মধ্যরাত,বাসে আগত একজন গর্ভবতী মা ও সদ্যজন্ম শিশু এবং একদল চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীদের বিজয়ের গল্প

স্বাস্থ্য

নিজস্ব প্রতিনিধি : ২১/০৯/২১, সময় তখন রাত ২.২৫ মিনিট। চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরী বিভাগে বসে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন ডাঃ রাজিব দে।
এমন সময় কক্সবাজার গামী দুরপাল্লার একটি বাস পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নিকটে এসে দাঁড়ায়। বাসের ১০- ১২ জন যাত্রী হন্তদন্ত হয়ে পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগে এসে জানায়, বাসে একজন প্রসূতি মা আছেন যার প্রসব-বেদনা শুরু হয়েছে।
চিকিৎসকরা যেন উনাকে যেয়ে দেখেন এই অনুরোধ করেন তারা।


বিজ্ঞাপন

একে দলবদ্ধ লোক তার উপর গভীর রাতে হাসপাতালের বাইরে যেয়ে চিকিৎসা দিতে বলায় একটু সন্দেহ ও ভীতি কাজ করলেও চিকিৎসক জীবনে মানব জীবন রক্ষার ডাক সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় আর কাল বিলম্ব করলেন না তরুন চিকিৎসক ডাঃ রাজিব দে।


বিজ্ঞাপন

চিকিৎসক ডাঃ রাজিব দে, হাসপাতালের কর্তব্যরত মিড ওয়াইফ বিবি হালিমা ও শরিফা জেসমিন সহ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে তো চিকিৎসাউ প্রদানকারী দলের চক্ষু চড়ক গাছ!

ডাঃ রাজিব দের ভাষ্যমতে , “আমরা সেখানে উপস্থিত হয়ে দেখি বাচ্চার মাথা ও একহাতয় বেরিয়ে ঝুলে আছে। এই অবস্থায় বাসের মধ্যে সামান্য আলোয় কিভাবে কাজ করব? অন্যদিকে তাৎক্ষনিক ঐ রকম জটিলতাপূর্ণ অবস্থায় রোগীকে স্থানান্তর করাও ঝুকিপূর্ণ”

এ যেন নিরস্ত গেরিলা লড়াই।
চিকিৎসক ডাঃ রাজিব দের নেতৃত্বে টিমে তখন মিড ওয়াইফ বিবি হালিমা, মিডওয়াইফ শরিফা জেসমিন, উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার অজয় কুমার শীল, ওয়ার্ডবয় হাসান ও রিন্টু নাথ যেন এক গেরিলা যোদ্ধার দল- সামনে জীবন বাচানোর যুদ্ধ।

সিদ্ধান্তও নিতে হল তাৎক্ষনিক, মা ও সন্তানের জীবন বাঁচাতে সেখানেই করে ফেলতে হবে সব আয়োজন।
হাতের কাছে যৎসামান্য যা কিছু ছিল তাই নিয়েই বাস যেন তখন এক মিনি অপারেশন থিয়েটার। চিকিৎসা প্রদানকারী দলের দক্ষতায় নিরাপদেই ভূমিষ্ট হল এক সন্তান। সীমিত সামর্থ্যের মাঝেও যেকোন স্থানে, যেকোন পরিস্থিতিতে চিকিৎসা সেবাদাতারা তাদের নায়কোচিতউ ভূমিকা দিয়ে মানুষের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন, এ তারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

সুষ্ঠুভাবে শিশু জন্ম নেওয়ার পর দ্রুততার সাথে মা ও সদ্যজাত শিশুকে পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে প্রসব পরবর্তী চিকিৎসা প্রদান করা হয়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, সন্তান সম্ভবা মিসেস ফারেছা (২৭ বছর) তার স্বামী আবদ্দুল্লাহ সহ নারায়ণগঞ্জ এর সাইনবোর্ড এলাকা থেকে চকরিয়ায় তার বাবার বাড়িতে যাচ্ছিলেন।

পথিমধ্যে প্রসববেদনা উঠলে বাসের অন্য যাত্রীদের সহায়তায় পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক , মিড-ওয়াইফ সহ অন্যান্য সকলের সহযোগিতায় এই অনন্য সাধারন ঘটনার সৃষ্টি হয় ।

পেশায় রিকশা চালক আবদুল্লাহ বলেন, ‘এটি আমাদের প্রথম সন্তান। আমরা এর আগে কোন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়নি। তাই সন্তান প্রসবের সময় সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণা ছিল না। প্রসব পরবর্তী সময়ের কথা ভেবে আমরা নারায়ণগঞ্জ থেকে চকরিয়া যাচ্ছিলাম। পথে আমার স্ত্রীর প্রসববেদনা উঠলে আমরা ঘাবড়ে যায়।পরে চালক এবং যাত্রীদের সহায়তায় এবং পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকদের আন্তরিকতায় আমি একটি সুস্থ ছেলে সন্তান পেয়েছি। এইজন্য আমি সকলের কাছে কৃতজ্ঞ’।

এই ব্যাপারে পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, ডাঃ সব্যসাচী নাথ জানান, ‘আমি এবং আমার সহকর্মীবৃন্দ সাধারণ জনগণের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার জন্য সার্বক্ষনিক কাজ করে যাচ্ছি। এই ধরণের একটি অত্যন্ত বিচক্ষণ এবং সময় উপযোগী কাজের জন্য ডাঃ রাজিব দে এবং তার পুরো টিমকে আমি ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানাই। উনাদের দেখে এমন ভাল কাজের জন্য অন্যরাও উৎসাহিত হবে বলে আমি আশা করি।’

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডাঃ শেখ ফজলে রাব্বি জানান, ‘এই ঘটনায় প্রমাণ করে স্বাস্থ্য বিভাগ যেকোন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কাজ করতে প্রস্তুত। আমি ডাঃ রাজিব দে এবং তার টিমের পাশাপাশি, বাস চালক,হেল্পার ও বাসের সকল যাত্রীদেরও ধন্যবাদ জানাই। এইটি আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভাবমূর্তি উজ্বল করেছে।’

এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত মা ও সন্তান সুস্থ্য আছেন। হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়ে যাওয়ার সময়ে পটিয়া উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মা ও নবজাতকের জন্য উপহারসামগ্রী প্রদান করেন। এই অসামান্য অবদানের জন্য তিনি চিকিৎসক এবং পুরো টিমকে সংবর্ধনার ব্যবস্থা করেন।