জেকেজির চেয়ারম্যান সাবরিনা কুপোকাত

অপরাধ আইন ও আদালত এইমাত্র জাতীয় স্বাস্থ্য

নিজস্ব প্রতিবেদক : প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রভাব কাজে আসেনি জেকেজি হেলথকেয়ারের চেয়ারম্যান ডাক্তার সাবরিনা চৌধুরীর। অবশেষে তেজগাঁওয়ের পুলিশ তাকে কুপোকাত করেছে। তার প্রভাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তটস্থ ছিলেন। বাধ্য হয়ে তাকে দিয়েছিলেন নমুনা সংগ্রহের মত গুরুত্বপূর্ন দায়িত্ব। কিন্তুনমুনা সংগ্রহের নামে করোনাভাইরাস পরীক্ষা না করেই ভুয়া রিপোর্ট ডেলিভারি দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ পেয়েছে পুলিশ।
রোববার দুপুরে তাকে গ্রেফতারের পর তেজগাঁও বিভাগীয় উপপুলিশ (ডিসি) কমিশনারের কার্যালয়ে আনা হয়। সেখানে জিজ্ঞাসাবাদের পর তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়ছে। জেকেজি হেলথকেয়ারের করোনা টেস্ট নিয়ে প্রতারণার অভিযোগে এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী আরিফ চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃত আরিফ চৌধুরীর স্ত্রী হচ্ছেন এই ডাক্তার সাবরিনা।
পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ সাবরিনাকে গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বলেন, ডা. সাবরিনাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি বলেন, করোনা টেস্ট নিয়ে জেকেজির জালিয়াতির ঘটনায় তদন্ত কর্মকর্তা অধিকতর তদন্তের স্বার্থে ডা. সাবরিনাকে থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আর জিজ্ঞাসাবাদের পর তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়।
এর আগে গত ৪ জুন ডাক্তার সাবরিনর স্বামী আরিফুলের বিরুদ্ধে মারধরের অভিযোগ তুলে সাবরিনা তেজগাঁও বিভাগের একটি থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। তবে অন্তত দুই মাস আগে তাদের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে সাবরিনা দাবি করেন। জেকেজির বিরুদ্ধে অভিযোগ, সরকারের কাছ থেকে বিনামূল্যে নমুনা সংগ্রহের অনুমতি নিয়ে বুকিং বিডি ও হেলথকেয়ার নামে দুটি সাইটের মাধ্যমে টাকা নিচ্ছিল এবং নমুনা পরীক্ষা ছাড়াই ভুয়া সনদ দিত।
এ বিষয়ে রাজধানীর কল্যাণপুরের একটি বাড়ির কেয়ারটেকারের অভিযোগের সত্যতা পেয়ে গত ২২ জুন জেকেজি হেলথকেয়ারের সাবেক গ্রাফিকস ডিজাইনার হুমায়ুন কবীর হিরু ও তার স্ত্রী তানজীন পাটোয়ারীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পরে প্রতিষ্ঠানটির সিইও আরিফকেও গ্রেফতার করা হয়। এ ঘটনার পর ২৪ জুন জেকেজি হেলথকেয়ারের নমুনা সংগ্রহের যে অনুমোদন ছিল তা বাতিল করে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
জানা যায়, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় করোনার নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা না করেই জেকেজি প্রতিষ্ঠানটি ১৫ হাজার ৪৬০ টেস্টের ভুয়া রিপোর্ট সরবরাহ করে।
পুলিশ জানিয়েছে, জেকেজি হেলথকেয়ার থেকে ২৭ হাজার রোগীকে করোনার টেস্টের রিপোর্ট দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১১ হাজার ৫৪০ জনের করোনার নমুনার আইইডিসিআরের মাধ্যমে সঠিক পরীক্ষা করানো হয়েছিল। বাকি ১৫ হাজার ৪৬০ রিপোর্ট প্রতিষ্ঠানটির ল্যাপটপে তৈরি করা হয়। জব্দ করা ল্যাপটপে এর প্রমাণ মিলেছে। আরিফ চৌধুরীকে জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানান, জেকেজির ৭-৮ জনকর্মী ভুয়া রিপোর্ট তৈরি করেন। আর জেকেজির মাঠকর্মীরা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে করোনা উপসর্গ দেখা দেয়া মানুষের নমুনা সংগ্রহ করতেন। প্রতি রিপোর্টে ৫-১০ হাজার টাকা নেয়া হতো। আর বিদেশিদের কাছ থেকে নেন ১০০ ডলার। সেই হিসাবে করোনা পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্টে প্রায় ৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে জেকেজি।
গত ২৪ জুন জেকেজির গুলশান কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে প্রতারক আরিফসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাদের দুদিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। দুজন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। জেকেজির কার্যালয় থেকে ল্যাপটপসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি জব্দ করে পুলিশ। এ ঘটনায় তেজগাঁও থানায় চারটি মামলা হয়েছে। এসব মামলার কোনোটিতে এখন পর্যন্ত ডা. সাবরিনার নাম সংযুক্ত করা হয়নি। চারটি মামলার তদন্ত করছে তেজগাঁও থানা পুলিশ।
জানা যায়, আরিফ গ্রেফতার হওয়ার পর ডা. গাবরিনা গ্রেফতার-আতঙ্কে গা ঢাকা দেন। আড়ালে ‘অদৃশ্য শক্তির’ ইশারায় দায়মুক্তির চেষ্টায় ছিলেন তিনি। করোনা মহামারীতে মানুষের জীবন নিয়ে নির্মম প্রতারণায় নাম উঠে আসা ডা. সাবরিনা এ চৌধুরী সরকারি একটি হাসপাতালে চাকরির পাশাপাশি জেকেজির চেয়ারম্যান।
তিনি জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক। পাশাপাশি তিনি জেকেজি হেলথকেয়ারের চেয়ারম্যান। আর তার স্বামী আরিফ চৌধুরী প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।
ডা. সাবরিনা বরখাস্ত : শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের ডা. সাবরিনা শারমিন হুসাইনকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। রোববার স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আব্দুল মান্নান স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত এক অফিস আদেশ জারি করা হয়।
অফিস আদেশে বলা হয়েছে, ‘সাবরিনা শারমিন সরকারি চাকরিতে কর্মরত অবস্থায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জেকেজি হেলথকেয়ারের চেয়ারম্যান হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং করোনা টেস্টের ভুয়া রিপোর্ট প্রদান ও অর্থ আত্মসাতের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন বিধায় তিনি রোববার গ্রেফতার হন। সরকারি কর্মকর্তা হয়ে সরকারের অনুমতি ব্যতীত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত থাকা এবং অর্থ আত্মসাৎ সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা এবং আপিল) বিধিমালা ২০১৮ অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ, সেহেতু ডা. সাবরিনা শারমিনকে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮ এর ১২(১) অনুযায়ী সাময়িক বরখাস্ত করা হলো।’
তিনি সাময়িক বরখাস্তকালীন সময়ে বিধি মোতাবেক খোরপোষ প্রাপ্ত হবেন বলে অফিস আদেশে উল্লেখ করা হয়। করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা না করেই রিপোর্ট ডেলিভারি দেয়া জেকেজি হেলথকেয়ারের চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা আরিফকে আজ গ্রেফতার করে পুলিশ। এর আগে দুপুরে তাকে তেজগাঁও বিভাগীয় উপ-পুলিশ (ডিসি) কার্যালয়ে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।


বিজ্ঞাপন