চেষ্টা ও সাধনায় অবিরাম নিয়োজিত ছোট্ট মারুফ

অন্যান্য জীবন-যাপন জীবনী বিবিধ সারাদেশ

বনি আমিন খান : কষ্ট ছাড়া কেষ্ট মেলে না’ কথাটি অনেক প্রাচীন। কিন্তু কথাটা জিইয়ে আছে আজও। কথাটা সুগন্ধি ছড়াচ্ছে মানুষের জীবনের অলিগলিতে। কষ্টের র্পূণ প্রস্তুতি নিয়ে আমাদের ছুটে যেতে হবে উদ্দেশ্যর নগরে। ছোট্ট বাবা হারা মারুফ। গাইবান্ধা জেলার সদর উপজেলার উত্তর আনালের তাড়ি, হাট দাড়িয়াপুর গ্রামে বসবাস করে। মাত্র ১২ বছর বয়স, শৈশবের আঙ্গিনায় যখন ভাই-বোনদের সাথে খেলা-ধুলা আর খুনসুঁটিতে মেতে থাকার কথা ছিল কিন্তু ঘটনা চিত্র তার বিপরীত মারুফ জীবন সংগ্রামে প্রতিনিয়তই যুদ্ধ করে ছুটে চলছে। মারুফের যখন ৬ বছর বয়স তখন তার বাবা অভাব-অনটোনে জর্জরিত হতাশাগ্রস্থ হয়ে একদিন হঠাৎ অকাল বয়সে (৪৫) র্হাটস্ট্রোক করে এই ধরনির মায়া ত্যাগ করে পরপারে গমন করলেন। তখন থেকেইে নিষ্ঠুর নিয়তির আপন-পর, ভাল-মন্দ সব কিছুই চিনতে শেখে মারুফ। প্রকৃতি এহেন পরিস্থিতি মোকাবেলায় তার পরিবারকে সংগ্রামী হতে শেখায়। দুঃখে-শোকে ভারাক্রান্ত পরিবারটি খেয়ে না খেয়ে ৩ ভাই, ১ বোনসহ মাকে নিয়ে ৫টি সদস্য নিদারুন কষ্টের মধ্যে দিয়ে জীবন জীবিকার তাগিদে বেঁেচ থাকার লড়ায়ে সামিল হয়। মারুফের বড় ভাই মুন্না (ছদ্ম নাম) বয়স ২৯, যৌথ সংসারের ভার একা টানতে না পেরে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আলাদা সংসার পাতে। একটি সময়ে মেজো ভাই মিজান ছদ্ম নাম (২৬) ঢাকায় একটি কোম্পানীতে চাকুরী নেয় কিন্তু তিনিও মা আর ছোট ভাইবোনকে দেয়া কথা রাখেনি বিয়ে করে ঢাকাতে সংসার সাজায়। স্বার্থপর পৃথিবীতে একে একে আপন মানুষগুলো যেন সবাই পর হয়ে যায়। মা মুন্নুজান (ছদ্মনাম) বয়স ৪৪, রাস্তার পাশের সারিবদ্ধ ইউনিয়ন পরিষদের গাছগুলোর পাহারার কাজ নেয়। অনেক কষ্টে ঘরে থাকা ছোট মেয়েটিকে একটি সহায় সম্বলহীন দিনমজুর ছেলের হাতে তুলে দেন। এখন টিকে থাকার লড়াইয়ে মারুফ ও তার মা।


বিজ্ঞাপন

দিন যায় দিন আসে,ধীরে ধীরে ছোট্ট মারুফ গাইবান্ধা জেলার তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীর কোল ঘেষে বড় হতে থাকে। তার মানসিক বিকাশ প্রসারিত হতে থাকে। সে বুঝতে শেখে। তখন মারুফ তার বড় ভাইদের আচরণ, তার মা ও বোনের দীর্ঘদিনের খোঁজ না নেয়ার বিষয়টি তার মনে দাগ কাটে, ক্ষোভ আর ঘৃণার জন্ম দেয়। সে খুব কাছ থেকে তার মায়ের কষ্ট দেখেছে, সে বুঝতে শিখেছে সন্তানেরা সময়ের বেড়া জ্বালে র্স্বাথপর হয়ে পিতামাতাকে ভূলে গেলেও বাবা-মা কখনোই শত বিপদেও সন্তানকে ফেলে যায়না।

মারূফ তার ভাইদের মতো স্বার্থপর হতে চায়না, সে প্রতিজ্ঞার ব্রত নিয়ে সৃষ্টিশীল, সৃজনশীল ও প্রশংসনীয় কর্মের মধ্যে লিপ্ত থেকে বড় হতে চায়। সে জানে চেষ্টা ও সাধনা ছাড়া মানুষ সফলকাম হতে পারে না। সুন্দরভাবে জীবন যাপন করতে পারে না। তাই ছোট্ট মারুফ ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে এটুকু আবিস্কার করেছে যে, এই নির্দয় পৃথিবীর মানুষগুলোর সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পড়ালেখা ছাড়া বিকল্প নেই । তাই সে ভাবে আর ভাবে পড়ালেখা ও টাকা উর্পাজন দু’টোই আমাকে ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে চালিযে যেতে হবে। বাস্তবতা মানুষকে কতটা জ্ঞানী হতে শিখাতে পারে তার একটি বড় প্রতিমূর্তি ছোট্ট মারুফ। সে তার মা’কে বলে, ‘মাগো আমি তোমার শুধুই সুখের নয়, কষ্টেরও ভাগিদার হতে চাই। তুমি আমাকে বারণ না করে সহযোগিতা করো। আমাকে একটি এমন স্কুলে ভর্তি করে দাও যেখানে আমি আমার স্বাধীন সময়ে পড়ালেখা আর পাশাপাশি কাজ করে টাকা উর্পাজন করবো। ওর মা হতভাগা ছেলের কথা শুনে ডুঁকরে ডুঁকরে কাঁদতে থাকে, ছেলেকে আদর করে বাহু ডোরে জড়িয়ে নেয়। ছেলে মায়ের পরম ভালবাসায় সিক্ত হয়ে যায়’’।

২০১৭ সাল মারুফের বয়স তখন ০৯। ছেলের কথায় মা তার সন্তানকে পড়ালেখা শেখাতে উদগ্রীব হয়ে উঠে। খোঁজ নিতে থাকে বিনা বেতনে এবং অনেক সুযোগ সুবিধা আছে এমন স্কুল কোথায় পাওয়া যায়। কথায় আছে, ‘মানুষ খুঁজলে নাকি আল্লাহর দেখাও পায়’’। এক সময় পেয়ে গেল তদানীন্তন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত আশার আলো শিশু শিখন কেন্দ্র। সেভ দ্য চিলড্রেনের বাস্তবায়নে ও জাগরণী চক্র ফাউন্ডেশনের বাস্তবায়ন সহযোগিতায় পরিচালিত উত্তর আনালের তাড়ি আশার আলো শিখন কেন্দ্র। সেখানে মারুফ লাল দল/প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়। স্কুলটি যেহুতু এবিএএল মডালিটিতে পরিচালিত হয় তাই মারুফের স্বাধীন সময়ে পড়ালেখা করতে অসুবিধা হয় না। সে সকাল ৯ টা থেকে ১ টা পর্যন্ত তার নিজ এলাকা গাইবান্ধা সদরে একটি কাপড় বানানোর ছোট কারখানায় কাজ নেয়। সেখানে সে মাসে ২০০০/- (দুই হাজার) টাকা উপার্জন করে মাকে সহযোগিতা করে আর বিকাল শিফ্টে আশার আলো স্কুলে এসে লেখা পড়া করে। মা-ছেলের সামান্য উর্পাজনে কখনো অর্ধাহারে আবার কখনো বা অনাহারে স্কুলে আসে এবং প্রকৃতির এই নিষ্ঠুর বাস্তবতার মাঝেই বেড়ে উঠছে অভাবগ্রস্থ মারুফ।

মারুফ খুব ভালভাবে মনযোগী হয়ে মনে ব্রত নিয়ে পড়ালেখা করে। প্রতি মাসের মুল্যায়ন পরীক্ষায় সকল শিক্ষার্থীর সাথে প্রতিযোগিতামূলক অংশগ্রহণের মাধ্যমে মেধার সাথে তার দক্ষতা ও মনন যোগ্যতার পরিচয় দেয়। এভাবে চলতে থাকে তার পড়ালেখা আর কারখানায় শ্রম। কেটে গেছে আরো ৩ বছর। এরই মধ্যে সময়ের পালাবদলে এখন সেকেন্ড চান্স এডুকেশন পাইলট কর্মসূচিটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এর অর্থায়নে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো’র সরাসরি তত্ত্বাবধানে জাগরণী চক্র ফাউন্ডেশন তার সহযোগী সংস্থা- সাতক্ষীরা উন্নয়ন সংস্থা (সাস) এর মাধ্যমে স্কুল থেকে ঝরেপড়া এবং কখনোই স্কুলে পড়েনি এমন শিক্ষার্থীদের নিয়ে গাইবান্ধা জেলায় ৯১৯৪ জন শিক্ষার্থীকে ৩৩৪টি উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাধ্যমে এবিএএল পদ্ধতিতে পাঠদান দিয়ে আসছে। স্থায়ীত্বশীল উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং শিক্ষায় ঝরে পড়ার হার কমানোর জন্য লিড সংস্থার ভূমিকায় দক্ষতার সাথে কাজ করে যাচ্ছে জাগরণী চক্র ফাউন্ডেশন। এছাড়াও ঢাকা জেলার যাত্রাবাড়ী এরিয়ায় জেসিএফ এর সরাসরি তত্ত্বাবধান ও রায়েরবাজার এরিয়ায় এসোসিয়েশন ফর ডেভেলপমেন্ট এন্ড সোশ্যাল ওয়ার্ক (এডিএস) এর বাস্তবায়ন সহযোগিতায় ৬৭৪৫ জন এবং সিলেট জেলার ৫টি উপজেলায় ৯৪৮৯ জন স্কুল বর্হিভূত শিক্ষার্থীকে নমনীয় পদ্ধতি এবিলিটি বেইজড এ্যাকসিলারেটেড লার্নিং এ্যাপ্রোচে পাঠদান করে যাচ্ছে।

মন্নুজান তার বড় ছেলেদের কাছে প্রতারিত হলেও সব অতীতকে ভুলে ছোট ছেলেই একমাত্র ভরসার শেষ সম্বল বলে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন। তার ছোট ছেলে মারুফকে পড়ালেখা শিখিয়ে মানুষের মত মানুষ করাই মুন্নুজানের লক্ষ্য। তাই সে নিয়মিত মারুফের স্কুলে যান। অধিকতর সচেতনতার অংশ হিসেবে স্কুলে অনুষ্ঠিত অভিভাবক সভাগুলোতে গুরুত্ব সহকারে অংশনেন। সেখান থেকে তিনি অনেক তথ্য জানতে পারেন। নিয়মিত শিক্ষকের সাথে যোগাযোগ রাখেন ও পরামর্শ গ্রহণ করেন। মন্নুজান বলেন-‘‘আমার ছেলে বড় হয়ে একজন আদর্শবান শিক্ষক হতে চায়। আমার ছেলের স্বপ্ন পূরণের প্রথম সোপান হিসেবে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো’র ভূমিকা অপরিসীম। সাতক্ষীরা উন্নয়ন সংস্থা (সাস) এর পিও/শিক্ষক/অন্যান্য কর্মকর্তাগণ আমার সন্তানের খোঁজ-খবর রাখছেন এজন্য আমি তাদের প্রতি একান্তভাবে কৃতজ্ঞ। আমার সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য আমি সকলের কাছে প্রাণভরে দোয়া চাই’’।

কারখানার মালিক বাবুল তার এক মন্তব্যে বলেন, ‘‘ মারুফ একজন ন¤্র-ভদ্র মেধাবী ছেলে। তার একাগ্রতা, নিষ্ঠা ও পরিশ্রম তাকে এনে দিবে সাফল্যের চাবি কাঠি। আমি তার সর্বঙ্গীন মঙ্গল কামনা করি’’।

স্কুল ম্যানেজমেন্ট কমিটির সভাপতি মো: আশরাফুল মিয়া বলেন, ‘‘মারুফ আমাদের এই সমাজের একটি উজ্জল নক্ষত্র। তার মেধা ও মননশীলতা যেন কোনভাবেই বিপথে না যায়, সে বিষয়ে আমাদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে, অভাব যেন তার পড়ালেখা গ্রাস করে না নেয় সেজন্য আমাদের সহযোগিতার হাত সর্বদাই প্রসারিত থাকবে’’।

পরিসমাপ্তি: সমাজের সুবিধা বঞ্চিত পরিবার সমূহের শিশুদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে পড়ালেখা থেকে ছিটকে পড়া মারুফদের সঠিক মেধার প্রসার ঘটিয়ে ভবিষ্যতে জনসম্পদে রুপান্তরিত করাই সমাজের সকল সচেতন নাগরিকের কর্তব্য। জীবনকে উপলব্ধি করে সমাজের মারুফদের কাছে থেকে সফলতার পাঠ নিতে হবে। তবেই আমাদের সমাজের বিবর্তন ঘটবে, সমাজ তথা দেশ জাতি পৌঁছে যাবে সফলতার স্বর্ণ শিখরে। আসুন স্বপ্ন দেখি এবং সেই স্বপ্ন বির্নিমাণে সর্বাত্মক চেষ্টার হাতকে আরো প্রসারিত করি।
লেখক : ডকুমেন্টেশন অফিসার, এসসিই প্রোগ্রাম, জাগরণী চক্র ফাউন্ডেশন।