গণপূর্তে ফের বদলী আতঙ্ক!

এইমাত্র জাতীয়

বিশেষ প্রতিবেদক : করোনাকালীন সময়ের মধ্যেও গণহারে বদলি শুরু হয়েছে সরকারি ভবন নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান গণপূর্ত অধিদফতরে। গত দেড় মাসে ৩০ কর্মদিবসে বদলি হয়েছেন প্রায় শতাধিক। এদের মধ্যে উপসহকারী প্রকৌশলী থেকে শুরু করে সহকারী প্রকৌশলী, নির্বাহী প্রকৌশলী এবং তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীও রয়েছেন। গণপূর্ত অধিদফতরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত অফিস আদেশ অনুসন্ধানে এসব তথ্য মিলেছে। এখন গণপূর্ত অধিদফতরে চলছে বদলি আতঙ্ক।
অভিযোগ ওঠেছে, এসব বদলির বেশির ভাগই হচ্ছে আর্থিক লেনদেনে। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ঢাকার বাইরে প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে থাকা কর্মকর্তাদের ঢাকায় দায়িত্বে নিয়ে আসা হচ্ছে। আবার অনেকের পোস্টিং দিচ্ছেন তাদের পছন্দ অনুযায়ী মন্ত্রিপাড়া, সংসদ, গণভবন, বঙ্গভবনের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। আর এসব পদ ফাঁকা করতে গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় কর্মরতদের সরিয়ে দিচ্ছেন অন্যত্র।
একাধিক প্রকৌশলী সকালের সময়কে বলেন, বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন পদে প্রায় কয়েকশ প্রকৌশলীকে বদলি করা হয়েছে। এ কারণে, গণপূর্তে কর্মরতরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। কয়েকজন উপসহকারী প্রকৌশলী জানান, তারা আতঙ্ক নিয়ে অফিসে ঢোকেন। আবার একই টেনশন নিয়ে প্রতিদিন অফিস শেষ করেন। কখন বদলির চিঠিটা হাতে ধরিয়ে দেয়া হবে, তা নিয়ে আতঙ্কে থাকতে হয় তাদের। তারা জানান, প্রতিটি বদলির জন্য বড় ধরনের আর্থিক লেনদেন হয়েছে। তবে এ টাকা কার মাধ্যমে কে নিচ্ছে এ বিষয়টি সরকারের গোয়ান্দাদের অনুসন্ধান করে বের করার দাবি জানান তারা।
গণপূর্ত অধিদপ্তরে দুর্নীতি, অনিয়ম ও সিন্ডিকেটের কারণে বেশ কিছুদিন ধরে আবারো সমালোচিত হয়ে আসছে। করোনাকালীন সময়ে প্রকৌশলীদের বদলীর হিড়িকসহ নানা বির্তকিত কর্মকা-ের কারণে সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে সমালোচনার ঝড় বয়ে চলছে। সেই রূপপুরের বালিশকা- থেকে শুরু করে হালের বির্তকিত ঠিকাদার জি কে শামীম, গোল্ডেন মনির ইস্যুতে নাকাল হয়ে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটির স্বাভাবিক অবস্থা। এসব অবৈধ কর্মকা-ে জড়িত থাকার কারণে সাবেক ও বর্তমান প্রায় শতাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ অনুসন্ধান চলমান রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গণপূর্ত অধিদপ্তরে দীর্ঘদিন ধরে নানান ধরণের অনিয়ম অনুসন্ধান করে আসছে দুদক। এ কারণে কমিশনের জালে আটকা পড়েছে বড় বড় দুর্নীতিবাজ রাঘব-বোয়ালরা। অন্যদিকে প্রধান প্রকৌশলীর পদে পরিবর্তন আসার সাথে সাথে গড়ে একটি নতুন সিন্ডিকেট। অতীত আর বর্তমানে এই সিন্ডিকেটগুলোর কাজ হয়ে উঠছে বদলী বাণিজ্য, টেন্ডার, কমিশন ও নানা তদবিরের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া। মাঝে মাঝে টাকার বিনিময়ে নিজের চেয়ার টিকিয়ে রাখতে কর্মকর্তারা ঠিকাদারের সাথে আতাঁত করে সরকারি অর্থ তছরূপের মাধ্যমে গড়ে তোলেন নতুন সিন্ডিকেট।
সরকরের বিশেষ একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদন সুত্রে জানা যায়, পূর্ত অধিদপ্তরের উচ্চপদস্থ অধিকাংশ কর্মকর্তা নানা অনিয়ম ও সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত। এর মধ্যে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। গণপূর্ত অধিদপ্তরের জিকে শামীম বা গোল্ডেন মনির সিন্ডিকেটের প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে তদন্ত হলেও তার সুপারিশ বাস্তবায়ন হওয়ার প্রচলন খুব কম। খোদ ওই প্রকৌশলীদের একটি অংশ তাদের কাজ দেওয়ার জন্য মরিয়া থাকতেন।
উল্লেখ্য, গণপূর্ত অধিদপ্তরের অধীনে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস ও হাসপাতালের সম্প্রসারণের নির্মাণ কাজে ‘মেসার্স জিকে বিল্ডার্স-পায়েল’ নামের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটিকে তার কাজের অধিক প্রায় ১০ কোটি ৪৫ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়। কাজটি যখন চলছিল সে সময় শেরে বাংলা নগর গণপূর্ত বিভাগ-১ নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন মোহাম্মদ ফজলুল হক। যিনি বর্তমানে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (উন্নয়ন) হিসেবে অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত আছেন। গণপূর্ত অধিদপ্তরের সূত্রগুলো বলছে, দোষীদের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যাবস্থা নেওয়া হবে।
জানা গেছে, হাসপাতালটিতে কাজের সাথে জড়িত ক্যাসিনো কান্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত ও আলোচিত ঠিকাদার জি কে শামীমের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ‘মেসার্স জিকে বিল্ডার্স-পায়েল’। এটি একটি জয়েন্ট ভেঞ্চার প্রতিষ্ঠান। অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৮ সালের ৮ অক্টোবর মেসার্স জিকে বিল্ডার্স-পায়েল নামের প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ প্রদান করা হয়। সেখানে বলা হয়, হাসপাতালের সম্প্রসারণের এই নির্মাণ কাজের প্রকল্পের আওতায় ১৫ তলা ফাউন্ডেশনসহ ১২ তলা হাসপাতাল ভবন নির্মাণের জন্য দরপত্রের সব প্রক্রিয়া শেষ করা হয়।
সেই সাথে, ২৮ অক্টোবর ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটিকে তাদের কাজের জন্য সাইটের পজেশন হস্তান্তর করা হয়। পরবর্তিতে, কাজটির জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করা হয় একই বছরের ৪ নভেম্বর। সেখানে কাজের চুক্তি মূল্য ছিল প্রায় একশত ৬৮ কোটি টাকা, যার মেয়াদ ছিল ২ বছর। সেবছরের ৮ ডিসেম্বর কার্যাদেশ পাওয়া প্রতিষ্ঠানটি তাদের কাজ শুরু করে। তবে কাজ শুরু করার প্রায় ৯ মাস পর অর্থাৎ ২০১৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠানটি ওই হাসপাতালের সম্প্রসারণের নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেয়। এই সময়ে তারা তাদের চুক্তি অনুযায়ী কাজের আংশিক সম্পন্ন করেছিল।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, এই হাসপাতালটির সম্প্রসারণের নির্মাণ কাজ চলাকালে ২০১৯ সালের ১৮ মার্চ প্রথম চলতি বিল ৯ কোটি ৯৫ লক্ষ টাকা এবং তার কয়েক মাস পর ৩০ জুন দ্বিতীয় চলতি বিলে আরও ২০ কোটি টাকা ওই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটিকে দেওয়া হয়। অর্থাৎ, দুই বিল মিলে ওই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ২৯ কোটি ৯৫ লক্ষ টাকা উত্তোলন করে। যদিও সে সময় প্রতিষ্ঠানটি এই সমপরিমাণ অর্থের কাজ সম্পন্ন করেনি। সংশ্লিষ্ঠ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি তাদের কাজ বন্ধ করার পর তাদের চুক্তির শর্ত অনুসরণ করে তাগাদা প্রদান করার পরেও কাজ শুরু করে নাই। এক্ষেত্রে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানটি চুক্তির মৌলিক শর্ত ভঙ্গ করে। এ কারণে ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানটির সাথে চুক্তি বাতিল করে গণপূর্ত অধিদপ্তর।
পরবর্তিতে, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় হাসপাতালটির নির্মাণ কাজের যৌথ পরিমাপের জন্য একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেয়। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাজমুল হোসাইন ২০ সালের ২২ মার্চে প্রকল্প পরিচালক, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, অধিদপ্তরের বিভাগীয় প্রকৌশলী ও উপ-সহকারী প্রকৌশলীর উপস্থিতিতে এই নির্মাণ কাজের যৌথ পরিমাপ গ্রহন করেন। সেই যৌথ পরিমাপে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটির করা কাজের মূল্যায়ন দাঁড়ায় ১৯ কোটি ৫০ লক্ষ ৯ হাজার ৯৪৫ টাকা।
তাদের এই যৌথ পরিমাপ ও পরিশোধকৃত বিল তুলনামূলক পর্যালোচনা করে দেখা যায়, হাসপাতালের সম্প্রসারণের কাজে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটিকে তাদের করা কাজের অধিক প্রায় ১০ কোটি ৪৫ লক্ষ টাকা বিল হিসাবে দেওয়া হয়েছে। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের নিকট অতিরিক্ত বিল দেওয়ার বিষয়ে জানতে গণপূর্ত অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (উন্নয়ন) মোহাম্মদ ফজলুল হকের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় (যিনি তৎকালীন শেরে বাংলা নগর গণপূর্ত বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী হিসাবে দায়িত্বে ছিলেন)। প্রতিবারই তার মুঠোফোন নম্বরটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
এ বিষয়ে প্রধান প্রকৌশলীর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কখন কাকে কোথায় বদলী করতে হবে এ প্রশ্নের উত্তর সাংবাদিকদের দিতে আমি বাধ্য নই। টাকার বিনিময়ে অনেকে বদলী হয়ে আসছেন এমন প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন, এ বিষয়টি আমার জানা নেই। অতিরিক্ত বিলের বিষয়ে প্রধান প্রকৌশলী বলেন, এটা আমরা সমন্বয় করার চেষ্টা করছি।


বিজ্ঞাপন