অভয়নগরে ইউএনও ও পিআইও’র বিরুদ্ধে নারী প্রোগ্রামারকে যৌন হয়রানীর অভিযোগ

অপরাধ খুলনা সারাদেশ

প্রকল্প কর্মকর্তা স্টান্ড রিলিজঃ তদন্ত কমিটি গঠন


বিজ্ঞাপন

 

নিজস্ব প্রতিবেদক, যশোর : যশোরের অভয়নগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল হুসাইন খাঁন ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) শরিফ মোহাম্মাদ রুবেল-এর বিরুদ্ধে এক সহকারী নারী প্রোগ্রামারকে যৌন হয়রানীর অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই অভিযোগ করেছে উপজেলার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের সহকারী নারী প্রোগ্রামার উত্তরা শতুদ্রু প্রাচী।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের সহকারী নারী প্রোগ্রামার উত্তরা শতুদ্রু প্রাচী প্রতিকার চাওয়া এবং সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরে বিচারের দাবীতে অভিযোগ করায়, তাকে বদলির আদেশ দিয়েছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তর মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলায়। এই নিয়ে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝঁড় বইছে। ঘটনার পর প্রকল্প বাস্তাবায়ন কর্মকর্তা শরীফ মোহাম্মাদ রুবেলকে তার অধিদপ্তরে স্টান্ড রিলিজ করা হয়েছে। তবে বহাল তবিয়াতে রয়েছেন যৌন নির্যাতনকারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ নাজমুল হুসাইন খাঁন। বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে। সাধারন মানুষের প্রশ্ন সঠিক তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত দোষী ব্যাক্তির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
প্রোগ্রামার উত্তরা শতুদ্রু প্রাচী বিগত ২২ডিসেম্বর তার কার্যালয়ের ৫৬.০৪.৪১০৪.০০০.২৭.০০১.২০-২ নং স্মারক পত্রের মাধ্যেমে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ঢাকা বরাবর কর্মস্থলে যৌন হয়রানী ও জীবননাশের হুমকির অভিযোগ দাখিল করেন। ওই অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন, বিগত ৪ মার্চ অভয়নগর উপজলায় সহকারী প্রোগ্রামার হিসেবে যোগদান করেন। কর্মস্থলে যোগদানের পর থেকে সততার সাথে দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু শুরু থেকেই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ নাজমুল হুসেইন খাঁন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ সম্পর্কে অকথ্য ভাষায় গালগালাজ করেন এবং অন্য সহকর্মীদেরও এ্কই ভাষায় গালিগালাজ করেন। অফিসের নির্ধারিত সময়ের পর গভীর রাত পর্যন্ত অফিসে থাকতে বাধ্য করেন। নির্বাহী কর্মকর্তা তারই ধারাবাহিকতাই প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা শরিফ মোহাম্মদ রুবেলের মাধ্যমে তাকে খারাপ প্রস্তাব দেন। তাদের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় সর্বশেষ প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাকে দিয়ে হত্যার হুমকি দেন। যে কারণে তিনি মান-সম্মান ও আত্মমর্যদা নিয়ে চাকরি করতে মহাপরিচালকের হস্থ্যক্ষেপ কামনা করেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উত্তরা শতুদ্রু প্রাচী বলেন, প্রথমে তাদের যৌন লালসার ইঙ্গিত বুঝতে পারতাম না। পরে তারা আমাকে সরাসরি সঙ্গ দেবার প্রস্তাব দেয়।
তিনি আরো বলেন, ‘প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ইউএনও স্যারের হয়ে বলতেন, ‘আমি কেন ইউএনও স্যারের হতাশা দূর করি না। এই হতাশা অন্য কোন নারী কাটাতে পারে, স্ত্রী কাটাতে পারে না।’ ইউএনও স্যার আমাকে বলেছেন প্রশিক্ষণে যাবার সময় প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাকে আমার সাথে পাঠাবেন। করোনা প্যান্ডামিকের সময় আমি যেন পিআইও’র সাথে মোটরসাইকেলে খুলনায় আসা-যাওয়া করি। কারন হলো আমরা দু’জন খুলনা থেকে এসে অফিস করতাম। আমি যেতে রাজি হয়নি। আমার মা-বাবা আমাকে নিতে আসতেন। স্যার একদিন বললেন ওনাদের আসার কি দরকার। রাতে আপনাকে আকিজে সিট করে দিতে বলি। পিআইও, আমরা সবাই একসাথে না হয় থাকলাম। আমি প্রথমে বুঝিনি আকিজ কি। পরে জানতে পেরেছি আকিজ অফিসের পাশেই একটি সিটি। যেখানে হোটেলসহ অনেক কিছুই আছে। এধরণের অনেক নোংরা কথা বলা হতো আমাকে।
উত্তরা আরো বলেন, পিআইও সাহেব ঈদের মধ্যে আমাকে অনেক কিছু কিনে দিতে চেয়েছেন। সেদিন যখন হতাশা দূর করার কথা বললেন তখন বললাম দেখেন ভাই একেক জনের হতাশা একেকভাবে দূর হয়। আমিও হতাশ হই। তখন ঘুরে, ছবি তুলে শপিং করে, সিনেমা দেখে হতাশা কাটাই। তখন তিনি বললেন তাহলে একটা ড্রিল করা যাক আপনি যখন হতাশ থাকবেন তখন আমরা আপনার হতাশা কাটাবো। মানে আমাদের টাকায় ঘুরলাম, শপিং করলাম, সিনেমা দেখলাম। আর আমরা যখন হতাশায় থকবো তখন আপনি আমাদের একটু সঙ্গ দেবেন। এরপর আমি তার কক্ষ থেকে বেরিয়ে যাই।
তিনি আরো বলেন, কাজের অজুহাতে আমাকে বিকেল ৫টার পরও অফিস থাকতে বাধ্য করা হয়। যখন আসলে অফিসে কেউ থাকেন না। গত ২২ ডিসেম্বর বিকেল ৪টা ৫২ বাজে আমি গুছিয়ে অফিস থেকে বের হচ্ছিলাম। সেসময় পিআইও সাহেব আমাকে ফোন দিয়ে জানতে চায় কোথায় আছি। আমি বলি অফিসে আছি। কেন কি হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন আগামীকালের জন্য একটা কাজ আজকেই করতে হবে। পাশে থেকে ইউএনও স্যার বলেন দুপুর ১২টার মধ্যে লাগবে। এমনিতে আমাকে কাজের নামে অনেক প্রেশার দিয়ে রাখা হত। আমিতো আমার চাকরি আমার দপ্তরের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। আমাকে দিনের বেশিরভাগ সময় ইউএনও স্যারের কাজে ব্যাস্ত রাখা হত। সবশেষে আমি বললাম ঠিক আছে আমি কাজটা করবো। কিন্তু আমাকে একটা জনবল দেন। ওটাতো কম্পিউটার অপারেটরের কাজ। জনবল চাইলে জয়নাল নামের একজনের কথা বলে। আমি তখন বলি আমি জয়নালকে এ্যাসিস্ট করে দেব যাতে উনি কাজটা করতে পারেন। তাছাড়া আমার উপর আপনাদের অফিসের অনেক কাজের লোড রয়েছে। তখন পিআইও বলেন ওকে কাজ দেখালে হবে না আপনাকেই করতে হবে। আমি বললাম আমাকেতো ফিল্ডে রাখা হয়েছে। আমি ফিল্ডে থাকি কিনা তা তদারকি করা হয়। ৪০ দিনের কর্মসৃজনের কাজে প্রতিদিন মাঠে যেতে হয় আবার বিকেল ৪টার মধ্যে ইউএনও স্যারকে রিপোর্ট করতে হয়। আমি ফিল্ডে না গেলে আমাকে শোকজ করা হবে, এই কাজও না করলে শোকজ করা হবে আমি কই যাবো। আমি সেজন্য জনবল চাইলাম। এতে তিনি ক্ষিপ্ত আমাকে মারপিট করে ছিড়ে ফেলে দেবার হুমকি দিলেন। বললেন তিনি খুলনার বড় রঙবাজ। আমাকে দেখে নেবে। উনি আমাকে এভাবে বলতে পারেন না। আমি একজন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা আর পিআইও দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা। তিনি মূলত ইউএনও স্যারের শেল্টারে এসব কথা আমাকে বলেন। কিছুক্ষন পর ইউএনও স্যার পিআইওকে ফোন কেটে দিতে বলেন। এরপর ৫টা ৩ মিনিটের দিকে ইউএনও স্যারের অফিস থেকে একজন লোক একটা চিঠি নিয়ে এসে বললেন আপনাকে থাকতে হবে। তখন আমি তালা দিয়ে অফিস থেকে বের হয়েছি। আমার সাথে আমার মা ছিলেন তিনি বললেন ৫টার পরও থাকতে হবে। তখন ওই লোকটা বললেন কি করবো আমরাতো হুকুমের গোলাম। তখন আমি আমার সিনিয়র স্যারদের ফোন করে বিষয়টি জানালাম। বললাম আজও আমাকে ৫টার পরে থাকতে বলা হয়েছে। তখন স্যাররা আমাকে জানালেন যেন আমি চলে যাই। এরপর আবার ফোন করে পিআইও আমাকে মারপিট করাসহ জীবন নাশের হুমকি দেন এবং অভয়নগরে না ঢোকার জন্যেও হুমকি দেন। একপর্যায়ে ভয়ে আমি জীবন নিয়ে পালিয়ে এসেছি। এরপর আর অফিসে যায়নি। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সহায়তা ছুটি নিয়েছি এবং মহাপরিচালক বরাবর অভিযোগ দিয়ে সহায়তা চেয়েছি।
উত্তরা শতুদ্রু প্রাচী বলেন, ডিপার্টমেন্ট আমাকে সেফ করার জন্য বদলি করছে। তবে আমি এর বিচার চাই। আমাকে এ বিষয়ে কথা না বলতেও ফোন বন্ধ রাখতে চাপ দেয়া হচ্ছে। আমি চাপ উপেক্ষা করে ফোন খোলা রেখেছি। দু:খ হয়, মেয়ের নিরপত্তা চেয়ে আমার মা-বাবা থানায় জিডি করতে গিয়েছিল কিন্তু পুলিশ তা নেয়নি।
উত্তরা আরো বলেন, আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি এর আগের স্টেশনে ইউএনও স্যারের বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগ ছিলো। আর পিআইও সাহেব তো তার আগের স্টেশনে ইউএনও’র মাথা ফাটিয়েছিলেন। এই নিয়ে তার দুই বছর বেতনও বন্ধ ছিলো।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে পিআইও শরিফ মোহাম্মদ রুবেল বলেন, ‘আমি আল্লাহর কসম দিয়ে বলছি আমি কোন খারাপ প্রস্তাব দেয়নি। উত্তরাকে ট্যাগ অফিসার নিয়োগ করেছেন ইউএনও স্যার। আমি কাজ বুঝে নিতে চাইলে কাজ বুঝিয়ে দিতেন না। অফিস ফাঁকি দিতেন। আমি তাকে বোন বলে সম্মোধন করতাম। আমি তাকে কোন ধরণের বাজে কথা বলিনি। ইউএনও স্যার একজন ভালো মানুষ অথচ উনি আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করেছেন। এই কথা শোনার পর আমি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলাম। আমার স্ত্রী-সন্তান আছে, উত্তরা এভাবে আমাদের হেয় না করলেও পারতেন। বিষয়টি ভাবতেও খুৃব দুঃখজনক।
জানতে চাইলে ইউএনও নাজমুল হুসেইন খান বলেন, সহকারী প্রোগ্রামার কর্মস্থলে যোগদানের পর থেকে অফিসে সময় দিতেন না। মহান বিজয় দিবসের দায়িত্ব করোনার দায়িত্ব তিনি পালন করেন না। সর্বশেষ তাকে ৪০দিনের কর্মসৃজনের কাজে ট্যাগ অফিসার নির্ধারণ করা হয়। এতে তিনি ফাঁকি দিতে পারছিলেন না। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর ঘর দেয়ার প্রকল্পের একটি চিঠি দেয়ার শেষ দিন ছিল ২৩ ডিসেম্বর। ২২ ডিসেম্বর পিআইও তাকে ফোন দিয়েছিলেন। তাকে কাজটা করে দিতে সহযোগীতা করতে অনুরোধ করেন। কিন্তু ৫টার বাজায় সহকারী প্রোগ্রামার উত্তরা শতুদ্রু অফিস ত্যাগ করেন। এ নিয়ে তাদের কথা কাটাকাটি হয়েছে। এসময় উভয় কিছু আপত্তিকর কথা বলেছে। কিন্তু উত্তরা অডিও এডিট করে অপপ্রচার শুরু করেছে। কোন প্রমাণ ছাড়াই আমাকে জড়িয়েও আপত্তিকর অভিযোগ দেয়া হয়েছে। আমার রুমে সিসি ক্যামেরা দেওয়া আছে। আমিসহ অফিসে আগত সকলকে দেখা ও কথা রেকর্ড করা হয়। কেউ কখনো বলতে পারবে না আমি কোন নারী সহকর্মী বা পুরুষ সহকর্মীর সাথে বাজে ব্যবহার করেছি। আপনারা গোপনে এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন।
ইউএনও আরো বলেন, অবারিত ছুটি কাটাতে না পারায় তিনি আমাকে জড়িয়ে এসব অভিযোগ করছেন। আমার জানা মতে পিআইও তাকে কখনো উত্যক্ত করেনি। তারপরও বিষয়টি তদন্ত হোক। তাহলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। এছাড়া এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন আমি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর পাঠিয়েছি।
যশোরের জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান অভিযোগের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, অভিযোগ শোনার পরে আমি বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণভাবে খতিয়ে দেখছি। ইতোমধ্যে বিষয়টি তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত করে যদি যৌন হয়রানির সত্যতা মেলে অবশ্যই ওই দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।