বেড সংকটে ঝুঁকি বাড়াছে

এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন স্বাস্থ্য

দেশে ৯ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ শনাক্ত, মৃত্যু ৩৫


বিজ্ঞাপন

 

 

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডের বাসিন্দা সালমা সুলতানা। বেড পাননি বলে বেসরকারি তিনটি ও সরকারি দুটি হাসপাতালে ভর্তি হতে চেয়েও পারেননি। অগত্যা বাসাতেই করোনার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলো। কিন্তু মাকে চিকিৎসা দিতে গিয়ে ছেলে তানভীর হায়দার এবং ছেলের বউ আফরোজা নাজনীনও হলেন সংক্রমিত।
তানভীর বলেন, ‘মায়ের সঙ্গে আমিই হাসপাতালে থাকতাম। তাতে আমি হয়তো আক্রান্ত হতাম। কিন্তু আফরোজা হতো না। এখন সে আক্রান্ত হওয়ায় আমাদের তিন ছেলে-মেয়েও ঝুঁকিতে পড়লো।’
রাজধানীর সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে করোনা আক্রান্ত রোগীরা বেড পাচ্ছেন না। স্বাস্থ্য অধিদফতরের করোনা ডেডিকেটেড হিসেবে তালিকাভুক্ত এবং তালিকাভুক্ত নয়-এমন একাধিক বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, বেডের অভাবে প্রতিদিন রোগীদের ফেরত দিতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। আর সেসব রোগীদের কারণে হু হু করে বাড়ছে পারিবারিক সংক্রমণ।
গত পাঁচদিন ধরে দেশে দৈনিক শনাক্ত সাড়ে তিন হাজারের বেশি। স্বাস্থ্য অধিদফতর ২৭ মার্চ জানিয়েছে, গত সপ্তাহের (১৪ মার্চ থেকে ২০ মার্চ) তুলনায় চলতি সপ্তাহ (২১ মার্চ থেকে ২৭ মার্চ) পর্যন্ত করোনার দৈনিক নমুনা পরীক্ষা, শনাক্ত, সুস্থতা এবং মৃত্যুহার বেড়েছে।
গত সপ্তাহে মোট করোনা শনাক্ত হয়েছে ১২ হাজার ৪৭০ জনের। চলতি সপ্তাহে ২৩ হাজার ১০০ জনের। শনাক্তের হার বেড়েছে ৮৫ দশমিক ২৪ শতাংশ। গত সপ্তাহে সুস্থ হয়েছিল ১০ হাজার ৪০৮ জন। চলতি সপ্তাহে হয়েছে ১৩ হাজার ২০৪ জন। সুস্থতার হার বেড়েছে ২৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ। গত সপ্তাহে মারা গেছে ১৪১ জন। চলতি সপ্তাহে ২০১ জন। মৃত্যুহার বেড়েছে ৪২ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদফতর শনিবার করোনা-বিষয়ক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, রাজধানী ঢাকার ডেডিকেটেড কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের ১৬ বেড, কুর্মিটোলা জেনারেল হাপসাতালের ১০ বেড, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ১০ বেড, মুগদা জেনারেল হাসপাতালের ১৯ বেড ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬টি আইসিইউ বেডের একটিও ফাঁকা নেই।
শুধু শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের ১৬টি বেডের দুটি, সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের ছয়টির মধ্যে একটি ও সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের ১৫টির মধ্যে দুটি বেড ফাঁকা রয়েছে। অর্থাৎ, করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত সরকারি হাসপাতালগুলোর ১০৮টি বেডের মধ্যে রোগী আছে ১০৩ জন। বেড ফাঁকা রয়েছে মাত্র পাঁচটি।
অপরদিকে, অধিদফতরের তালিকাভুক্ত বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত ১৮৮টি বেডের মধ্যে রোগী ভর্তি ১৪৩ জন, বেড ফাঁকা ৪৫টি।
পুরো ঢাকায় অধিদফতরের তালিকাভুক্ত সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে মোট আইসিইউ বেড ২৯৬টি। এর মধ্যে রোগী ভর্তি ২৪৬ জন। বেড ফাঁকা ৫০টি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাসপাতালে রোগীরা ভর্তি হতে না পেরে বাসায় ফিরে যাচ্ছেন। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এসব রোগীর পরিপূর্ণ আইসোলেশন বাসায় করা সম্ভব নয়। তাতে তাদের কারণে সংক্রমণ চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়বে।
‘একজন রোগীকে যখন আমরা হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছি, তখন নিশ্চিত বলা যায় তার মাধ্যমে আরও অনেকে সংক্রমিত হচ্ছেন।’ এমন মন্তব্য করে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি কমিটির সদস্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশন বা কোয়ারেন্টিন পদ্ধতির দুর্বলতাই এর বড় কারণ। এর জ্বলন্ত প্রমাণ সিলেটের হোটেল থেকে কোয়ারেন্টিনে যারা ছিলেন তাদের উধাও হয়ে যাওয়া। তাদের সুপারভাইজ করা হচ্ছে না। যা খুব কঠোরভাবে হওয়ার কথা ছিল।’
তিনি আরও জানান, ‘একইসঙ্গে আমাদের দেশে উপেক্ষা করার প্রবণতা প্রচ-। বইমেলাতে সবাই প্রবেশপথে মাস্ক পরে ভেতরে ঢুকছে। কিন্তু ভেতরে ঢোকার পর মাস্ক খুলে ফেলছে। সামাজিক দূরত্বের বালাই নেই। মানুষ শুধু গেট পার হওয়ার জন্যই মাস্ক নিয়ে যাচ্ছে।’
একইসঙ্গে হাসপাতাল থেকে রোগীরা যে ফেরত যাচ্ছে এটাও রাষ্ট্রের বড় একটা দায়িত্ব। এমনটা মন্তব্য করে অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ঢাকায় এমনিতেই অনেক মানুষের আইসোলেশনে থাকার জন্য আলাদা রুমসহ অন্য সুবিধা নেই। বলা যায় সরকারি সুবিধার অভাবই তাকে বাধ্য করলো ভাইরাস ট্রান্সমিশন করার জন্য। রোগী কিন্তু এসেছিল আমাদের সাহায্যের জন্য। আমরাই করতে পারিনি।’
মহামারী বিশেষজ্ঞ ও রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)-এর উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘একজন করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির যদি সঠিক আইসোলেশন ব্যবস্থা না হয়, তবে তার পুরো পরিবার আক্রান্ত হতে পারেন। এজন্যই প্রতিদিন আক্রান্তের হার বাড়ছে।’
আর এসব রোগী যদি পরে গণপরিবহনে একবারও যাতায়াত করে তবে অবস্থা কোন পর্যায়ে যাবে? প্রশ্ন করেন ডা. মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, ‘এখন প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলশন বাড়াতে হবে। প্রতিটি স্কুল-কলেজ-কমিউনিটি সেন্টারে, যেখানে কমিউনিটি আইলোশন সেন্টার হতে পারে এবং হাই-ফ্লো অক্সিজেন দেওয়া যেতে পারে সেখানেই এমনটা করতে হবে।’
দেশে ৯ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ শনাক্ত, মৃত্যু ৩৫ : মহামারি করোনা ভাইরাসে দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন আরও ৩৫ জন। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ৮ হাজার ৯০৪ জনে। এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় ৩ হাজার ৯০৮ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন। যা গত ৯ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এ নিয়ে দেশে এখন পর্যন্ত মোট করোনা রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৯৫ হাজার ৭১৪ জনে।
করোনাভাইরাস নিয়ে রোববার বিকেলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
সংস্থার অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও উল্লেখ করা হয়, এদিন সুস্থ হয়েছেন আরও ২ হাজার ১৯ জন। এ পর্যন্ত মোট সুস্থ হয়েছেন ৫ লাখ ৩৫ হাজার ৯৪১ জন।
শনিবার দেশে আরও ৩ হাজার ৬৭৪ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়। এছাড়া আক্রান্তদের মধ্যে মারা যান আরও ৩৯ জন।
এদিকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও প্রাণহানির পরিসংখ্যান রাখা ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডওমিটারের তথ্যানুযায়ী, রোববার সকাল পর্যন্ত বিশ্বে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ১২ কোটি ৭২ লাখ ৬৫ হাজার ২৬০ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ২৭ লাখ ৮৮ হাজার ৮০০ জনের। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১০ কোটি ২৫ লাখ ৫০ হাজার ৭৭৪ জন।
করোনায় এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ ও মৃত্যু হয়েছে বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশ যুক্তরাষ্ট্রে। তালিকায় শীর্ষে থাকা দেশটিতে এখন পর্যন্ত করোনা সংক্রমিত হয়েছেন ৩ কোটি ৯ লাখ ১৭ হাজার ১৩০ জন। মৃত্যু হয়েছে ৫ লাখ ৬২ হাজার ১২ জনের।
আক্রান্তে ও মৃত্যুতে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ব্রাজিলে এখন পর্যন্ত সংক্রমিত হয়েছেন এক কোটি ২৪ লাখ ৯০ হাজার ৩৬২ জন এবং মারা গেছেন ৩ লাখ ১০ হাজার ৬৯৪ জন।
আক্রান্তে তৃতীয় এবং মৃত্যুতে চতুর্থ অবস্থানে থাকা ভারতে এখন পর্যন্ত করোনায় এক কোটি ১৯ লাখ ৭১ হাজার ৪ জন সংক্রমিত হয়েছেন। মৃত্যু হয়েছে এক লাখ ৬১ হাজার ৫৮৬ জনের।
আক্রান্তের দিক থেকে চতুর্থ স্থানে রয়েছে রাশিয়া। দেশটিতে এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৪৫ লাখ ১০ হাজার ৭৪৪ জন। ভাইরাসটিতে মারা গেছেন ৯৭ হাজার ৪০৪ জন।
আক্রান্তের দিক থেকে ফ্রান্স রয়েছে পঞ্চম স্থানে। দেশটিতে এখন পর্যন্ত করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন ৪৫ লাখ ৮ হাজার ৫৭৫ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ৯৪ হাজার ৪৬৫ জন।
এদিকে আক্রান্তের তালিকায় যুক্তরাজ্য ষষ্ঠ, ইতালি সপ্তম, স্পেন অষ্টম, তুরস্ক নবম এবং জার্মানি দশম স্থানে আছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের অবস্থান ৩৪তম।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান থেকে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হয়। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশসহ বিশ্বের ২২১টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে কোভিড-১৯।