তরুণ বঙ্গবন্ধুর জীবন রক্ষায় একজন হাকীম খলিলুর রহমান

জাতীয় বিবিধ

নিজস্ব প্রতিনিধি : ১৯৪৩ সাল। দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ সম্মেলন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সম্মতিক্রমে বাংলাদেশ থেকে ডেলিগেট হিসেবে ভাগিনা মাখনকে নিয়ে তরুণ বঙ্গবন্ধু রওনা হলেন দিল্লির উদ্দেশ্যে।


বিজ্ঞাপন

বাকিটা চলুন জেনে নিই বঙ্গবন্ধুর স্বীয় জবানেঃ
“আমরা দিল্লি পৌঁছালে মুসলিম লীগ স্বেচ্ছাসেবক দল আমাদের পৌঁছে দিল এ্যাংলো এরাবিয়ান কলেজ প্রাঙ্গণে। তাবুতে আমরা দুইজন ছাড়াও আলিগড়ের একজন ছাত্র। এবং আরেকজন বোধহয় এলাহাবাদ বা অন্য কোথাকার হবে। বিরাট প্যান্ডেল করা হয়েছে। আমরা ডেলিগেট কার্ড নিয়ে সভায় উপস্থিত হলাম। বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের জন্য আলাদা জায়গা রাখা হয়েছে।………………
………(দৌড়-ঝাপ ইত্যাদি কারণে) শরীর আমার খারাপ হয়ে পড়ে। দিনের বেলায় ভীষণ গরম, রাতে ঠান্ডা। সকালে আর বিছানা থেকে ওঠতে পারি নাই। বুকে, পেটে আর সমস্ত শরীরে বেদনা। দুই তিন দিন পায়খানা হয় নাই। অসহ্য যন্ত্রণা আমার শরীরে। দুপুর পর্যন্ত না খেয়ে শুয়েই রইলাম। মাখন আমার কাছেই বসে আছে। ডাক্তার ডাকতে হবে, কাউকেই চিনি না। একজন স্বেচ্ছাসেবককে বলা হল, তিনি বললেন, “আভি নেহি, থোড়া বাদ”। তাকে আর দেখা গেল না, ‘থোড়া বাদই রয়ে গেল’। বিকালের দিকে মাখন খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ল, আমারও ভয় হল। এই বিদেশে কী হবে, টাকা পয়সাও বেশি নাই। মাখন বলল, ‘মামা আমি যাই, ডাক্তার যেখানে পাই, নিয়ে আসতে চেষ্টা করি, এভাবে থাকলে তো বিপদ হবে’। শহীদ সাহেব কোথায় থাকেন, জানি না। অন্যান্য নেতাদেরও বলে কোন ফল হয় নাই। কে কার খবর রাখে..?

মাখন যখন বাহিরে যাচ্ছিল, ঠিক এই সময় দেখি, হাকীম খলীলুর রহমান আমাকে দেখতে এসেছেন। তিনি জানেন না, আমি অসুস্থ। খলিলুর রহমানকে আমরা ‘খলিল ভাই’ বলতাম। ছাত্রলীগের বিখ্যাত কর্মী ছিলেন। আলিয়া মাদ্রাসায় পড়তেন এবং ইলিয়ট হোস্টেলে থাকতেন। ইলিয়ট হোস্টেল আর বেকার হোস্টেল পাশাপাশি। আমরা ঠাট্টা করে বলতাম ‘ইডিয়ট হোস্টেল’।
খলিল ভাই আলিয়া মাদ্রাসা থেকে পাশ করে দিল্লিতে এসেছেন এক বৎসর পূর্বে, হাকীম আজমল খাঁ সাহেবের হেকিমি বিদ্যালয়ে হেকিমি শিখবার জন্য। আমার অবস্থা দেখে বললেন, ‘কি সর্বনাশ, কাউকে খবর দাও নাই!’ তিনি মাখনকে বললেন, ‘আপনার ডাক্তার ডাকতে হবে না, আমি ডাক্তার নিয়ে আসছি।’
আধঘন্টার মধ্যে খলিল ভাই একজন হাকীম সাহেবকে নিয়ে উপস্থিত হলেন। তিনি আমাকে ভালোভাবে পরীক্ষা করে কিছু ঔষধ দিলেন। তাকে খলিল ভাই পূর্বেই আমার রোগের কথা বলেছিলেন।
তিনি আমাকে বললেন, ‘ভয় নাই। ঔষধ খাওয়ার পরে তিনবার আপনার পায়খানা হবে, রাতে আর কিছুই খাবেন না। ভোরে এই ঔষধটা খাবেন, বিকালে আপনি ভালো হয়ে যাবেন।’ তিনি যা বললেন, তাই হল। পরের দিন সুস্থবোধ করতে লাগলাম।”

গল্প আপাতত এখানেই শেষ।

সেদিন দলীয় নেতা-কর্মীদের কাউকেই তাঁর এই সংকটাপন্ন অবস্থায় পাশে দেখা যায় নি। জিবনের সেই সংকটময় মুহুর্তে আল্লাহ সুবহানু ওয়া তাআলা তাঁকে হাকীম খলিল সাহেবের মাধ্যমে নব জীবন দান করেছিলেন।
সেদিনের সেই তরুণ শেখ মুজিব ধীরে ধীরে হয়ে উঠলেন সকল বঙ্গবাসীর প্রিয় বন্ধু : বঙ্গবন্ধু।

ইতিহাসের চরম সত্য গল্পটি পাঠান্তে আমরা কিছু উপলব্ধি করতে পারলাম কি?

বঙ্গবন্ধুর মতো মানুষ হাকীমদের চিনতেন, চিনতেন হাকীমী তথা ইউনানী ঔষধ। এবং জীবন সন্ধিক্ষণে নিজ দেহে গ্রহণ করেছেন হাকীমের হাতে বানানো জড়ি-বুটি।

যাহোক, এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গ আসতে চাই, চাই ইউনানী আয়ুর্বেদের এই সময়ের রথী-মহারথীবৃন্দের নিকট যাঁরা এই সেক্টরদ্বয়ের ত্রাতার ভূমিকায় রয়েছেন- তাঁদের নিকট।

জিজ্ঞাস্য- স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর ভালবাসা এবং বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ তাগিদের পরও কেন উন্নতি বিহীন এই জগতদ্বয়?
সকলেই কি ব্যাক্তিস্বর্থের নিকট অন্ধ হয়ে যাবো? কেউ দুই এক জন কি এমন নেই যিনি বা যাঁরা স্বর্থত্যাগী হবেন?

অতঃপর জিজ্ঞাস্য- এই সেক্টরের উন্নয়নের জন্য ভিন্ন মন্ত্রণালয় হওয়া, কাউন্সিল হওয়া… প্রয়োজন; যাঁরা এই বিষয়ে কাজ করছেন তাঁদের প্রতি আমার অন্তরের অন্তঃস্থল হতে শ্রদ্ধা এবং দোয়া।
তাঁদের সহযোগিতায় প্রণিত ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা ও শিক্ষা আইনের ধারায় হাকীম-কবিরাজ পদবী বাদ দিয়ে ডাক্তার পদবীর সংযোজন তাও অনেকেই মেনে নিয়েছেন সময়ের দাবী হিসেবে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো এই সকল ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক ডাক্তারবৃন্দ যখন কর্মজীবন শুরু করবেন তখন ঔষধ হিসেবে ব্যবস্থাপত্রে কি লিখবেন?

তাঁরা কি এলোপ্যাথি লিখবেন?
নাকি শুধু ম্যানুফ্যাকচার্ড (কোম্পানির) ঔষধ লিখবেন?
নাকি উভয়টি লিখবেন?
নাকি বঙ্গবন্ধুর যিনি চিকিৎসা দিয়েছিলেন তাঁর মতো লিখবেন অর্থাৎ নির্ভেজাল ইউনানী লিখবেন?
নাকি একক/যৌগিক ভেষজ যেমন জোশান্দা-খেসান্দার সাথে ম্যানুফ্যাকচার্ড (কোম্পানির) মেডিসিন লিখবেন, যার চর্চা বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাতীত ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যান্য দেশে চলছে?

ভাবনা আপনাদের উপর। যারা শুদ্ধ চর্চা করেন বাস্তব অর্থেই বর্তমান সময়ে তাদেরকে নিজস্ব ঔষধের পাশাপাশি বিভিন্ন ভালো ভালো ইউনানী ও আয়ুর্বেদ কোম্পানির মেডিসিন ব্যবহার করতে হয়। কারণ সকল ঔষধ একজন ইউনানী ও আয়ুর্বেদ চিকিৎসক তৈরি করতে পারেন না, সেক্ষেত্রে তাদেরকে কোম্পানির মেডিসিনের সহায়তা নিতে হয়। এজন্য কোম্পানিসমূহকে এই শাস্ত্রদ্বয়ের বন্ধু মনে করা হয়। কারণ মানব সেবায় তারাও অংশীদার।

কিন্তু বিস্ময় এবং কষ্টের বিষয় হলো- যখন শুনতে পাই প্রস্তাবীত প্রায় চূড়ান্ত চিকিৎসা ও শিক্ষা আইনে হাকীম কবিরাজদের হাজার বছরের ঐতিহ্য তাজা বা শুষ্ক ভেষজ দিয়ে চিকিৎসা করা যাবে না তখন সত্যিই অবাক হতে হয়।

আরেকটি প্রশ্ন- বিদ্যমান ম্যানুফ্যাকচার্ড কোম্পানিসমূহ কয়টি ঔষধ প্রস্তুত করে? সর্বোচ্চ হলে ২৫০ টি। কিন্তু ফর্মুলেশান রয়েছে হাজার হাজার।
রোগ এবং স্থানভেদে ঔষধ বদলে যায়। একেক অঞ্চলে একেক ভেষজ ভালো জন্মায়। ইউনানী ও আয়ুর্বেদ চিকিৎসকবৃন্দ সহজপ্রাপ্য সেই সকল ভেষজ দিয়ে রোগীর সেবা করে থাকেন।
যেমন কোথাও আকন্দ বেশি হয় আবার কোথাও নিশিন্দা বেশি হয়। বাত-ব্যাধীর রোগীর চিকিৎসায় সহজ লভ্যটিই ব্যবহার হয়ে থাকে।

কাজেই ম্যানুফ্যাকচার্ড ঔষধের মাধ্যমে চিকিৎসা প্রায় অসম্ভব। তবে সহায়ক হিসেবে এগুলোর যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে পূণরায় বিচার বিশ্লেষণ করে দেখার আবেদন রইল- এই শাস্ত্রদ্বয়ের চিকিৎসকবৃন্দ যেন তাদের শ্বাশত ঐতিহ্য হতে বঞ্চিত না হন।

আরেকটি কথা, ম্যানুফ্যাকচার্ড ইউনানী ও আয়ুর্বেদ ঔষধের নামে কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী যারা বৃটিশ বেনিয়া গোষ্ঠীর মতো মানুষকে সরাসরি বিষ খাওয়াচ্ছে তাদের বিষয়েও ভাবতে হবে।

ইউনানী ও আয়ুর্বেদ শিল্প সমিতির নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, এদের কারণে জাতির সামনে আপনাদেরও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে এবং এই ধারা অব্যাহত থাকলে অচিরেই জনমানুষের মন থেকে ইউনানী ও আয়ুর্বেদ চিকিৎসার প্রতি ভালবাসার পরিবর্তে ঘৃণা তৈরি হবে। পাশাপাশি এলোপ্যাথ ডাক্তারবৃন্দ তো বলেই যাচ্ছেন ইউনানী ও আয়ুর্বেদ ঔষধ সেবনে কিডনি লিভার ধ্বংস হয়। এই সবগুলো বিষয়ের আলোকে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে ব্যার্থ হলে আম-ছালা দুইটাই যাবে।

তাই কি আমরা চাই? মোটেই চাই না।

আমরা চাই, যে বিশুদ্ধ ঔষধ সেবনে তরুণ বঙ্গবন্ধু নবজীবনে ফিরে এসেছিলেন সেই ইউনানী ও আয়ুর্বেদ ঔষধ।
তথ্যসূত্র : অসমাপ্ত আত্মজীবনী, বিভিন্ন পুস্তকাদি এবং তথ্যপ্রযুক্তি।