নারায়নগঞ্জে সংঘবদ্ধ আন্তঃজেলা চোরচক্রের ৬ সদস্য গ্রেফতার

অপরাধ

বিপুল পরিমাণ গার্মেন্টস সামগ্রী, ২ টি কাভার্ড ভ্যান ও ১ টি প্রাইভেটকার জব্দ


বিজ্ঞাপন

নিজস্ব প্রতিনিধি : র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন, র‌্যাব এলিট ফোর্স হিসেবে আত্মপ্রকাশের সূচনালগ্ন থেকেই বিভিন্ন ধরনের অপরাধ নির্মূলের লক্ষ্যে অত্যন্ত আন্তরিকতা, নিষ্ঠা ও সফলতার সাথে কাজ করে আসছে। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ নির্মূল ও মাদকবিরোধী অভিযানের পাশাপাশি খুন, চাঁদাবাজি, ডাকাতি ও ছিনতাই চক্রের সাথে জড়িত বিভিন্ন সংঘবদ্ধ ও সক্রিয় সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যদের গ্রেফতার করে সাধারণ জনগণের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে র‌্যাবের জোরালো তৎপরতা অব্যাহত আছে।

সম্প্রতি গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানা যায় যে, রাজধানী ঢাকা ও গাজীপুর থেকে গার্মেন্টস মালামাল বিভিন্ন দেশে রপ্তানী করার উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের নেওয়ার পথে কিছু কিছু কাভার্ড ভ্যান হতে প্রায় ৩৫-৪০% দামী গার্মেন্টস মালামাল উধাও হয়ে যাচ্ছে। উক্ত সংবাদের ভিত্তিতে র‌্যাব-৪ উক্ত চোরাকারবারীদের চিহ্নিত করার লক্ষ্যে ছায়া তদন্ত শুরু করে। দীর্ঘদিন ধরে ছায়াতদন্ত এবং স্থানীয় সোর্সের সহায়তায় সংঘবদ্ধ এ দলকে অনুসরণ করে জানা যায়, ফ্যাক্টরী থেকে মালামাল নেওয়ার সময় পথিমধ্যে নারায়নগঞ্জ জেলার বন্দর থানার একটি পরিত্যাক্ত রি-রোলিং মিলস্ এ কাভার্ড ভ্যান থামিয়ে সংঘবদ্ধ ০১ টি চোরচক্র কাভার্ড ভ্যানের তালা না খুলে বিশেষ প্রক্রিয়ায় প্রায় ৩৫-৪০% মালামাল চুরি করছে। উক্ত সংবাদের ভিত্তিতে গতকাল র‌্যাব-৪ এর একটি আভিযানিক দল নারায়নগঞ্জ জেলার বন্দর থানাধীন তালতলা, ধামগড় এলাকাস্থ উক্ত রি-রোলিং মিলস লিঃ এর ভিতর অভিযান পরিচালনা করে আনুমানিক ০৬ কোটি টাকা মূল্যের চোরাইকৃত ৪১ বস্তা ও ৫০৬ কার্টুন ভর্তি গার্মেন্টস সামগ্রী, নগদ-৮২,০০০/- টাকা, মালামাল পরিবহনে ব্যবহৃত ০২ টি কাভার্ড ভ্যান, ০১ টি প্রাইভেটকার এবং ১০ টি মোবাইলসহ সংঘবদ্ধ আন্তঃ জেলা চোরচক্রের ০৬ জন সদস্য’কে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। উদ্ধারকৃত গার্মেন্টস মালামাল সমূহ সংশ্লিষ্ট পোশাক প্রস্তুতকারী সংস্থার কর্তৃপক্ষ সনাক্ত করে। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিবর্গের বিবরণ নিম্মরুপঃ

(ক) সিরাজুল ইসলাম (২৭), জেলা-বরিশাল
(খ) মোঃ জহির (৪০), জেলা-ভোলা
(গ) মোঃ জনি (২৪), জেলা- জয়পুরহাট
(ঘ) মোঃ জমির খান (৪০), জেলা-রাজবাড়ী
(ঙ) মোঃ নুর জামান (৫৮), জেলা-শরিয়তপুর
(চ) মোঃ তাবারক হোসেন (৩৯), জেলা-নারায়নগঞ্জ

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত আসামীরা পরস্পর যোগসাজশে দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা ও গাজীপুর থেকে বিভিন্ন দেশে রপ্তানীর গার্মেন্টস মালামাল চুরির ঘটনার সাথে জড়িত মর্মে স্বীকারোক্তি প্রদান করেছে। জিজ্ঞাসাবাদে আরো জানা যায় যে, তারা মালামাল পরিবহনে নিয়োজিত চালকদের সাথে সংঘবদ্ধ একটি চোরাকারবারী চক্র। ধৃত দুর্ধর্ষ চক্রটি পরস্পর যোগসাজোশে বিগত কয়েক বছর ধরে গার্মেন্টস মালামাল কাভার্ড ভ্যান হতে বিশেষ প্রক্রিয়া চুরি করে স্থানীয় মার্কেটে চোরাইপথে কমদামে চুরিকৃত মালামাল বিক্রি করে আসছিলো। এতে করে দেশ প্রচুর পরিমান রাজস্ব থেকে বঞ্চিত ও গার্মেন্টস মালিকগণ প্রতিনিয়ত ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে আসছিলেন। প্রাথমিকভাবে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এ ধরনের কয়েকটি চক্র ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সক্রিয় রয়েছে এবং প্রতি বছর শত কোটি টাকা মূল্যের বেশী পোশাক এসব চক্রের মাধ্যমে চুরি হয়ে যাচ্ছে।

চুরির কৌশলঃ এই চোরচক্রটি সাধারণত কাভার্ড ভ্যানের ড্রাইভারের সাথে সখ্যতা গড়ে বিভিন্ন প্রকার লোভ দেখিয়ে চুরির মালামাল বিক্রয়ের টাকার অংশ দেওয়ার কথা বলে ড্রাইভারকে রাজি করিয়ে নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর এলাকা হতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নিকটবর্তী নির্জন এলাকার ভিতর কাভার্ড ভ্যান পার্কিং করাতো। পরবর্তীতে পলাতক মূলহোতা হিমেলের নির্দেশে গ্রেফতারকৃত সিরাজুল, মিস্ত্রি জনি, নিরাপত্তারক্ষী জমির ও নুর জামান, সিরাজুলের ড্রাইভার জহির, তবারক এবং পলাতক কেয়ারটেকার শহিদুলসহ অন্যন্য সহযোগীরা মিলে বিশেষ কৌশলে কাভার্ড ভ্যানের সিলগালা তালা না খুলে কাভার্ড ভ্যানের পাশের ওয়ালের নাট-বল্টু খুলে প্রত্যেক কার্টুন/বস্তার ভিতরে থাকা মালামালের ৩৫-৪০% মালামাল নিয়ে পূর্বের ন্যায় কার্টুন/বস্তা সঠিকভাবে বাধাই করে তাদের কাভার্ড ভ্যানে নিয়ে যেত যাতে করে ফ্যাক্টরী মালিক ও বন্দর কর্তৃপক্ষ কেউই সন্দেহ না করতে পারে। এছাড়াও মালামালসহ সম্পূর্ণ ট্রাক/কাভার্ড ভ্যানও মাঝে মাঝে তারা লুট করেছে।

চোরাইকৃত মালামালের ডিসপোজাল প্রক্রিয়াঃ দলের এই সদস্যরা নিম্নোক্ত তিন প্রক্রিয়ায় চোরাইকৃত গার্মেন্টস মালামাল ডিসপোজাল করতোঃ

ক। প্রথমতঃ গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী থেকে মালামাল কাভার্ড ভ্যানে সিলগালা অবস্থায় সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরে না নিয়ে সুবিধাজনক সময়ে নারায়নগঞ্জ, গাজীপুর বা নিকটবর্তী নির্জন এলাকা বা পরিত্যক্ত মিলস লিঃ এর ভিতর কাভার্ড ভ্যান পার্কিং করে।

খ। দ্বিতীয়তঃ এই চক্রের মিস্ত্রি বিশেষ কৌশলে কাভার্ড ভ্যানের সিলগালা তালা না খুলে সরাসরি সাইডের ওয়ালের নাট-বল্টু খুলে ফেলত এবং তার অন্যান্য সহযোগীরা খুব দ্রæততম সময়ে প্রত্যেক বস্তা/কার্টুন খুলে ৩৫-৪০% মালামাল নিয়ে আবার পূর্বের ন্যায় বস্তা/কার্টুন প্যাকেট করত যাতে কোন সন্দেহের আবকাশ না থাকে।

গ। তৃতীয়তঃ স্থানীয় বাজারে বাংলাদেশি গার্মেন্টস মালামালের চাহিদা ব্যাপক থাকায় এবং মালামালের গুণাগুণ উন্নত হওয়ায় গ্রেফতারকৃত সিরাজুল ও তার সহযোগী নুর জামান খুব দ্রæততম সময়ে তা বিক্রি করে প্রত্যেকের কাছে টাকা পৌছে দিতো।

গার্মেন্টস মালামাল চুরি যাওয়ার এর ফলে গার্মেন্টস সেক্টর ও দেশের ক্ষতিঃ এই সংঘবদ্ধ চোর চক্রটি গার্মেন্টস মালামাল চুরি করার ফলে গার্মেন্টস সেক্টর ও দেশের নিম্নোক্ত ক্ষতি হয়ে আসছেঃ

ক। গার্মেন্টস সেক্টরঃ মালামাল চুরি যাওয়ার কারণে ফ্যাক্টরি মালিক’কে পুনরায় মালামাল চট্টগ্রাম বন্দরে প্রেরণ করায় সময় ও অর্থের ক্ষতি হয়। বিদেশী ক্রেতা সঠিকভাবে ও সঠিকসময়ে মালামাল ডেলিভারি না পাওয়ার কারণে মালামালে মূল্য পরিশোধ করতোনা এবং পরবর্তীতে উক্ত ক্রেতা কর্তৃক ক্রয় আদেশ না পাওয়ার ফলে দিন দিন গার্মেন্টস সেক্টর প্রচুর লোকসানের সম্মুখীন হয়ে আসছিলো। মোটা দাগে এর ফলে বিদেশী বায়ারদের কাছ থেকে বাংলাদেশি গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপনের ঘাটতি দেখা যায়।

খ। দেশের সামগ্রিক লোকসানঃ গার্মেন্টস সেক্টরের মাধ্যমে দেশের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় হয়ে থাকে এবং সেইসাথে বিশ্বে বাংলাদেশের সুনাম অর্জিত হয়। কিন্তু উক্ত মালামাল চোরাইপথে বিক্রির কারণে বিপুল পরিমান রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হওয়ার সাথে সাথে বহিঃবির্শ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও সুনাম নষ্ট হচ্ছিলো। এভাবে চুরির ফলে বিদেশী ক্রেতারা তাদের প্রাপ্য মালামালের চেয়ে কম মালামাল পাওয়ায় বাংলাদেশী পোশাক প্রস্তুত কারক ও বিক্রেতাদের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলছে এবং এই চুরি রোধ করা সম্ভব না হলে বিদেশী ক্রেতাদের মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার সম্ভাবনা তৈরী হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের ক্রয় আদেশ অন্য পোশাক প্রস্তুতকারী দেশে চলে যাওয়ার আশংকা তৈরী হয়েছে এবং বাংলাদেশী পোশাক প্রস্তুতকারী কারখানাসমূহ আতংকগ্রস্থ হয়ে পড়েছে।

উপরোক্ত বিষয়ে আইনানুগ কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে এরূপ সংঘবদ্ধ চোরাকারবারী দলের বিরুদ্ধে র‌্যাব-৪ এর জোরালো অভিযান অব্যাহত থাকবে।