ট্যারিফ ভ্যালু আর খুচরা পর্যায়ে বিক্রয়মূল্যের আকাশ-পাতাল ফারাক!

এইমাত্র অর্থনীতি

নিজস্ব প্রতিবেদক : আমদানিকৃত কাপড়ের কম মূল্য দেখানোর পর বাদবাকি অর্থ অবৈধ উপায়ে হুন্ডি কিংবা কোনো কোনো ব্যাংকের যোগসাজশে রপ্তানিকারকের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। যা অর্থপাচার হিসেবে বিবেচিত। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকে একশ্রেণির ব্যাংক কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট দেশের রপ্তানিকারকও। এমন পরিস্থিতিতে বস্ত্র শিল্প মালিকদের দাবির প্রেক্ষিতে সম্প্রতি ট্যারিফ কমিশনকে ইস্যুটি নিয়ে পর্যালোচনা করার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নির্দেশ দেয়। ওই প্রেক্ষিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে অতিসম্প্রতি ট্যারিফ কমিশন দুটি সুপারিশ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। সেগুলো হলো, আমদানিকৃত কাপড়ের ট্যারিফ মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারদরের ভিত্তিতে ঠিক করা এবং ওভেন কাপড় পরিমাপের মানদ- কেজির পরিবর্তে মিটারে নির্ধারণ করা।
সূত্রে জানা গেছে, আমদানিকৃত কাপড়ের ট্যারিফ ভ্যালু আর খুচরা পর্যায়ে বিক্রয়মূল্যের মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক। মূলত পুরো প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের জবাবদিহিতা না থাকায় রাজস্ব বিভাগ, স্থানীয় শিল্পোদ্যোক্তাদের পাশাপাশি ক্রেতারাও ঠকছে। আর অস্বাভাবিক মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে কেবল আমদানিকারক ও বিক্রেতারা। পাশাপাশি রপ্তানির শর্তে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা (বন্ড সুবিধা) কাপড়ও এসব কাপড়ের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। দেশে ওভেন ও নিটওয়্যারের ভিন্ন ভিন্ন এইচএস কোডের (পণ্য পরিচিতি নম্বর) আওতায় ৭ ধরনের কাপড় বেশি আমদানি হয়। এনবিআরের তথ্যানুযায়ী সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে ওসব কাপড় আমদানির পরিমাণ ছিলো ৩ লাখ ৩৫ হাজার ৭৯৩ মেট্রিক টন। তার মধ্যে রপ্তানির জন্য আমদানি হয়েছে ২ লাখ ৯৭ হাজার ১৯৯ মেট্রিক টন। ওসব কাপড় শুল্কমুক্ত সুবিধায় আসে, যা বন্ড সুবিধা নামে পরিচিত। আর বাণিজ্যিক আমদানি হিসেবে বাদবাকি ৩৮ হাজার ৫৯৪ মেট্রিক টন কাপড় এসেছে। ওসব কাপড়ের ওপর শুল্ককরের পরিমাণ প্রায় ৯০ শতাংশ।
কাপড়ের আমদানি মূল্যে ভয়াবহ জালিয়াতি চালিয়ে যাচ্ছে এক শ্রেণীর আমদানিকারক। তারা কাপড়ের প্রকৃত মূল্যের চেয়ে অনেক কম দরে আমদানি দেখাচ্ছে। শার্ট ও প্যান্ট জাতীয় পোশাকের কাপড় ফেব্রিকের বিশ্বব্যাপী পরিমাপের মানদ- হিসেবে মিটার ব্যবহার করা হলেও বাংলাদেশে তা কেজিতে মূল্যায়িত হয়। আর এই সুযোগে একশ্রেণির আমদানিকারক কারসাজি চালিয়ে যাচ্ছে। মূলত আন্তর্জাতিক বাজার দরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ট্যারিফ ভ্যালু (সরকার কর্তৃক মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া) না থাকায় আমদানিকারকরা আমদানিকৃত কাপড়ের প্রকৃত মূল্য অনেক কম দেখাচ্ছে। ফলে একদিকে সরকার যেমন ন্যায্য রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়ছে স্থানীয় বস্ত্রশিল্প। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সূত্র আরো জানায়, বন্ড সুবিধার আওতায় রপ্তানিকারকরা ৮৫ শতাংশ তুলায় উৎপাদিত ওভেন কাপড় প্রতি কেজি ৭৪২ টাকায় আমদানি করেছে। অথচ একই কাপড় বাণিজ্যিক (শুল্ক প্রযোজ্য) আমদানিকারকরা আমদানি মূল্য দেখিয়েছে প্রতি কেজি মাত্র ২৭৬ টাকা। অথচ এটির ট্যারিফ ভ্যালু ৩ মার্কিন ডলার বা প্রায় ২৫৫ টাকা। একইভাবে সিনথেটিক ফিলামেন্ট ইয়ার্নের কাপড় প্রতি কেজি রপ্তানিকারকরা গড়ে ৭০৬ টাকায় আমদানি করলেও বাণিজ্যিক আমদানিকারকরা দেখিয়েছে ২৭২ টাকা। এর ট্যারিফ ভ্যালু প্রতি কেজিতে ৪ ডলার বা ৩৪০ টাকা। শুল্কমুক্ত সুবিধার আওতায় আনা আর্টিফিশিয়াল স্টেপল ফাইবারের কাপড়ের কেজিপ্রতি গড় আমদানি মূল্য ৬৯৮ টাকা আর বাণিজ্যিক আমদানিকারকরা দেখিয়েছে ২৬৯ টাকা। অন্যান্য কাপড়ের দামের ক্ষেত্রেও একইভাবে শুল্কযোগ্য কাপড়ের মূল্য খুবই কম দেখানো হচ্ছে।
এদিকে স্থানীয় বস্ত্র শিল্পের উদ্যোক্তা ও এনবিআরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, রপ্তানির জন্য আনা কাপড়ে কোনো শুল্ক নেই। সেজন্য তাদের মূল্য কম দেখানোর দরকার নেই। অর্থাৎ কিছু ব্যতিক্রম বাদে তাদের আমদানিকৃত গড় মূল্যই আন্তর্জাতিক বাজারে কাপড়ের দামের মানদ-। এর নিচে যে দর দেখানো হচ্ছে তা মূলত ওই পরিমাণ আমদানি মূল্য কম দেখানো হচ্ছে। এ কৌশলে সরকার নির্ধারণ করে দেয়া ট্যারিফ ভ্যালুর কাছাকাছি দেখানো হয়। আমদানি মূল্য যাই হোক, ট্যারিফ ভ্যালুর ওপরই শুল্ককর নির্ধারণ হয়। ফলে এ সুযোগটি নিচ্ছে বাণিজ্যিক আমদানিকারকরা। ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনও প্রায় একই কথা বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়, বন্ডের মাধ্যমে আমদানিতে কোনো প্রকার শুল্ক না থাকায় আমদানি মূল্যকে ফেব্রিকের আন্তর্জাতিক মূল্য হিসেবে বিবেচনা করা যায়। অপরদিকে বাণিজ্যিক আমদানিতে অধিকহারে শুল্ক থাকায় আমদানি মূল্য অনেক কম দেখা যাচ্ছে। মূলত শুল্কের কারণে ফেব্রিকের আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য অপেক্ষা কম মূল্যে আমদানিকৃত কাপড় শুল্কায়িত হওয়ার প্রবণতা রয়েছে। স্থানীয় আমদানিতে সরকার যে হারে ট্যারিফ মূল্য নির্ধারণ করেছে, তা আন্তর্জাতিক বাজার ও স্থানীয় উৎপাদন মূল্য অপেক্ষা অনেক কম। ফলে স্থানীয় উৎপাদনকারীরা অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়ছে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে টেক্সটাইল মিল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সাবেক পরিচালক ও লিটল গ্রুপের চেয়ারম্যান খোরশেদ আলমের মতে, ট্যারিফ ভ্যালু কম থাকায় একশ্রেণির আমদানিকারক বছরের পর বছর ধরে এই অনিয়ম করে আসছে। ফলে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে এবং স্থানীয় শিল্প মালিকরা প্রতিযোগিতার মুখে পড়ে ব্যবসা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। ট্যারিফ ভ্যালু ছাড়াও কেজিতে ওভেন ফেব্রিকের শুল্কায়ন করার সুবিধা থাকায় এতে বিরাট কারসাজি হচ্ছে। অথচ বিশ্বব্যাপী কোথাও ওভেন কাপড় কেজির হিসাবে শুল্কায়ন করা হয় না। এ সুযোগে কম দাম দেখিয়ে বাকি টাকা অন্যভাবে বিদেশে পাঠানো হচ্ছে। আর দামের তারতম্য দেখিয়ে জালিয়াতের এ বিষয়টি এনবিআরের শুল্ক বিভাগেরও অজানা নয়।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে এনবিআরের শুল্ক বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, তথ্য-উপাত্ত দিয়ে এনবিআরের কাছে পাঠানো হলে তা যাচাই করে যৌক্তিক ট্যারিফ ভ্যালু নির্ধারণের উদ্যোগ নেয়া হবে।
আর এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনিশ জানান, ট্যারিফ কমিশনের পাঠানো সুপারিশ এখনো হাতে পায়নি। বিষয়টি বিস্তারিত পর্যালোচনা করে মন্ত্রণালয় থেকে পরবর্তী উদ্যোগ নেয়া হবে।


বিজ্ঞাপন