রেল উন্নয়নে কচ্ছপ গতি!

অর্থনীতি এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন

নিজস্ব প্রতিবেদক : অবহেলায় পড়ে থাকা রেলের উন্নয়নে নজর দিয়েছে সরকার। এ মুহূর্তে বড় বড় ৪০টিরও বেশি প্রকল্পের কাজ চলছে। তবে প্রকল্প শুরুর পর ব্যয় বৃদ্ধিসহ নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়া বড় সমস্যা হিসেবে দাঁড়িয়েছে। কোনও কোনও প্রকল্পে ২শ’ শতাংশ ব্যয় বৃদ্ধির নজির আছে। শুরু হওয়া প্রকল্পগুলোর গতি হ্রাসের কারণে অতিরিক্ত ব্যয় ও সময় অপচয়ের বিষয়ে উদ্বিগ্ন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। এছাড়া অনিয়ম ও দূর্নীতি ম্লান করছে সরকারের উন্নয়ন কর্মকা-কে।
সম্প্রতি ‘সিগন্যালিংসহ টঙ্গী-ভৈরববাজার সেকশনে ডাবল লাইন নির্মাণ’ প্রকল্পটি নিয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সমাপ্ত প্রকল্পের প্রভাব মূল্যায়ন সমীক্ষায় দ্বিতীয় খসড়া প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে। আইএমইডি সরকারের একমাত্র প্রকল্প তদারকি সংস্থা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্র্যাকের কতিপয় স্থানে কুশন ব্যালাস্ট নিচু হয়ে গেছে ফলে নৈমিত্তিক রক্ষণাবেক্ষণ জোরদার করা প্রয়োজন রয়েছে। এছাড়া প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ চলাকালীন অবস্থায় চারটি ব্রিজ মাটি দিয়ে ভরাট করার কারণে পানি চলাচল বিঘিœত হয়েছে। চালু করা প্রয়োজন বন্ধ হওয়া ব্রিজগুলো।
এ বিষয়ে আইএমইডির পরিচালক (পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন সেক্টর-০২ পরিবহন) আবদুল্লাহ আল মামুন গণমাধ্যমকে বলেন, সমাপ্ত হওয়া ‘সিগন্যালিংসহ টঙ্গী-ভৈরববাজার সেকশনে ডাবল লাইন নির্মাণ’ প্রকল্পটি সরেজমিনে পরিদর্শন করে কিছু দুর্বল দিক খুঁজে পেয়েছি। ট্র্যাকের কতিপয় স্থানে কুশন ব্যালাস্ট নিচু হয়ে গেছে ফলে নৈমিত্তিক রক্ষণাবেক্ষণ জোরদার করার প্রয়োজন রয়েছে। তাদের কাছে (বাংলাদেশ রেলওয়ে) প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। তারা এই বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।’
এক প্রতিবেদনে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের নানা দুর্বল দিক তুলে ধরা হয়েছে। সেগুলো হলো- প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়া। মূল ডিপিপিতে ৫ বছরের পরিবর্তে ১২ বছর বা ২৪০ শতাংশ অধিক সময় প্রয়োজন হয়েছে। এছাড়া প্রকল্পের আওতায় দুটি স্টেশন জনবলের অভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। চারটি ব্রিজ মাটি দিয়ে ভরাট করে পানি যাতায়াত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ব্যালাস্ট ওয়াল না থাকায় বিভিন্ন জনবসতিপূর্ণ এলাকায় ব্যালাস্ট অপচয় হয়েছে। স্টেশনে নারীদের জন্য পৃথক টয়লেট ও বিশ্রামাগার রাখা হয়নি। এছাড়া অনুমোদিত লেভেল ক্রসিংয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা হয়নি।
জানা গেছে, মূল প্রকল্প ব্যয় ছিল মাত্র ৭২৪ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। প্রকল্পটি প্রথম সংশোধনীতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ১৭৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এর বিপরীতে প্রকৃত ব্যয় হয়েছিল ২ হাজার ১৭৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। ফলে মূল প্রকল্প থেকে প্রকল্পের মোট ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২০০ দশমিক ১৯ শতাংশ। ব্যয়ের পাশাপাশি বৃদ্ধি করা হয়েছে মেয়াদও। প্রকল্পটি ২০০৬ সালের জুলাই থেকে ২০১১ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্য ঠিক করা হয়। পরে প্রথম সংশোধনী এনে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। কাজ শেষ না হওয়ায় দ্বিতীয় সংশোধনী আনা হয় ২০১৬ সালের জুনে, পরের দফায় ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। শেষ পর্যন্ত ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়িয়ে ১২ বছরে প্রকল্পের কাজ শেষ করা হয়।
এদিকে, পদ্মা সেতুর দুই পাড় ও ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত নতুন রেললাইন নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারের খরচ ৭৯ কোটি ৪১ লাখ টাকা। এর এক বছর পর চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে নতুন লাইন নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারের খরচ ধরা হয় ৪৪ কোটি ৭১ লাখ টাকা। টঙ্গী-ভৈরব বাজার ডাবল লাইনে নির্মাণে ব্যয় বেড়েছে প্রায় ২শ’ গুণ, সময় লেগেছে ১৪০ শতাংশ বেশি। লাকসাম থেকে চিকনী পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণে ব্যয় বেড়েছে ২শ’ ৬০ শতাংশ। টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত ডাবল লাইন নির্মাণে শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮শ’ ৪৭ কোটি টাকা। ২০১২ সালের এ প্রকল্পে আবার ৩শ’ কোটি টাকা বাড়লেও কাজ এগোয়নি। কয়েকটি ছোট কালভার্ট নির্মাণ ছাড়া লাইন নির্মাণে খুব একটা অগ্রগতি নেই।
নানা জটিলতায় প্রকল্প পরিচালকও বদল করা হয়েছে। নতুন পিডি জানালেন, নানা সমস্যার কারণে কাজের ধীর গতি। পিডি বলেন, বনানী থেকে মালিবাগ পর্যন্ত এলিভেটর এক্সপ্রেসের অ্যালাইনমেন্টের সাথে রেলেলাইনের কিছু কনফিলিট আছে, সেখানে জায়গার সীমাবদ্ধতা আছে।
এ বিষয়ে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, সব প্রকল্পেই জটিলতা থাকে। তাই নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়ন করাটা কঠিন। যখন আপনি কাজ করতে গেলেন, তখন দেখবেন যে ওই বাজেটে কাজ হচ্ছে না। স্টেশন বিল্ডিং করা হচ্ছে তখন যদি বলা হয় এ ধরনের নয় অন্যভাবে করতে হবে। তখন কিন্তু আমাদের চাহিদার উপর নির্ভর করে কিছুটা ভেরিয়েশন আসে। চলমান প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে রেল যোগযোগ নতুন মাত্রা পাবে বলে আশাবাদী রেল কর্তৃপক্ষ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাস্তবতার সাথে মিল রেখেই প্রকল্প নেয়া উচিত। বুয়েটের গণপরিবহন ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, যেটা আমরা আস্তে আস্তে দেখতে পাচ্ছি প্রজেক্টের আওতায় যারাই জড়িত তারাই ভেনিফিসিয়ারি হয়ে যাচ্ছেন। তখন সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসে, আসলে অ্যাকাউনটিবিলিটা তাহলে কে আদায় করবে? এটা কিন্তু শঙ্কার ব্যাপার, এটা কিন্তু ভাবনার ব্যাপার।
অপরদিকে, মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের আওতাধীন ৯০ একর জমির ওপর দিয়ে রেলপথ নির্মাণ নিয়ে বিরোধ রয়েছে। এর ফলে প্রকল্পটির কাজ কবে শেষ হবে তা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। মংলা বন্দর থেকে সড়কপথে যোগাযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে খুলনা পর্যন্ত ৬৫ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প নেয়া হয় ২০১০ সালে। শুরুতে তিন বছরের মধ্যে ওই প্রকল্পের সকল কাজ শেষ করার সময় নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত তিন দফা সময় বাড়িয়ে ১০ বছরেও শেষ হয়নি চলমান রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটি।
মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের আওতাধীন ৯০ একর জমির ওপর দিয়ে রেলপথ নির্মাণ নিয়ে বিরোধ রয়েছে। এর ফলে প্রকল্পটির কাজ কবে শেষ হবে তা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। সম্প্রতি মংলা-খুলনা রেলপথ নির্মাণ কাজের অগ্রগতি নিয়ে পর্যালোচনা করে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। তাতে দেখা যায়, ১০ বছরে ওই প্রকল্পের ৬৯ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
জানা যায়, রেলপথ নির্মাণ কাজের শুরুতে মংলা বন্দরের মধ্যে কিছু রেল স্ট্যাক করার কারণে বন্দর কর্তৃপক্ষ ও ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ইরকনের মধ্যে সংকট তৈরি হয়। এতে আটকে যায় প্রকল্প কাজের অগ্রগতি। ফলে ১০ বছরের বেশি সময় পার হলেও তিন বছরের প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৬৯ শতাংশ। এর মধ্যে প্রকল্পের মূল কাজ রেলপথ নির্মাণে অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৫৪ শতাংশ। এরই মধ্যে তিন দফা বাড়ানো হয়েছে কাজের ব্যয় ও মেয়াদ। ফলে ব্যয় বেড়েছে প্রায় ১২১ শতাংশ।
মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক (প্রশাসন) মো. গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘চলমান খুলনা-মংলা রেলপথ নির্মাণ কার্যক্রমে সার্বিক সহযোগিতা করা হচ্ছে। প্রকল্পটি এ অঞ্চলের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। জমি সংক্রান্ত বিষয়গুলো সংশ্লিষ্টরা গুরুত্ব সহকারে দেখছেন। ফলে জমি নিয়ে বিরোধ দূর হয়ে যাবে।’
এর মধ্যে চীন সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে নেওয়া তিনটি (জিটুজি) প্রকল্পে অতীতের প্রায় সব নজির ছাড়িয়ে গেছে। চীনের সঙ্গে আরও বেশ কিছু প্রকল্প জিটুজি পদ্ধতিতে বাস্তবায়নের আলোচনা চলছে।
ভারতের ঋণে সাতটি প্রকল্প চলমান। জিটুজি পদ্ধতি না হলেও এসব প্রকল্পের পণ্য ও সেবা ৬৫ থেকে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত ভারত থেকে নেওয়ার শর্ত আছে। ভারতীয় ঋণে রেলে ছয়টি প্রকল্প সম্পন্ন হয়েছে। বেশির ভাগই ইঞ্জিন-কোচ ও মালবাহী ওয়াগন বা ট্যাংকার কেনার প্রকল্প। ফলে প্রায় শতভাগ পণ্য ভারত থেকেই কেনা হয়েছে।
গত এক দশকে রেলে ছোট-বড় ৬৪টি প্রকল্প সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে ৩৭টি ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠনের পর নেওয়া হয়। বাকিগুলো আগেই নেওয়া। তবে শেষ হয় ২০০৯ সালের পর। বড় প্রকল্পের প্রায় সব কটিই বিদেশি অর্থায়নে বাস্তবায়িত হয়েছে।


বিজ্ঞাপন