শ্রমবাজারে বিপর্যয়!

অর্থনীতি আন্তর্জাতিক জীবন-যাপন

নিজস্ব প্রতিবেদক : বাংলাদেশ থেকে অনেক দেশে বৈধভাবে কর্মসংস্থানের জন্য কর্মীরা গেলেও গত কয়েক বছরে সেই বাজার অনেকটাই সংকুচিত হয়ে উঠেছে। করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বে শ্রমবাজার আরো চাপে পড়েছে। সংক্রমণ ও মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়ায় গত এক মাস ধরে চলা লকডাউনে প্রবাসে ফের আটকা পড়েছেন লক্ষাধিক বাংলাদেশি। লকডাউনের আগে যারা দেশে এসেছিলেন তাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে এলেও ফিরতে পারছেন না প্রবাসের কর্মস্থলে। এ ছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ওমান, মালয়েশিয়াসহ বেশকিছু দেশ বাংলাদেশির ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় এই সমস্যা আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, লকডাউনের মেয়াদ বাড়ানোয় বিপাকে পড়েছেন অনেক প্রবাসি বাংলাদেশি। কারো ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, কারো আবার সময় চলে যাচ্ছে কাজে যোগ দেওয়ার। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো বলছে, লক্ষাধিক বাংলাদেশি শ্রমিক এই লকডাউনে দেশে আটকা পড়েছে। তাদের জন্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে কথা বলে সমস্যা সমাধানের উপায় খুঁজছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
জনশক্তি রপ্তানিকারক সংগঠন বায়রা’র সাবেক মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান বলেন, সৌদি আরব ছাড়া সব দেশেই কর্মী পাঠানো বন্ধ রয়েছে লকডাউনে। কারণ সৌদি আরব সীমিত সংখ্যক ভিসা ইস্যু করছে। একটি রিক্রুটিং এজেন্সির সপ্তাহে মাত্র ১৩টি করে পাসপোর্ট জমা নিচ্ছে। এভাবে চললে বৈদেশিক কর্মসংস্থানে আমাদের অভাবনীয় ক্ষতি হয়ে যাবে।
তিনি জানান, করোনার কারণে বিদেশগামী ও প্রবাসে অবস্থানরত বাংলাদেশিসহ এই খাতে সংশ্লিষ্ট প্রায় দশ লাখের বেশি কর্মী কর্মহীন আছে। এতে দেশের অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, যা হয়তো এখনই বোঝা যাচ্ছে না। আগামী কয়েক বছরে এই নেতিবাচক প্রভাব পড়তে থাকবে।
তিনি বলেন, আমাদের এই পরিস্থিতির অন্যতম কারণ ছিল অসচেতনতা। জনগণ সচেতন থাকলে এবং এর সঙ্গে সরকার কঠোর পদক্ষেপ নিলে বৈদেশিক কর্মসংস্থানে প্রভাব পড়ত না। জনশক্তি আমদানিকারক দেশগুলোও আমাদের প্রবাসীদের ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দিত না। এটা না হওয়ায় জনশক্তি রপ্তানি খাতসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক খাতে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।
করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় চলমান লকডাউনের মধ্যেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রবাসী বাংলাদেশিদের অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া দেশে না আসার অনুরোধ জানায়। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোকে নির্দেশনাও দেয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোকে এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা দেওয়ার পর মিশনগুলোও সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশ মিশন বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া প্রবাসীদের দেশে না ফেরার আহ্বান জানায়।
মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পাওয়ার পর মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতারসহ অন্যান্য দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশন জরুরিভাবে প্রবাসীদের বাংলাদেশ ভ্রমণে সতর্কতা জারি করে। তারপরও লকডাউনের মধ্যে বিশেষ ফ্লাইটে বিদেশ থেকে প্রবাসীরা দেশে ফিরতে চাইছেন।
মালয়েশিয়া সূত্র জানায়, গত এক বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশিদের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে মালয়েশিয়ার সরকার। দেশটিতে প্রায় ৮ লাখের বেশি বাংলাদেশি কাজ করেন। প্রতি মাসে মালয়েশিয়া থেকে কয়েক হাজার বাংলাদেশি বিভিন্ন কারনে ছুটি নিয়ে দেশে ফিরে যান।
কিন্তু নিষেধাজ্ঞা চলাকালে সেভাবে বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় এবং মালয়েশিয়া থেকে দেশে ফিরতে পারেননি প্রবাসীরা। তাদের অনেকের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও তারা কর্মস্থল ত্যাগ করেনি। ভিসার মেয়াদ না থাকলেও তারা কাজ করে যাচ্ছেন। কারণ নিষেধাজ্ঞার কারনে বিমান চলাচল বন্ধ রয়েছে। ফলে তারা দেশে ফিরতে পারছে না। তবে যাওয়ার আগে যাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে তাদেকে নতুন করে ভিসা দেওয়ার ব্যবস্থা রেখেছে বলে জানায় সূত্র।
দেশটিতে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ হাজার কর্মী করোনার শুরুর পর থেকে দেশে ফিরতে পারেনি বলে জানানো হয়। এভাবে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের সারা বিশ্বের কর্মরত বাংলাদেশিরা এই সময়ে প্রয়োজন থাকলেও দেশে আসতে পারেনি।
করোনাভাইরাসের ভারতীয় ভেরিয়েন্ট ঠেকাতে ভারতীয় সীমান্তেও কড়াকড়ি আরোপ করেছে সরকার। ফলে চিকিৎসাসহ নানা প্রয়োজনে ভারতে যাওয়া অনেক বাংলাদেশি দেশে ফিরতে পারছে না। দেশে ফেরার অনাপত্তিপত্র (এনওসি) না পাওয়ায় অনেকে আটকে আছে সীমান্তের ওপারে। সবচেয়ে বেশি মানুষ আটকে পড়েছে চুয়াডাঙ্গার দর্শনা সীমান্তে।
এদিকে যেসব বাংলাদেশি এরই মধ্যে দেশে প্রবেশ করেছে, তাদের বিভিন্ন আবাসিক হোটেল কিংবা হাসপাতালে আইসোলেশনে রাখা হয়েছে। তবে গত সোমবার থেকে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে স্থাপিত বাংলাদেশের উপ-হাইকমিশন থেকে আটকা পড়া বাংলাদেশিদের এনওসি দেওয়ার কথা রয়েছে। এনসি’র সঙ্গে করোনা টেস্ট সার্টিফিকেট নিয়েই দেশে ঢুকতে পারবেন বাংলাদেশিরা।
বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীর কারণে বাংলাদেশের বৈদেশিক শ্রমবাজার প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। করোনা মহামারী শুরু থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ১১ থেকে ১২ লাখ কর্মী বিদেশ যাওয়ার কথা ছিল। এরমধ্যে তিন লাখ কর্মীকেও বিদেশ পাঠানো সম্ভব হয়নি। এসব কর্মীরা বিদেশ যাওয়ার লক্ষ্যে তাদের পাসপোর্ট ইস্যু ও জমা এবং প্রয়োজনীয় ট্রেনিংও সম্পন্ন করেছিল।


বিজ্ঞাপন