বাড়াছে উৎকণ্ঠা

এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন সারাদেশ স্বাস্থ্য

করোনায় অন্তঃসত্ত্বা নারীদের মৃত্যু


বিজ্ঞাপন

বিশেষ প্রতিবেদক : সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন ঝালকাঠির সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সানিয়া আক্তার (২৮)। গত ১২ জুলাই র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট করিয়ে করোনা পজিটিভ নিশ্চিত হন তিনি। অন্তঃসত্ত্বা হওয়ায় ওই দিনই সানিয়া আক্তারকে ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। উন্নত চিকিৎসার জন্য গত ১৬ জুলাই তাকে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। চিকিৎসকদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে ২৮ জুলাই সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তার মৃত্যু হয়।
অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন চট্টগ্রাম মা ও শিশু মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের প্রভাষক দিনার জেবিন (৩৫)। এরপর হঠাৎ তার করোনা শনাক্ত হয়। তাকে নগরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৫ জুন সকালে তিনি মারা যান।
ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন যশোরের বেনাপোল পোর্ট থানার ভবারবে গ্রামের মরিয়ম খাতুন (২৫)। তিনি জ্বর, সর্দি, কাশি ও শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। তাকে বাড়িতে রেখেই চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল। হঠাৎ ২৭ জুন সন্ধ্যায় তার শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেলে উন্নত চিকিৎসার জন্য যশোর হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়।
নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী ডা. জারিন তাসনীম রিমি। তিন দিন জ্বর থাকায় ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। এরপর তার করোনা শনাক্ত হয়। ২০ জুলাই দুপুরে তিনি মারা যান।
সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী কানিজ রেহনুমা রব্বানী ভাষা (৩৪)। তার গর্ভে ছিল প্রথম সন্তান। হঠাৎ তিনি করোনায় আক্রান্ত হন। অসুস্থতা বাড়তে থাকলে তাকে ভর্তি করা হয় সিলেট নগরীর মাউন্ড এডোরা হাসপাতালে। অবস্থার অবনতি হওয়ায় নেয়া হয় নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে। গত ১২ জুলাই সকালে মারা যান তিনি।
সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় গত ১৪ জুলাই সকালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক) হাসপাতালে মারা যান জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী নবনীতা সরকার মিতু (২৫)। করোনার উপসর্গ নিয়ে গত ৬ জানুয়ারি সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যান সাড়ে সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা বিপাশা দাস (৩৪)।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত এসব খবরই বলে দেয় দেশের বর্তমান অবস্থার কথা। ছয় মাস, সাত মাস, সাড়ে সাত মাস কিংবা নয় মাসের গর্ভবতী ছিলেন কেউ কেউ! কিন্তু গর্ভে বেড়ে ওঠা কোনো সন্তানই পৃথিবীর আলো দেখতে পারেনি। গর্ভে সন্তান নিয়েই মারা যাচ্ছেন মায়েরা। দিন দিন করোনাভাইরাসে গর্ভবতী নারীদের মৃত্যুতে উৎকণ্ঠা বাড়াচ্ছে। করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণে মৃত্যুর হার আশংকাজনক হারে বেড়েছে। গর্ভবতী নারীদের টিকা না দেওয়ায় করোনা আক্রান্ত হলে তৈরি হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি অন্তঃসত্ত্বা নারীদের ৩৫ শতাংশই করোনা আক্রান্ত। গত তিন মাসে শুধু এই হাসপাতালেই মারা গেছেন এ রকম ১২ নারী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্তঃসত্ত্বা ও প্রসূতি নারীদের কভিড-১৯ সংক্রমণ এবং এর ফলে মারাত্মক অসুস্থতার ঝুঁকি অনেক বেশি। মৃত্যুঝুঁকিও রয়েছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তাদের টিকা দেওয়া দরকার। তাদের পরিবার থেকে সুরক্ষিত রাখতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসূতি ও স্ত্রী রোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম কাজল গণমাধ্যমকে বলেছেন, গত বছরের তুলনায় চলতি বছর অন্তঃসত্ত্বাদের করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা দ্বিগুণ। বর্তমানে অন্তঃসত্ত্বাদের বেশিরভাগই ডেলটা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত। এই ভ্যারিয়েন্ট অত্যধিক সংক্রামক। অন্তঃসত্ত্বাদের এই ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ হলে দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা ও মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি। এতে গর্ভের সন্তানের মৃত্যুঝুঁকিও বেশি।
তিনি বলেছেন, পরিবার থেকে সুরক্ষাবলয় তৈরি করতে হবে। পরিবারে সব সদস্যকে বাইরে থেকে এসে যেন অন্তঃসত্ত্বার সংস্পর্শে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাদের খাওয়ার ও ব্যবহারের জিনিসপত্র আলাদা করতে হবে। যেসব অন্তঃসত্ত্বা চাকরিজীবী, তাদের ক্ষেত্রে কর্মস্থল থেকে ছুটির ব্যবস্থা করতে হবে। অথবা তারা যেন বাড়িতে বসে অফিসের কাজ করতে পারেন, সেই সুযোগ তৈরি করতে হবে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, এখানে ভর্তি হওয়া অন্তঃসত্ত্বা নারীর ৩৫ শতাংশই করোনা আক্রান্ত। হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়ার সময় অনেক রোগীকে সিসিইউ এবং আইসিইউতে নিয়েও সফল হওয়া যায়নি। গত তিন মাসে এ হাসপাতালে ১২৮ জন করোনা আক্রান্ত অন্তঃসত্ত্বা নারী চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে মারা গেছেন ১২ জন।
সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) বলেছে, গর্ভবতী নারীদের অবশ্যই টিকা নেওয়া উচিত। এতে করোনা ঝুঁকি কমবে। গর্ভাবস্থায় অন্য কোনো সমস্যা থাকলে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে টিকা নিতে পারে। কোনো জটিলতা না থাকলে তাদের অবশ্যই টিকা নেওয়া উচিত। এতে করোনা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমবে এবং মা ও শিশু নিরাপদ থাকবে। কিন্তু বাংলাদেশে গর্ভবতী নারীদের টিকা কর্মসূচির আওতার বাইরে রাখায় ঘটছে মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর ঘটনা।
এদিকে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়ার সুপারিশ করেছে দেশে টিকা বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটি। ন্যাশনাল ইমিউনাইজেশন টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজারি গ্রুপ (নাইট্যাগ) দুধ পান করানো মায়েদেরও টিকা দেওয়ার সুপারিশ করেছে।
নাইট্যাগের সদস্য ডা. বে-নজির আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, তাদের টিকা দেওয়া যেতে পারে। এ সংক্রান্ত মতামত রেখেছি।
এরমধ্যে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন হলে আদালত বলেছেন, অন্তঃসত্ত্বা নারীদের টিকা দেওয়ার বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত যেন আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে জানানো হয়।