সংঘবদ্ধ মানব পাচারকারী চক্রের ২ হোতা গ্রেফতার

অপরাধ

বিশেষ প্রতিবেদক : রাজধানীর মিরপুর ও উত্তরা এলাকা হতে সংঘবদ্ধ মানবপাচারকারী চক্রের অন্যতম হোতা লিটন @ কথিত ডাঃ লিটন ও আজাদকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-৪. মাদক, পাসপোর্ট, অন্যান্য নথি ও সরঞ্জামাদি উদ্ধার হয়েছে, এ খবর সংশ্লিষ্ট সুত্রের।


বিজ্ঞাপন

এলিট ফোর্স হিসেবে র‌্যাব আত্মপ্রকাশের সূচনালগ্ন থেকেই আইনের শাসন সমুন্নত রেখে দেশের সকল নাগরিকের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার লক্ষে অপরাধ চিহ্নিতকরণ, প্রতিরোধ, শান্তি ও জনশৃংখলা রক্ষায় কাজ করে আসছে।

সাম্প্রতিককালে প্রতারণামূলক ফাঁদে ফেলে উচ্চ বেতনে লোভনীয় চাকুরীর প্রলোভনে নারী পাচারে জড়িত রয়েছে কয়েকটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট। জঙ্গিবাদ, খুন, ধর্ষণ, নাশকতা এবং অন্যান্য অপরাধের পাশাপাশি এসব ঘৃণিত মানবপাচারকারী চক্রের সাথে সম্পৃক্ত অপরাধীদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য র‌্যাব সদা সচেষ্ট।

গত মে ২০২১ মাসে পার্শ্ববর্তী দেশে বাংলাদেশের এক তরুণীর পৈশাচিক নির্যাতনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

এর প্রেক্ষিতে র‌্যাব পার্শ্ববর্তী দেশে মানব পাচারকারী চক্রের অন্যতম হোতা বস রাফিসহ চক্রের বেশ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেফতার করে। এছাড়াও দেশী/বিদেশী গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদে একজন মহিয়সী “মা” সম্পর্কে জানা যায়।

যে “মা” নিজ জীবন বিপন্ন করে, জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে পাচার হওয়া মেয়েকে উদ্ধার করে। উক্ত ঘটনায় কাল্লু-নাগিন চক্রের মূল হোতাসহ ০৩ জন পাচার চক্রের সদস্যকে গ্রেফতার করে র‌্যাব।

সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকজন নারী ভিকটিম মধ্যপ্রাচ্যে মানবপাচার সংক্রান্ত অভিযোগ র‌্যাবকে জানায়। ফলশ্রুতিতে র‌্যাব ছায়া তদন্ত শুরু করে ও গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে।

এরই ধারাবাহিকতায় র‌্যাব-৪ এর একটি আভিযানিক দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে শনিবার ১১ সেপ্টেম্বর সকালে রাজধানীর মিরপুর এবং উত্তরা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে।

উক্ত অভিযান পরিচালনা কালে সংঘবদ্ধ মানবপাচারকারী চক্রের অন্যতম হোতা (১) মোঃ লিটন মিয়া @ কথিত ডাঃ লিটন (৪৪), জেলা-গাইবান্ধা ও তার অন্যতম সহযোগী (২) আজাদ রহমান খান (৬৫), জেলা-লক্ষীপুর’কে গ্রেফতার করা হয়।

তাদের নিকট হতে উদ্ধার করা হয় প্রাইভেটকার, পাসপোর্ট, বিভিন্ন ব্যাংকের চেকবই, ল্যাপটপ, ৪০৭ পিস ইয়াবা, ১২ ক্যান বিয়ার ইত্যাদি। গ্রেফতারকৃতরা মধ্যপ্রাচ্যে মানব পাচার সংক্রান্ত সংশ্লিষ্টতার বিভিন্ন তথ্য প্রদান করে।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গ্রেফতারকৃতরা মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক একটি সংঘবদ্ধ মানবপাচারকারী চক্রের কর্ণধার।

উক্ত চক্রে দেশে বিদেশে ১৫-২০ জন সক্রিয় সদস্য রয়েছে। এই চক্রটি বিভিন্ন প্রতারণামূলক ফাঁদে ফেলে উচ্চ বেতনের লোভনীয় চাকুরীর প্রলোভন দেখিয়ে ইরাকসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে মানব পাচার করে।

পুরুষদের পাশাপাশি চক্রটি নারীদেরও পাচার করে থাকে। বিভিন্ন পেশায় দক্ষ নারী যেমন নার্স, পার্লার ও বিক্রয় কর্মীদের টার্গেট করে এই চক্রটি।

চক্রটি মূলত মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন হাসপাতাল, ক্লিনিক, মার্কেট, সুপারশপ, বিউটি পার্লারসহ বিভিন্ন চাকুরীর প্রলোভন দেখিয়ে ভিকটিমদের আকৃষ্ট করত। তাদের মূল টার্গেট ছিল বিদেশে চাকুরীচ্ছুক দক্ষ নারীদের প্রলব্ধু করা।

প্রতারণার কৌশল হিসেবে চক্রের মূল হোতা গ্রেফতারকৃত লিটন নিজেকে ঢাকা মেডিকেল থেকে পাস করা এমবিবিএস ডাক্তার হিসেবে ভ‚য়া পরিচয় দিত।

সে আরও জানাত যে, বর্তমানে গ্রেফতারকৃত লিটন ইরাকের বাগদাদে একটি স্বনামধন্য হাসপাতালে কর্মরত। অপর সহযোগী গ্রেফতারকৃত আজাদ একটি এজেন্সির আড়ালে নারী পাচারের সাথে যুক্ত।

এই চক্রটি বিদেশে পাচারের পর ভিকটিমদের অনৈতিক কাজের জন্য বিক্রি করে দিত। ভিকটিমদের প্রথমে বাংলাদেশ হতে টুরিস্ট ভিসায় মধ্য প্রাচ্যের একটি দেশে নেওয়া হত। অতঃপর উক্ত দেশে ১-২ দিন অপেক্ষা করিয়ে ভিজিট/টুরিস্ট ভিসায় ইরাকসহ অন্যান্য দেশে পাচার করত।

গ্রেফতারকৃত লিটন ইরাকে কয়েকটি সেফ হাউজে ভিকটিমদের অবস্থান করাত। অতঃপর সুবিধাজনক সময়ে ভিকটিমদের বিক্রি করে দেওয়া হত। উল্লেখ্য, গমনাগমনের জন্য ভিকটিমদের নিকট হতে ৩-৪ লক্ষ টাকা নেয়া হত।

আবার তাদেরকে প্রায় বাংলাদেশী সমমূল্যের তিন লক্ষাধীক টাকায় বিক্রি করা হত। চক্রটি রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বেশ কয়েকটি এলাকায় সক্রিয় রয়েছে।

এ চক্রটি ২০০/২৫০ জন মানব পাচার করেছে; তন্মধ্যে ৩৫-৪০ জন নারী রয়েছে বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানায়।

গ্রেফতারকৃত লিটন @ কথিত ডাঃ লিটন সরকারি একটি সংস্থায় মেডিক্যাল এ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে চাকুরী করত।

২০১০ সালে অনৈতিক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে সে চাকুরীচ্যুত হয়। চাকুরীচ্যুত হওয়ার পর সে ২০১৩ সালে ইরাকে গমন করে।

তার পর ইরাকে সংঘবদ্ধ চক্র গড়ে তোলে। ইরাকে অবস্থানকালীন সময়ে ২০১৬ সালে সে গ্রেফাতারকৃত আজাদ সম্পর্কে জানতে পারে ও পরবর্তীতে তার সাথে সখ্যতা তৈরী হয়। বাংলাদেশ থেকে নারীদেরও মধ্যপ্রাচ্যে পাচারের কাজে গ্রেফতারকৃত আজাদ সহযোগীতা করত।

প্রতারনামূলক ভাবে এই মানব পাচারের নামে অনৈতিক কর্মকান্ডে যুক্ত থাকায় সে ইরাকে গ্রেফতার এড়াতে বাংলাদেশে ফিরে আসে। সে দুইবার ইরাকে গ্রেফতার হয়েছিল বলে জানা যায়। বর্তমানে সে বালুর ব্যবসার সাথে জড়িত।

গ্রেফতারকৃত লিটন বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশে নিয়ে নারীদের পাচার করত। গ্রেফতারকৃত লিটনের নামে বিভিন্ন থানায় মানবপাচার ও প্রতারণাসহ একাধিক মামলা রয়েছে।

গ্রেফতারকৃত আজাদ ২০১৬ সাল হতে এই চক্রের সাথে জড়িত হয়। সে গ্রেফতারকৃত লিটনের সাথে যোগসাজসে মধ্যপ্রাচ্যে মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক অবৈধ মানব পাচারে যুক্ত হয়।

সে এই চক্রের পাসপোর্ট ও অন্যান্য নথিপত্রের ব্যবস্থা করত। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় প্রতারণা সংক্রান্ত বিভিন্ন মামলা রয়েছে। গ্রেফতারকৃত আসামীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।