প্রকল্পের টাকা সিংহভাগ খরচ হয় সফর আর পরামর্শক নিয়োগে
নিজস্ব প্রতিবেদক : নানান অভিজ্ঞতার জন্য বিদেশ সফর, বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি, কেনাকাটা এগুলো এখন প্রকল্পের জন্য সাধারণ বিষয়। বলা হয়েছে এগুলো তেমন কিছু নয়, ছিঁচকে চুরি। এর আগে বলা হয়েছিল নাথিং। ঘুষকে বলা হয়েছিল স্পিডমানি। আবার সহনীয় মাত্রায় ঘুষ খাওয়ার পরামর্শও ছিল। এ ধরনের আস্কারা-মশকরা, পরামর্শে ঘুষ, দুর্নীতি, চুরি, পাচারসহ সব এখন মামুলি। যথারীতি সহনীয়, এমন কি বরণীয়ও হয়ে যাচ্ছে। সরকারের নিয়মানুযায়ী একজন সচিব বছরে চারবার বিদেশ যেতে পারবেন। অথচ দেশে এক বছরে একজন সচিবের সর্বোচ্চ ৭৫ বার বিদেশযাত্রার রেকর্ডও তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া একই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সচিবের একই সময়ে বিদেশ সফরেও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু মন্ত্রী-সচিবরাও এই নীতিমালা মানছেন না। এমনকি অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদেরও সরকারি টাকায় একাধিকবার বিদেশ সফরের ঘটনাও রয়েছে।
ঘটনাচক্রে দু’চারটা ঘটনা ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। ক্ষোভ-বেদনায় খবর ফাঁস করেন বঞ্চিতরা। প্রকাশ হয়ে যাচ্ছে আলু দেখতে, পুকুর খনন শিখতে, ক্যামেরা বা মোবাইল কিনতে সরকারি টাকায় দল বেঁধে বিদেশ যাওয়ার খবর। প্রশিক্ষণের নামে বিদেশ সফর ছাড়াও পরামর্শক ফি, গাড়ি কেনা ও ভবন নির্মাণে যাচ্ছেতাই কা-, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বালিশ কেনা, ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৩৭ লাখ টাকায় পর্দা কেনা, গোপালগঞ্জের শেখ সায়েরা খাতুন মেডিক্যাল কলেজের জন্য সাড়ে ৫ হাজার টাকার বই ৮৫ হাজার ৫০০ টাকায় কেনা, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মুহতারাম ডিজির পবিত্র কুরআন শরীফ না ছেপে টাকা হজম করে দেয়া, স্বাস্থ্য অধিদফতরে তিন কোটি টাকার যন্ত্র ২৫ কোটি টাকায় কেনা বা স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক আফজলের লোপাটের মতো কিছু খবর ফাঁসের ইতোমধ্যে ব্যাপক কৌতুহলের সৃষ্টি হয়েছে প্রকল্পের বিষয়ে।
কোভিড-১৯ এর প্রভাবে রাজস্ব আদায়ের গতি কমে গেছে। এতে উন্নয়নে অর্থায়ন সংকটের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসী ব্যয় সংকোচনের পথে হাঁটছে সরকার। ঠিক সে সময়েও বসে নেই সুবিধাভোগীরা। এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকনোমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, টাকা বাঁচাতে সরকার ইতোমধ্যেই প্রকল্পের আওতায় গাড়ি কেনায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। সেক্ষেত্রে করোনা মহামারীর এ সংকটময় মুহূর্তে পুকুর ও খাল উন্নয়নের মতো প্রকল্পের আওতায় বিদেশ সফরের খাত বাদ দেয়া উচিত। কেননা এক্ষেত্রে ব্যাপক অর্থের অপচয় ঘটে। এ প্রকল্পের বিদেশ সফর না কমিয়ে বরং বাড়ানোটা অবশ্যই অপচয়। এটা এক ধরনের অপতৎপরতা।
জানা গেছে, করোনাকালে পুকুর ও খাল উন্নয়নের প্রশিক্ষণ নিতে বিদেশ যাওয়ার ছক সাজাচ্ছেন ৪৮ কর্মকর্তা। এক্ষেত্রে মূল ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) ২৪ জনের সংস্থান থাকলেও এখন তা বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা হচ্ছে। ফলে এ খাতে মূল অনুমোদিত বরাদ্দ এক কোটি ৪৪ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে দুই কোটি ৮৮ লাখ টাকা করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে পুকুর ও খালের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ পাঁচজন থেকে বাড়িয়ে করা হচ্ছে ১৭ জন। এ খাতে বাড়ছে ব্যয়ও। সারা দেশে পুকুর, খাল উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্পে ঘটেছে এমন ঘটনা। অথচ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে তেমন গতি নেই। আড়াই বছরে বাস্তব অগ্রগতি ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৩৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা, আর্থিক অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ৭১ শতাংশ।
এদিকে, পুকুর ও খাল উন্নয়ন শিখতে বিদেশ সফরে যাবেন ১০০ কর্মকর্তা। প্রশিক্ষণের নামে এ সফর বাবদ সরকারের ব্যয় হবে ৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। তবে অনুমোদিত মূল প্রকল্পে বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য ২৪ জনের কথা বলা ছিল। সেখানে ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এখন নতুন করে ৭৬ জন কর্মকর্তা যোগ করার প্রস্তাব দেয়ায় বাড়তি ৬ কোটি ৬ লাখ টাকা ব্যয় হবে। এছাড়া বাড়ছে পরামর্শকের সংখ্যা ও এ খাতের ব্যয়ও। সেইসঙ্গে নানা কারণে বাড়ছে প্রকল্পের মোট ব্যয়।
২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা থাকলেও এখন প্রথম সংশোধনীতে প্রস্তাব করা হয়েছে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। এটি ২০১৭ সালের ২৯ মার্চ অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে স্থানীয় সরকার বিভাগের আয় দিয়ে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি)। ২০১৯ সালের জুন মাস পর্যন্ত দুই বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও বাস্তব অগ্রগতি প্রায় ২ শতাংশ। আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে আরও কম ১ দশমিক ৮৭ শতাংশ। এ অবস্থায় প্রকল্পটির সশোধনীর ক্ষেত্রে বেশ কিছু কারণ তুলে ধরা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে-খাল বা পুকুর ডিজিটাল জরিপ ও ডাটা প্রসেসিংসহ আনুষঙ্গিক কার্যাবলি সমাপ্ত করতে মূল প্রকল্পে প্রয়োজনীয় লজিস্টিক ও উপজেলা পর্যায়ে জনবলের অপ্রতুলতা।
এছাড়া খালগুলোর মূল এ্যালাইনমেন্ট পরিবর্তন, পুকুরের মালিকানা সংক্রান্ত সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে বাস্তবায়নযোগ্যতা যাচাই, হাইড্রোলিক ডিজাইন ও হাইড্রোলজিক্যাল বিষয়াদি, খনন করা মাটির পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় জনবল বা পরামর্শকের অভাব রয়েছে। আর স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সুপারিশ অনুযায়ী প্রকল্পে স্কিম ও নতুন অঙ্গ অন্তর্ভুক্তিসহ মূলধন ও রাজস্ব খাতে কিছু অঙ্গে পরিমাণ ও ব্যয় হ্রাস/বৃদ্ধির করা হচ্ছে। এসব কারণেই প্রকল্প ব্যয় ৬৮ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি করে প্রকল্পটি সংশোধন করা হচ্ছে।
অপরদিকে, পুকুর খনন শিখতে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) ১৬ কর্মকর্তাকে ইউরোপ পাঠানোর প্রক্রিয়া আগেই চূড়ান্ত করেছে। এরপর কূপ খনন শিখতে অন্য আরেকটি প্রকল্পের আওতায় আরও ১৬ কর্মকর্তাকে ইউরোপ বা প্রশান্ত মহাসাগরীয় একটি দেশে পাঠানো হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় ৫০টি পাতকুয়া বা কূপ খনন করতে ব্যয় হবে ২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এ হিসাবে প্রতিটিতে ব্যয় হবে সাড়ে ৫ লাখ টাকা। আর ১৬ কর্মকর্তার বিদেশ ভ্রমণ বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ কোটি ২৮ লাখ টাকা। এ হিসাবে জনপ্রতি পাবেন ৮ লাখ টাকা। এ টাকা দিয়ে তারা অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, নেদারল্যান্ডসসহ যেকোনো একটি দেশ ভ্রমণ করবেন। এ সংক্রান্ত একটি প্রকল্প ইতিমধ্যে অনুমোদন পেয়েছে। বিএমডিএ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোনো কিছুই প্রশিক্ষণ ছাড়া সম্ভব না। কর্মকর্তারা প্রশিক্ষণ নিলে অনেক কিছু জানতে পারে। ইন্টারনেট থেকে অনেক কিছু জানা যায়, কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা নিতে সরেজমিন যেতে হয়।
উল্লেখ্য, বিএমডিএর পুকুর পুনঃখনন ও ভূ-উপরিস্থ পানি উন্নয়নের মাধ্যমে ক্ষুদ্র সেচে ব্যবহার শীর্ষক আরেকটি প্রকল্পের আওতায় ১৬ কর্মকর্তা বিদেশ সফর করবেন। এ জন্য ১ কোটি ২৮ লাখ টাকা ব্যয় হবে। বরেন্দ্র অঞ্চলে অনেক পুরনো যেসব পুকুর স্থানীয় লোকজন সেচের কাজে ব্যবহার করতেন, সেগুলো পুনঃখনন করা হবে। কর্মকর্তারা এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা নিতে বিদেশ যাবেন। গত ২৭ আগস্ট একনেক সভায় এই প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। প্রকল্পটির মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১২৮ কোটি ১৮ লাখ টাকা। এতে শুধু পুকুর খননের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৮৬ কোটি টাকা। পুকুরের ধারে গাছ লাগাতে দুই কোটি টাকা খরচ করা হবে।
এর আগে সরকারি কর্মকর্তাদের মাত্রাতিরিক্ত বিদেশ ভ্রমণ নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারপরও বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় বিদেশ ভ্রমণের ঝোঁক কমছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকল্প মানেই বিদেশ ভ্রমণ, এটা এক ধরনের নেতিবাচক প্রবণতা শুরু হয়েছে। যদিও এই বিদেশ ভ্রমণে কী জ্ঞান অর্জিত হলো তা মূল্যায়নের তেমন সুযোগ নেই। ফলে কূপ খনন শিখতে বিদেশ গিয়ে কতটা সুফল মিলবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।