কক্সবাজারের অপরাধ জগতের গডফাদার এসপি

অপরাধ আইন ও আদালত সারাদেশ

নিজস্ব প্রতিনিধি : অবসরপ্রাপ্ত সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের ক্রসফায়ারে হত্যা নিয়ে সংবাদ মাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়া সহ সর্বত্র ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা চলছে। সাব ইন্সপেক্টর লিয়াকত ছাড়াও হত্যার নির্দেশদাতা ওসি প্রদীপের বিতর্কিত নানা অপকর্মের তথ্যও প্রকাশিত হচ্ছে। ওসির অপকর্ম, দুর্নীতি, অত্যাচার ও স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে বহু সংবাদ আগেও বহুবার প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু মূলত যে বিষয় নিয়ে প্রশ্ন উঠছে তা হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট এসপি তথা কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএস মাসুদ হোসেনের ভূমিকা। করোনা মহামারিতে পুলিশের সেবা প্রদান সকল মহলে প্রশংসিত হয়েছে। অতীতের অনেক বিতর্ক ছাইচাপা দিয়ে পুলিশের আত্মত্যাগের বিষয় সামনে এসেছিল। এমন একটি সময় সকল অর্জন ম্লান করে দিয়ে সমালোচিত হচ্ছে রাশেদ সিনহা ইস্যু।


বিজ্ঞাপন

কক্সবাজারে মাদক নির্মুল অভিযানকে একটি স্বার্থান্বেষী মহল নিজেদের অর্থবিত্ত অর্জনের উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছে বলে যে অভিযোগ আছে, তাতে নতুন মাত্রা যোগ করলো এ হত্যাকাণ্ড। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, রাশেদ সিনহা সেনা কর্মকর্তা না হলে তাকে মাদক ব্যবসায়ী বা সন্ত্রাসী পরিচয় দিয়েই ঘটনা ধামাচাপা দেয়া হতো। শত অপরাধী ছাড় পেলেও নিরপরাধ কেউ যেন শাস্তি না পায় – এটা যদি আইনের শাসন হয়, তাহলে নিরীহ যাদেরকে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হয়েছে বা বড় অংকের টাকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছে, সেই দায় দায়িত্বপালনকারী কর্মকর্তার পাশাপাশি ওসি ও এসপিকেও সমানভাবে বহন করা উচিত। ইতিমধ্যে গণমাধ্যমে এসপি মাসুদ, ওসি প্রদীপ ও এসআই লিয়াকতের ফাঁস হওয়া ফোনালাপে মাসুদের সম্মতিতে গুলি চালানোর সত্যতা জানা গেছে।
মাসুদের দুর্নীতি ও অপরাধের রাজত্ব: কক্সবাজারে মাদক বিরোধী অভিযানের নামে দুর্নীতি ও অপরাধের যে রাজত্ব কায়েম হয় তার মূল পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এসপি মাসুদ। ওসি প্রদীপ বা লিয়াকতের মতো কয়েকজনের বিরুদ্ধে লাগাতার অভিযোগ এলেও, তিনি থেকেছেন ধরাছোয়ার সম্পূর্ণ বাইরে। অভিযুক্ত পুলিশের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা সীমাবদ্ধ থাকতো কক্সবাজারের এক থানা থেকে অন্য থানায় বদলি করার মাঝেই। পুলিশে কর্মরত অনেক কর্মকর্তা প্রদীপের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দিয়েও কোনো প্রতিকার পায় নি বলে জানা যায়। ক্রসফায়ারসহ মাদকের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান সত্ত্বেও মাদক সাম্রাজ্য যেমন ছিল তেমনই আছে, আর এ ব্যর্থতার দায়ভারও পুলিশ সুপার চাপিয়ে দিতেন অন্য বাহিনীর ওপর।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চেয়ে ক্ষমতাবান মাসুদ! : সবচেয়ে অবাক বিষয় হচ্ছে, আত্মসমর্পণের নামে মাদক ব্যবসায়ীদের সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেও মহেশখালীর ৬৮ জন জলদস্যুর আত্মসমর্পণের ক্ষেত্রে বাধা দিয়েছিল ওসি প্রদীপ। এ ঘটনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হয়ে প্রদীপকে সাসপেন্ড করার নির্দেশ দিলেও ১৫ দিনের মাথায় প্রদীপকে টেকনাফের ওসির দায়িত্ব দেন পুলিশ সুপার মাসুদ। অর্থাৎ প্রদীপ সিন্ডিকেটের মূল ব্যক্তি যে এবিএম মাসুদ হোসেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নিজেকে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে সকলের কাছে প্রচার চালাতো বলে অনেকেই তার অপরাধ ও অপকর্ম সম্পর্কে মুখ খোলার সাহস পেত না। মেজর রাশেদ ছাড়াও ক্রসফায়ারের নামে নিরীহ যাদেরকে হত্যা করা হয়েছে তার দায়ভার কোনভাবেই পুলিশ সুপার মাসুদ এড়াতে পারে না।
রাশেদ হত্যায় মাসুদের সম্মতি ছিল?: কক্সবাজারে সংগঠিত বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার যেকোনো সংবাদেই দেখা যায়, জেলার পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন উক্ত ঘটনার পক্ষে “প্রকৃত বন্দুকযুদ্ধ” – এই মর্মে যুক্তি প্রদান করেন। অর্থাৎ প্রতিটি ক্রসফায়ারের ক্ষেত্রেই দায়িত্বরত সাব ইন্সপেক্টর তার ওসির এবং ওসি, তার এসপির পরামর্শ মোতাবেক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বিশেষত স্পর্শকাতর বিষয়ের ক্ষেত্রে একজন ওসির পক্ষে পু‌লিশ সুপারের পরামর্শ ছাড়া সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ কম। এ কারণে রাশেদকে হত্যায় এসপির মাসুদেরও সম্মতি ছিল এমন গুঞ্জন রয়েছে।

রাশেদ হত্যাকাণ্ডে পুলিশ দুটি মামলা করেছে যা আমলে নেয়ার নূন্যতম সুযোগ নেই। একজন অবসরগ্রহণকারী সরকারী কর্মকর্তাকে গুলি করার ঝুঁকি একজন এসআই কখনোই নিবে না। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শিদের মতেও জানা যায়, লিয়াকত ওসি প্রদীপের সঙ্গে ফোনে কথা বলে গুলি করার অনুমতি নিয়েছিল। এখানে এসপির কাছ থেকে অনুমতি গ্রহণের দৃশ্যপটটি অনুপুস্থিত কারণ তা নিতে হয়েছে বা নেয়ার কথা ওসির।

রাশেদ হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে মাসুদের ভাষ্য: হত্যাকাণ্ডের পরই পু‌লিশ সুপার এবিএম মাসুদ হো‌সেন দাবি করেন, শামলাপু‌রের লোকজন ডাকাত স‌ন্দেহ ক‌রে পু‌লিশকে খবর দেয়। এ সম‌য়ে পু‌লিশ চেক‌পো‌স্টে গা‌ড়ি‌টি থামা‌নোর চেষ্টা ক‌রলে গা‌ড়ির আরোহী পিস্তল বের ক‌রে পু‌লিশ‌কে গু‌লি করার চেষ্টা ক‌রেন। আত্মরক্ষা‌র্থে পু‌লিশ গু‌লি চালায়। এ ছাড়া গা‌ড়ি‌তে তল্লাশি ক‌রে ৫০টি ইয়াবা, কিছু গাঁজা এবং দুটি বি‌দেশি ম‌দের বোতল উদ্ধার করা হ‌য়ে‌ছে বলেও মন্তব্য করেন।

বিষয়টি যদি এমন হতো যে, এসপির অনুমতি ছাড়াই হত্যা করা হয়েছে, তাহলে এ ঘটনা জানা মাত্রই এসপি মাসুদ অন্তত নিজের ভাবমূর্তি রক্ষা ও সততার দৃষ্টান্ত স্বরূপ ওসি ও এসআইয়ের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতো। কিন্তু উক্ত ঘটনায় দুদিন পর দায়িত্বরত পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে প্রত্যাহার করা হলেও দায়িত্বে ছিলেন ওসি প্রদীপ কুমার দাস।
পুলিশ সুপারের সম্মতি ছাড়া হত্যাকাণ্ড ঘটলে, হত্যাকারীদের পক্ষে তার বিতর্কিত ভূমিকার কারণ একটিই হতে পারে, তা হচ্ছে বহুল আলোচিত আর্থিক ভাগ-বাটোয়ারা প্রসঙ্গ। অর্থাৎ ২০১৮ এর সেপ্টেম্বর থেকে শুধুমাত্র পুলিশের দ্বারা যে দেড় শতাধিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তার নেপথ্যে মূল ভূমিকা পালন করেছেন পুলিশ সুপার মাসুদ।

মাদক বাণিজ্যের মূল গডফাদার মাসুদ: ইয়াবার নামে হয়রানি, মিথ্যা মাদক মামলায় ফাঁসিয়ে অর্থ আদায় ছাড়াও ক্রসফায়ারে সংঘটিত প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পর মৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে মাদক, অস্ত্র ও হত্যা, তিনটি মামলা দায়ের করে ধনাঢ্য ব্যক্তি ও পরিবার পরিজনকে ফাঁসিয়ে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে।