সংক্রমণ ছড়ালে বন্ধ হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
মাস্ক ও সামাজিক দূরত্বে অনীহা
নিজস্ব প্রতিবেদক : গত বৃহস্পতিবার করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু এবং নতুন শনাক্ত ছিল গত চার মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এদিন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান ২৪ জন। এর আগে ২৭ মে একদিনে ২২জনের মৃত্যুর কথা জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদফতর। সেই সঙ্গে একইদিনে করোনাতে শনাক্ত হন এক হাজার ১৪৪ জন। এর আগে গত ২২ মে এক হাজার ২৮ জন শনাক্ত হওয়ার কথা জানানো হয়েছিল। সেই হিসাবে করোনায় দৈনিক শনাক্তও গত চার মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।
একইদিনে দেশের আট বিভাগের মধ্যে তিন বিভাগেই করোনায় আক্রান্ত হয়ে কারও মৃত্যু হয়নি। তবে তার পরের দিন ২৪ সেপ্টেম্বর করোনাতে নতুন আক্রান্ত ও মৃত্যু কিছুটা বাড়লেও তার আগের দিনের তুলনায় শনাক্তের হার কমেছে।
গত শুক্রবার করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দেশে ৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে মোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াল ২৭ হাজার ৩৬৮ জনে। শুক্রবার স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে পাঠানো করোনাবিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। করোনায় রোগী শনাক্তের হার ৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ। এ নিয়ে টানা ছয়মাস পর করোনাতে রোগী শনাক্তের হার টানা চারদিন ধরে পাঁচ শতাংশের নিচে রয়েছে। এর আগে গত এক আগস্ট দৈনিক শনাক্তের হার ১০ শতাংশে নেমে আসে। সেদিন শনাক্তের হার ছিল ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। যা গত ৪ জুনের পর সর্বনিম্ন।
এ দিকে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, আমরা অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছি। এখনো অতিমারি শেষ হয়নি। আমরা কখনো যদি মনে করি সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হবে। শনিবার শিল্পকলা একডেমিতে বঙ্গবন্ধু-বাপু এক্সিবিশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা জানান। মন্ত্রী বলেন, এখন পর্যন্ত কোথাও এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। যদি হয় আমরা ব্যবস্থা নেব। কিছু জায়গায় সংক্রমণের ঘটনা ঘটছে। প্রাথমিক স্তরের বিষয়টি দেখভাল করছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। আমরা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকেরটা দেখছি।
দীপু মনি বলেন, আমরা আমাদের মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেখানে সমস্যা হয়েছে বিশেষ করে মানিকগঞ্জের একটি স্কুলের শিক্ষার্থী মারা গেছেন। আমি তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আমি গভীর সমবেদনা জানায়।
আমরা সেই কেসটি নিয়ে সিভিল সার্জনের সঙ্গে কথা বলেছি। সেই শিক্ষার্থী মাত্র ১ বার ১৫ তারিখে স্কুলে এসেছিলো। তার ৬/৭ দিন পর তার আক্রান্তের খবর পাওয়া যায় এবং সে মৃত্যুবরণ করে। দীপু মনি বলেন, আমাকে অনেক শিক্ষার্থী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানাচ্ছে এই স্কুলে এতজন আক্রান্ত, ওই স্কুলে এতজন অসুস্থ। আমি খোঁজ নিচ্ছি, অনুসন্ধান করছি কিন্তু এমন কিছুই পাচ্ছি না।
তবে আমরা সজাগ দৃষ্টি রাখছি। কোন অভিযোগ পাওয়া মাত্র আমরা সঙ্গে সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছি ও প্রয়োজনে ব্যবস্থা নিচ্ছি।
নভেম্বরে মাসের মাঝামাঝিতে এসএসসি ও ডিসেম্বরের শুরুতে এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে জানিয়ে দীপু মনি বলেন, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা যথা সময়ে অনুষ্ঠিত হবে। এজন্য পরীক্ষার্থীদের পড়াশুনার আহ্বান জানান তিনি সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, এখন প্রাক-প্রাথমিকে ক্লাসের কোন সুযোগ নেই। টিভি ও অনলাইনে ক্লাস চলছে। বাচ্চারা সেখান থেকেও ক্লাস করতে পারবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, কোনও দেশে যদি টানা দুই সপ্তাহ দৈনিক শনাক্তের হার পাঁচ শতাংশের নিচে থাকে তাহলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে বলে ধরা হবে।
দেশের জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, সংক্রমণ নিয়ে স্বস্তি এসেছে। তবে এই স্বস্তিতে তুষ্ট হয়ে স্বাস্থ্যবিধিতে ঢিলেঢালাভাব চলে এসেছে। মানুষ মাস্ক পরছে না, শপিং মল, গণপরিবহন, বেসরকারি অফিস, রেস্টুরেন্ট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে অভিভাবকদের ভিড়, হাসপাতালসহ কোথাও স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। স্বস্তিতে ভুগে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চললে আবার বিপর্যয় আসতে একটুও সময় লাগবে না। তার কারণ হিসেবে তারা বলছেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এর উদাহরণ রয়েছে।
তারা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল ভিয়েতনাম। কিন্তু বর্তমানে যে কয়েকটি দেশে সংক্রমণ বেশি, তার মধ্যে ভিয়েতনাম একটি। আমেরিকাতেও সংক্রমণ অনেক বেশি। সংক্রমণের এই নি¤œমুখী হারকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে টিকার ওপর জোর দিয়েছেন তারা। সঙ্গে অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মানার এই ঢিলেমি ত্যাগ করতে হবে, স্বাস্থ্যবিধি না মেনে কেবল টিকার ওপর নির্ভর করলে সেটা হবে বোকামি।
জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু করে আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত শনাক্ত নিম্নমুখী প্রবণতার দিকে যাচ্ছে। এর প্রমাণ হিসেবে তিনি জানান, এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে যেখানে রোগীর সংখ্যা ছিল ১১ হাজার ৭৭ জন, জুলাই মাসে সেখানে রোগী সংখ্যা হয় তিন লাখ ৩৬ হাজার ২২৬ জন। তবে বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মধ্য দিয়ে আগস্ট মাসে নতুন শনাক্ত কমে এসেছে। আগস্টে রোগী শনাক্ত হয়েছেন দুই লাখ ৫১ হাজার ১৩৪ জন।
এদিকে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক রোবেদ আমিন গত বুধবার (২২ সেপ্টেম্বর) অধিদফতর আয়োজিত বুলেটিনে বলেন, বাংলাদেশ এখন ভালো অবস্থানে রয়েছে। সংক্রমণ পরিস্থিতি একটি স্থিতিশীল পর্যায়ে এসেছে।
তবে তার মানে এই নয় যে করোনা চলে গেছে ‑ মন্তব্য করে অধ্যাপক রোবেদ আমিন বলেন, এখন তেমন কোনো বিধিনিষেধ নেই। অনেকে স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না, মাস্ক পরছেন না। কিন্তু সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে, এর কোনও বিকল্প নেই।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রতিদিনকার করোনা তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় জুলাই দেশে দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা প্রথম ১০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। অতিসংক্রমণশীল ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের তা-বে জুলাই ছিল করোনা মহামারিকালে ভয়ংকর। যদিও তার আগের মাস জুন থেকে দৈনিক শনাক্তের হার ওঠে যায় ২০ শতাংশের ওপরে। তবে জুলাইতে প্রায় প্রতিদিনই শনাক্ত ও মৃত্যুতে তার আগের দিনের রেকর্ড ভাঙ্গতে থাকে। এরিমধ্যে দেশে করোনাকালে একদিনে সর্বোচ্চ (গত ২৮ জুলাই) রোগী শনাক্ত হয় ১৬ হাজার ২৩০ জন। শনাক্তের হার ওঠে যায় ৩২ শতাংশের বেশি। ভয়ংকর জুলাই শেষ হবার পর তার রেশ চলতে থাকে আগস্ট মাস পর্যন্ত।
গত ১২ আগস্ট পর্যন্ত ৩৮ দিনের মধ্যে ৩০ দিনই শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি ছিল। আর করোনাকালে একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু হয় আগস্ট মাসের দুইদিন। গত ৫ এবং ১০ আগস্ট একদিনে সর্বোচ্চ ২৬৪ জনের মৃত্যুর কথা জানায় স্বাস্থ্য অধিদফতর। তবে আগস্টের প্রথম দিক থেকে রোগী শনাক্তের হার ক্রমেই কমছে। আর চলতি মাসে সংক্রমণের হার কমে এসেছে পাঁচ এর নিচে।
সংক্রমণ কমে আসায় সরকার কঠোর বিধি-নিষেধ তুলে দেয়। খুলে দেওয়া হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কোথাও স্বাস্থ্যবিধি না মানায় শঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সংক্রমণের হার কমাতে স্বস্তি রয়েছে, তবে যেভাবে চলাফেরা করছে মানুষ তাতে আবারও আমার ভেতরে সাংঘাতিক আশংকা রয়েছে জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের গঠিত পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য অধ্যাপক আবু জামিল ফয়সাল বলেন, করোনা শেষ হয়ে যায়নি।
এখনও সংক্রমণের হার পাঁচ শতাংশের নিচে রয়েছে, সংক্রমণ চলছে। আর যে কোনও সংক্রমণশীল রোগের চরিত্রই হচ্ছে যে কোনও সময় এটা আবার বেড়ে যেতে পারে। কেননা, এর মধ্যে হয়তো এই ভাইরাসের স্ট্রেইন বদলাবে, নতুন ভ্যারিয়েন্ট আসতে পারে।
তাই আমরা যদি স্বাস্থ্যবিধি ভুলে যাই তাহলে হঠাৎ করে আবার বেড়ে যাবে, তখন আবার সেই আগের অবস্থাতে ফেরত যাবো আমরা, বলেন অধ্যাপক আবু জামিল ফয়সাল। আবার অক্সিজেন নিয়ে হাহাকার, আইসিইউ-র বেড পাওয়া যাবে না, অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে রোগী মারা যাবে, হাসপাতালের বারান্দায় রোগীরা পড়ে থাকবে।
মৌলিক তিন স্বাস্থ্যবিধির ভেতরে প্রথমেই রয়েছে মাস্ক পড়া-কিন্তু মাস্কের ব্যবহার কোথাও নেই। ভয় পাচ্ছি- আবার নাকি ২০২০ সালের জুন-জুলাইতে যেটা হয়েছিল, ২০২১ সালের জুন-জুলাইতে যেরকম আচরণ দেখলাম করোনা ভাইরাসের, তার আবার পুরনো চিত্র দেখতে হয় কিনা, বলেন তিনি।
স্বাস্থ্যবিধি ভুলে গেলে তার মাশুল দিতে হবে-এটা যেন আমরা ভুলে না যাই মন্তব্য করে আবু জামিল ফয়সাল বলেন, সবাইকে মাস্ক পড়তে হবে আর সুষ্ঠু, সমন্বিত ও পরিকল্পিতভাবে টিকা কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে হবে।
মানুষ স্বাস্থ্যবিধি না মানলে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা যে কোনও সময়েই রয়েছে বলেন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর।
ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন, ভ্যারিয়েন্ট বদলাতে পারে, সংক্রমণশীল ভ্যারিয়েন্ট আসতে পারে। এখনও অসতর্ক হবার কোনও সুযোগ নেই, সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সাবধানে এবং সচেতন থাকতে হবে।
সামাজিক অবস্থার চেয়েও ব্যক্তিগত সচেতনতার ওপর বেশি জোর দিতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, বর্তমান স্বস্তি নিয়ে যদি স্বাস্থ্যবিধিতে ঢিলেমি দেওয়া হয় তাহলে আবারও বিপর্যয় আসতে পারে।