিনা মহিউদ্দিনের শরীরেও নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এদিন পরিবারের বাকি সদস্যদেরও নমুনা পরীক্ষা হলে বাসার দুজন কর্মচারীর শরীরে করোনা শনাক্ত হয়।
দীর্ঘ একমাস চেষ্টা করে আইসিইউতে থাকা বিশিষ্ট চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. শহীদুল আনোয়ারের নমুনা সংগ্রহ করানো না গেলেও গত ১ জুন চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনের সংসদ সদস্য মো. মোস্তাফিজুর রহমানের শহরের বাসা থেকে তার পরিবারের মোট ১৬ জনের নমুনা সংগ্রহ করে বিআইটিআইডির নমুনা সংগ্রহকারীরা। সাধারণ মানুষকে যখন দিনের পর দিন নমুনা পরীক্ষার ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে, তখন একদিন পরেই ২ জুন বিআইটিআইডি এই সাংসদের পরিবারের সবার নমুনা পরীক্ষা করে জানায়, এমপিসহ মোট ১১ জনের করোনা পজিটিভ।
চট্টগ্রাম-৮ আসনের সংসদ সদস্য হলেও সাংসদ মোসলেম উদ্দিনের শহরের বাড়ি লালখান বাজারে। জানা গেছে, নিকট দূরত্বে থাকা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ল্যাব বা বিআইটিআইডি থাকার পরেও এই সাংসদ নিজের প্রভাব খাঁটিয়ে গত ৯ জুন বোয়ালখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একটি টিম নগরের লালখান বাজারের বাসায় এনে নিজের পরিবারের ১৫ সদস্যের নমুনা সংগ্রহ করান। এর পরদিনই বিআইটিআইডি থেকে প্রাপ্ত ফলাফলে সাংসদ মোসলেম উদ্দিনের পরিবারের ১০ জনেরই পজিটিভ রিপোর্ট দেয়া হয়।
শুধু যে মন্ত্রী বা সাংসদরাই করোনা পরীক্ষায় এমন চাপ সৃষ্টি করছেন তা কিন্তু নয়। সম্প্রতি চট্টগ্রামে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থা নিজেরাই বুথ তৈরি করে করোনাভাইরাস শনাক্তের জন্য নমুনা সংগ্রহ করছে। এক্ষেত্রে প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের চিন্তা না করেই গণহারে নমুনা সংগ্রহের অভিযোগও উঠছে। গোষ্ঠীগুলো ইচ্ছামাফিক নিজেদের পছন্দের মানুষদের নমুনা একাধিকবার পরীক্ষা করাচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রেই নমুনা সংগ্রহের সময় যথাযথ মান রক্ষা করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। তাছাড়া নমুনা সংগ্রহের সময় রোগীর উপসর্গ, ঠিকানাসহ অন্যান্য তথ্যাদি সংরক্ষণ করা হচ্ছে না।
চট্টগ্রামে করোনাযুদ্ধের ফ্রন্টলাইনার অধ্যাপক ডা. শাকিল আহমেদ বলেন, চট্টগ্রামে বিভিন্ন পেশাজীবী-ব্যবসায়ী সংগঠন ও এমপিরা নিজেরাই বুথ তৈরি করে করোনাভাইরাস শনাক্তের জন্য নমুনা সংগ্রহ করছেন। এসব ক্ষেত্রেও নমুনার ফল তাড়াতাড়ি পেতে আমাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়। এসব কারণে নমুনাজট পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে না। তিনি বলেন, বিভিন্ন সংগঠনের নামে প্রতিষ্ঠিত বুথে নিজেদের পরিবার-নিকটজনদের গণহারে নমুনা সংগ্রহের মাধ্যমে মহামূল্যবান কিটের অপচয় ঘটানো হচ্ছে ।
রাত জেগে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে নমুনা জমা দিলেও ১০ থেকে ১৫ দিনেও মিলছে না করোনা রিপোর্ট
সরকারি হাসপাতালের ল্যাবে সংগ্রহকৃত নমুনা অভিজ্ঞ লোক দিয়ে সংগ্রহ করা হচ্ছে। তাদের দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তবে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে সংগ্রহ করা নমুনায় যথাযথ মান রক্ষা হচ্ছে না। অনভিজ্ঞ লোক দিয়ে এসব নমুনা সংগ্রহ হচ্ছে। এতে রোগীর উপসর্গসহ অন্যান্য বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য থাকছে না। এসব কারণে রোগী ভুল রিপোর্ট পেতে পারেন’, বলেন অধ্যাপক ডা. শাকিল আহমেদ।
জ্বর ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য গত ৮ জুন নমুনা দিয়েও এখনো রিপোর্ট পাননি সদ্য মধ্যপ্রাচ্য ফেরত আব্দুল মোনাফ। নগরের চান্দগাঁও এলাকায় বসবাস করা এই প্রবাসী পরিবারের বাকি সদস্যদের মাঝেও ইতোমধ্যে উপসর্গ দেখা দিলেও তিনি আর কারো নমুনা জমা দেননি।
নমুনা দেয়ার পরদিন প্রতিবেদনের অপেক্ষায় থাকা মোনাফ বলেন, ‘দেশে করোনা পরীক্ষার নামে তামাশা হচ্ছে। আমার উপসর্গ ছিল, এখন ভালো হয়ে গেছি। তাই আর স্ত্রী-সন্তানদের পরীক্ষা করাইনি। বাসাতেই আইসোলশেনে আছি।’
আব্দুল মোনাফের মতোই নমুনা দেয়ার ২০ দিন পরেও রিপোর্ট না পেয়ে হতাশা ও আক্ষেপের কথা জানিয়েছেন।
দুর্নীতিবিরোধী সংগঠন সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) চট্টগ্রাম জেলা সভাপতি অ্যাডভোকেট আকতার কবীর চৌধুরী বলেন, ‘একই শহরের বাসিন্দা হয়েও কেউ দিনে দিনে রিপোর্ট পাচ্ছে আবার সাধারণরা সময়মতো রিপোর্ট না পেয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে। ৮০ লাখ মানুষের শহরে ঠিকমতো নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে না। নমুনা হারিয়ে যাচ্ছে। এটা তামাশা ছাড়া আর কিছুই না।’
চট্টগ্রামে করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা নিয়ে এমন বিশৃঙ্খল ও স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে বিব্রত চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য বিভাগও। চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, ‘এসব নিয়ে আমরা রীতিমতো বিব্রত। রাজনৈতিক মহল ও প্রেসার গ্রুপগুলোর চাপ তো রয়েছেই। বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনগুলোও বুথ স্থাপনের নামে যাচ্ছেতাই করছে। এ নিয়ে আমরা বৈঠক করেছি।’
তিনি বলেন, সক্ষমতার বেশি নমুনা সংগ্রহ করা যাবে না। এছাড়া আপাতত দ্বিতীয়বার নমুনা পরীক্ষাকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।’
করোনার নমুনা পরীক্ষার ফলাফল পেতে রাজনীতিবিদ ও পেশাজীবীদের প্রভাব খাটানোর বিষয়টি স্বীকার করলেও এ নিয়ে সরাসরি মন্তব্য করতে অস্বীকার করেছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ শামীম হাসান।
তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামে সব শ্রেণি-পেশার মানুষই চট্টগ্রাম মেডিকেলের সেবাটা পেতে চায়। এজন্য আমরা এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় ল্যাব প্রতিষ্ঠা করেছি। তবে এখানে চাপটা ধারণার চাইতেও বেশি। চাপ আছে, তবে সেটি নিয়ে আমি মন্তব্য করতে চাই না।’
অধ্যক্ষ শামীম হাসান আরও বলেন, আমাদের কাজ পরীক্ষা করে রিপোর্ট দেয়া। তবে চিকিৎসক, ভাইরোলজিস্ট ও স্বেচ্ছাসেবীরা দিনরাত দুই বেলা কাজ করেও সংগৃহীত নমুনার সব পরীক্ষা করতে পারেন না।