শেখ হাসিনার রেফুজি জীবন

জাতীয়

আজকের দেশ রিপোর্ট : হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী তখন জার্মানির বনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত।হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার নিরাপত্তা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি নিশ্চিত ছিলেন, তারা যদি পৃথিবীর কোথাও নিরাপদ থাকে, সেটি ভারত।


বিজ্ঞাপন

তিনি পশ্চিম জার্মানিতে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত মিঃ ওয়াই কে পুরীর সাথে দেখা করলেন। মিঃ পুরী জানালেন, ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় পাবার প্রক্রিয়াটি খুবই দীর্ঘ এবং জটিল।

তিনি ইন্দিরা গান্ধীর পছন্দের দুইজন পরামর্শদাতা ডি পি ধর এবং পি এন হাক্সর এর সাথে যোগাযোগ করবার পরামর্শ দেন হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে, দুর্ভাগ্যবশত দুজনই তখন ভারতের বাইরে অবস্থান করছিলেন।

জনাব চৌধুরী খুবই দ্বিধাগ্রস্ত বোধ করতে লাগলেন, কারণ একমাত্র সরাসরি ইন্দিরা গান্ধীকে ফোন করা ছাড়া তার আর কোন উপায় ছিলো না। ইন্দিরা গান্ধী তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী, আর তিনি বাংলাদেশের একজন সাধারণ রাষ্ট্রদূত।

তাছাড়াও, ভারতে যখন জরুরী অবস্থা বিরাজমান। মিঃ পুরীর থেকে নাম্বার নিয়ে তিনি একদিন ফোন দিলেন, শেষ চেষ্টা হিসেবে।

সৌভাগ্যই বলতে হবে, ফোন অপারেটর না, বরং ইন্দিরা গান্ধী নিজেই সেদিন ফোনটি রিসিভ করেছিলেন।

হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী পুরো ঘটনা খুলে বলা মাত্র ইন্দিরা গান্ধী এক বিন্দু সময় নষ্ট না করে বললেন, শেখ মুজিবের দুই কন্যা ও তার পরিবারকে যতো দ্রুত সম্ভব ভারতে পৌছাবার ব্যবস্থা করতে। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সময় নষ্ট না করে ওয়াজেদ মিয়াকে নিয়ে ভারতীয় দুতাবাসে নিয়ে যান। ওয়াজেদ মিয়ার সাথে তখন তেমন কোন অর্থ কড়ি ছিলো না।

শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশ থেকে মাত্র ২৫ ডলার সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন। হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী তাদেরকে হাজারখানেক জার্মান মুদ্রা প্রদান করেন।

২৪ আগস্ট সকাল ৯টায় পরিকল্পনা অনুযায়ী দুতাবাসের কর্মকর্তা অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে তাদেরকে ফ্র্যাংকফুর্ট বিমানবন্দর নিয়ে যান, একটি এয়ার ইন্ডিয়া বিমানে করে তারা সকাল সাড়ে ৮টায় দিল্লীর পালাম বিমানবন্দর পৌছান। শুরু হয় শেখ হাসিনার রেফুজি জীবন।

শেখ রেহানার দ্বাদশ শ্রেণিতে পরীক্ষা দেবার কথা ছিলো, কিন্তু পারলেন না। তাকে ’৭৬ সালে শান্তিনিকেতনে ভর্তির ব্যবস্থা করে দেয়া হলেও নিরাপত্তাজনিত কারণে সে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।

পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে নৈনিতাল এর সেইন্ট জোসেফ স্কুল এ ভর্তি করানো হয়। পরবর্তীতে তামিল নাড়ুর কোদাইকানাল ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে সে পড়াশুনা করে।

পরে ব্যাংগালোর ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সায়েন্স এ পড়াশোনা শেষ করে ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসে এ উচ্চতর পড়াশুনা করতে যান। স্বামী ডঃ ওয়াজেদ মিয়াকে ’৭৫ এর ১লা অক্টোবর পরমানু শক্তি বিভাগে ফেলোশিপ প্রদান করা হয়।

৭৬ এর ২৪শে জুলাই, ছোটবোন শেখ রেহানার বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়, পাত্র লন্ডন প্রবাসী শফিক সিদ্দিকের সাথে। কিন্তু সে বিয়েতে শেখ হাসিনা ও তার স্বামী ওয়াজেদ মিয়া নিরাপত্তাজনিত কারণে অংশ নিতে পারেননি।

ভারতে সে সময় শেখ হাসিনার সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিলেন সে সময়কার ডেপুটি মিনিস্টার মিঃ প্রণব মুখার্জি আর তার স্ত্রী শ্রীমতি শুভ্রা মুখার্জি।

তারা শুধু দেখা সাক্ষাতই নয়, বরং হাসিনা পরিবারকে পিকনিকেও তাদের সাথে নিয়ে যেতেন। বলা যায়, পরিবারের বাইরে প্রণব-শুভ্রা পরিবারটি হয়েছিলো, হাসিনাদের সবচেয়ে আপনজন।

৭৭ এর নির্বাচনে হেরে ইন্দিরা গান্ধী তার প্রধানমন্ত্রীত্ব হারান। নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আসেন মোরারজী দেশাই।

শেখ রেহানাকে ভারতে ফিরিয়ে আনবার জন্য ডঃ ওয়াজেদ মিয়া ও শেখ হাসিনা ১৯৭৭ সালে মোরারজী দেশাইর এর সাথে সাক্ষাত করেন।

তিনি রেহানাকে ভারতে ফিরিয়ে এনেছিলেন ঠিকই। তবে আস্তে আস্তে তিনি হাসিনার উপর থেকে হাত গোটাতে শুরু করেন।

প্রথমে ফ্ল্যাটের বিদ্যুতের বিল যেটি সরকার দিতো, সেটি বন্ধ করে দেয়া হলো। গাড়ির ব্যবস্থা তুলে নেয়া হলো।

ডক্টর ওয়াজেদ এর ফেলোশিপ এর সময়ও তখন শেষ, প্রচন্ড আর্থিক কষ্টে তখন ওয়াজেদ পরিবার।

এক বছরের জন্য ফেলোশিপ বাড়াবার আবেদন করলে দেশাই সরকার ৩ মাস কোন উত্তর জানাননি, যদিও পরে ঠিক এক বছরের জন্য ফেলোশিপ বাড়ানোর অনুমতি দিয়েছিলেন।

১৯৮০ সালে আবারও ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় ফিরে আসেন, সে বছর শেখ হাসিনা সন্তানদের নিয়ে লন্ডনে যান তার বোনের কাছে।

ইতিহাসে ১৯৮০ সালটা খুব গুরুত্বপুর্ণ এই কারণে, কারণ এই বছরেই শেখ হাসিনা প্রথম পাবলিক স্পীচ প্রদান করেন, তারিখটা হলো ১৬ই আগস্ট, ১৯৮০।

স্থানঃ ইয়র্ক হল, লন্ডন। শেখ হাসিনার রাজনীতিতে সাহসিক আগমনের আগামবার্তা এই সময়টাকে বলাই যায়, কারণে যে সময়ে তিনি পাবলিকলি স্পীচ দিয়েছেন, সে সময়ে ব্রিকলেনে যুদ্ধাপরাধীরা ছুরি হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো হাসিনাকে হত্যা করবার জন্য।