পরীমনির কান্নার বিচার তো দেখেছি, জেসমিনেরটা দেখব তো?

অপরাধ

মর্তুজা হাসান সৈকত : ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলা করেছেন দেশের অন্যতম জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা পরীমনি। তার অভিযোগ নিয়ে এখন তোলপাড় চলছে সারা দেশে। পরীমনির অভিযোগ, উত্তরা ক্লাবের সাবেক সভাপতি নাসির উদ্দিন মাহমুদ গত ১০ জুন মধ্যরাতে ঢাকা বোট ক্লাবে তাকে হেনস্তা করেছেন। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। ইতোমধ্যে ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন তার পাঁচজন সহযোগীসহ গ্রেফতার হয়েছেন।


বিজ্ঞাপন

পরীমনির ধর্ষণচেষ্টা ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগ নিয়ে পুলিশের যখন ত্বরিত পদক্ষেপ দেখছি, তখন উত্তরা ক্লাবের আরেক সদস্যের পেশীশক্তির ভয়ে বারিধারার কূটনৈতিক জোনের এক ফ্ল্যাটের মালিক অন্যত্র এক আত্মীয়ের বাসায় পালিয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। ভুক্তভোগী ফ্ল্যাট মালিকের নাম জেসমিন জেসি। এ খবর সংবাদমাধ্যমে এলেও কারও কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই, নেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও।

অন্যদিকে ফ্ল্যাট মালিককে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে ডাকাতি মামলার ভয় দেখিয়ে বাসাছাড়া করতে পেরে ভাড়াটিয়া কাদের ব্যাপারটিকে কৃতিত্ব হিসেবে উপস্থাপন করতে চাইছেন। এ প্রসঙ্গে গত ৬ জুন দৈনিক যুগান্তরে ‘ভাড়াটিয়ার দাপটে ফ্ল্যাট মালিক বাসাছাড়া’ শিরোনামের সংবাদে ভাড়াটিয়া সানোয়ার কাদের দম্ভ করে জানিয়েছিলেন, উনারা তো অনেক কিছুই করেছে, উনারা উনাদের বাপের কাছে গেছে, ডিসির কাছে গেছে, থানায় গেছে, গিয়ে লাভ তো নাই। এমন কোনো বাপ নাই যার কাছে যায় নাই। এমপি ফারুকের কাছে গেছে, কমিশনারের কাছে গেছে। এমনকি যুগান্তরের প্রতিবেদককে এ বিষয়ে তার কাছে আর ফোন না করার পরামর্শ দেন তিনি। একটা লোক কতটা বেপরোয়া হলে এমন আচরণ করতে পারেন, থানা-পুলিশ, নির্বাচিত প্রতিনিধি সবাইকেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথা বলতে পারেন কী করে- সেটাই শুধু ভাবছি।

পরীমনি অভিযোগ করেছিলেন, ভিকটিম হওয়ার পর পুলিশের সাহায্য চেয়েছিলেন। কিন্তু তার অভিযোগ আমলে নেওয়া হয়নি। শিল্পী সমিতি থেকে আইজিপি বেনজীর আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার কথা থাকলেও তারাও দেননি। তাই অনেকটা বাধ্য হয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। ফলে টনক নড়ে পুলিশের। আইজিপির নির্দেশে ত্বরিত পদক্ষেপ নেওয়া হয়। অন্যদিকে জেসমিন সেলিব্রেটি কেউ নন। তার ফেসবুক স্ট্যাটাসও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছবে না। আইজিপির সঙ্গে তার যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ারও কেউ নেই। ফলে তার সাধারণ ডায়েরি (জিডি) পুলিশ নথিভুক্ত করলেও এখনো কোনো প্রতিকার পাননি।

তদুপরি সাধারণ ডায়েরি করার পর তার ঝামেলা বেড়ে গেছে বলেই সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে। ভাড়াটিয়ার হুমকিতে এখন নিজের ফ্ল্যাটে আসা-যাওয়া ছেড়ে দিতে হয়েছে। আতঙ্ক নিয়ে এক আত্মীয়ের বাড়িতে থাকছেন। একবার ভেবে দেখেন তো ব্যাপারটা কই পৌঁছে গেছে। একজন ফ্ল্যাট মালিক নিজের ফ্ল্যাটে যেতেই পারছেন না ভাড়াটিয়ার দাপটে। অথচ কেউই ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না।

একজন এমন অন্যায় করেও কীভাবে বুক ফুলিয়ে এভাবে দিনের পর দিন চলতে পারে, তার এই ক্ষমতার উৎস কোথায় এই প্রশ্ন কি আসে না? নাসির উদ্দিন আর সানোয়ার কাদেরদের ‘ধরাকে সরাজ্ঞান করার’ এই মানসিকতা কোথা থেকে আসছে ব্যাপারটা এখনই খতিয়ে দেখা উচিত। কারণ দু’জনই একটি নির্দিষ্ট ক্লাবের সদস্য। এখানে তাদের ক্ষমতার কোনো যোগসূত্র হয়তো থাকতে পারে।

তবে আশঙ্কার কথাটি হচ্ছে, একজন মানুষ হয়রানি বা ছোট-বড় যে কোনো ক্রাইমের শিকার হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে যাবেন। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেখানে গিয়ে সে যদি প্রত্যাশিত সহযোগিতা না পান, উল্টো অভিযুক্তর হুমকি-ধামকিতে যদি পালিয়ে থাকতে হয় তাহলে এটা কেমন হলো? অন্যদিকে এলাকাটি কূটনৈতিক জোন। খুবই স্পর্শকাতর একটি এলাকা। দেশের অন্যসব এলাকার স‌ঙ্গে একে মেলানো যাবে না। এখানে থানা-পুলিশের নাকের ডগায় বসে যদি এমন ঘটনা ঘটে, বছরের পর বছর কেউ ভাড়া না দিয়েই থাকেন, ভাড়া চাইতে গেলে ফ্ল্যাট মালিককে ভয়ভীতি দেখান, অন্যত্র থাকতে বাধ্য করেন- এগুলো খবরের শিরোনাম হলে নিশ্চয়ই সরকারেরও ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হতে বাধ্য।

পরীমনি এ দেশের একজন প্রথিতযশা চিত্রনায়িকা ও সামাজিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত। তারই যদি ফেসবুক পেজ থেকে স্ট্যাটাস দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানিয়ে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিকার পেতে হয়, তাহলে জেসমিনের মতো যারা সাধারণ নারী, তারা যখন সানোয়ার কাদেরদের মতো কোনো প্রবল প্রভাবশালী বা ক্ষমতাশালীদের পেশীশক্তির দ্বারা অন্যায়ের শিকার হচ্ছেন, তাদের তো বিচার পাওয়ার আশা দুরাশা ছাড়া কিছু না।

ভাইরাল না হলে বিচার হবে না, পুলিশ অ্যাকশনে যাবে না- এটাই যদি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, তাহলে তো আরেক বিপদ। তখন তো কেউ আর পুলিশের কাছে যাবে না, ফেসবুকেই বিচার চাইবে। এটা কালচারে পরিণত হবে। পরীমনি জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা বলে, ফেসবুক পেজে স্ট্যাটাস দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর, আইজিপির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছেন বলে বিচার পাবেন আর জেসমিনরা জনপ্রিয় না বলে ভাইরালও হবেন না, ন্যায়বিচারও পাবেন না- এটা তো হতে পারে না।

এতকাল আমরা জেনে আসছি, বাড়িওয়ালার দাপটে ভাড়াটিয়াদের বিভিন্ন ভোগান্তির কথা। তবে সানোয়ার কাদেরের মাধ্যমে আয়নার অন্য পিঠও জানা হলো। এ ঘটনার পর গুগলে সার্চ দিয়ে যা জানলাম তা রীতিমতো আঁতকে ওঠার মতো। একটা চক্র এখন রাজধানীসহ সারা দেশেই সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এরা ভাড়াটিয়া হিসেবে উঠে একসময় জাল দলিল তৈরি করে ফ্ল্যাট-বাড়ির দখল নিয়ে নেয়।

একদিকে বাড়িভাড়া আইনের অসম্পূর্ণতা, অন্যদিকে আইনে যতটুকু বিধান উল্লেখ আছে তারও প্রয়োগ নেই। ফলে জেসমিনদের মতো ফ্ল্যাট মালিকদের ভোগান্তি বেড়েই চলেছে। সীমাহীন ভোগান্তিতে থাকা অতিষ্ঠ অধিকারবঞ্চিত এসব মানুষ কোথায় আশ্রয় পাবেন, কার কাছে কষ্টের কথা জানাবেন তা কেউ জানেন না। তদুপরি বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ