উত্তরাঞ্চলের গভর্মেন্ট হাউস উত্তরা গণভবন

জাতীয়

নিজস্ব প্রতিনিধি : আঠারো শতকে নির্মিত নাটোরের দিঘাপাতিয়া রাজবাড়ি বা উত্তরা গণভবন, বর্তমানে এটি উত্তরা গণভবন বা উত্তরাঞ্চলের গভর্মেন্ট হাউস নামে পরিচিত।


বিজ্ঞাপন

দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রাজা দয়ারাম রায় নাটোর রাজের রাজা রাম জীবনের দেওয়ান ছিলেন। দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা দয়ারাম রায় (১৬৮০-১৭৬০) ১৭৩৪ সালে প্রায় ৪৩ একর জমির উপর দিঘাপতিয়া প্রাসাদের মূল অংশ ও এর সংলগ্ন কিছু ভবন নির্মাণ করেন।

১৬৮০ সালে নাটোরের প্রখ্যাত কলম গ্রামের এক তিলি পরিবারে দয়ারাম রায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম নরসিংহ রায়। নাটোর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রামজীবন যখন পুঠিয়ার রাজা দর্পনারায়ণের অধীনে চাকুরী করতেন, সে সময়ে তিনি কাজ উপলক্ষ্যে চলনবিল এলাকার কলম গ্রামে পৌছেন। রামজীবন যখন পুঠিয়ার রাজা দর্পনারায়ন ঠাকুরের অধীনে সাধারণ একজন কর্মচারী তখন দয়ারাম তাঁর মাসিক ৮ আনা বেতনে চাকুরী করতেন। পরে সামান্য লেখাপড়া করে জমা খরচ রাখার মত যোগ্যতা অর্জন করেন এবং রামজীবন তাকে মাসিক ৮ আনার পরিবর্তে ৫ টাকা বেতনের মহুরী নিযুক্ত করেন।

পরবর্তীতে পুঠিয়ার রাজা দর্পনারায়নের স্নেহ, ভালবাসা ও সহানুভুতি, নবাব সরকারের ভ্রাতা রঘুনন্দনের প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং বাংলার নবাব দেওয়ান মুর্শিদকুলী খানের নেক-নজর সবকিছু মিলে যখন রামজীবন জমিদারী লাভ করেন তখন তারও ভাগ্য খুলতে থাকে। তিনি প্রথমে রাজা রামজীনের একজন সাধারণ কর্মচারী থাকলেও প্রতিভা, দক্ষতা আর বিশ্বস্ততা দিয়ে নাটোর রাজের দেওয়ান পর্যন্ত হয়েছিলেন। রাজা রামজীবন তাকে অত্যন্ত বিশ্বাস করতেন এবং প্রচুর অর্থ-সম্পদ তার কাছে গচ্ছিত রাখতেন। রাজা সীতারাম রায়ের পতনের পর দয়ারাম রায় নাটোর রাজ্যের একজন পরাক্রমশালী ব্যক্তিত্বে পরিণত হন।

যশোহরের রাজা সীতারাম রায় বিদ্রোহী হলে নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ নাটোর রাজের দেওয়ান দয়ারাম এর সাহায্যে তাকে দমন ও পরাজিত করে নাটোর কারাগারে বন্দি করে রাখেন। সীতারাম রায়কে পরাজিত করায় নবাব সরকারের দয়ারামের প্রভাব বেড়ে যায় এবং তিনি ‘‘রাই রাইয়া’’ খেতাবে ভুষিত হন। সীতারাম রায়কে পরাজিত করে তিনি মূল্যবান সম্পদসমূহ লুন্ঠন করেন। কিন্তু সীতারামের গৃহদেবতা কৃষ্ণজীর মূর্তি ছাড়া সব রামজীবনের হাতে অর্পন করেন। দয়ারামের এহেন ব্যবহারে রামজীবন খুশি হয়ে দয়ারামকে কৃষ্ণজীর মূর্তি স্থাপনের জন্য পুরস্কার স্বরূপ দিঘাপতিয়ায় একখন্ড জমি দান করেন এবং বর্তমান বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দির চন্দনবাইশা এলাকার নওখিলা পরগনা দান করেন। এটাই দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রথম জমিদারী। পরে তিনি লাভ করেন পরগনা ভাতুরিয়া তরফ নন্দকুজা, যশোহরের মহল কালনা ও পাবনা জেলার তরফ সেলিমপুর। এইভাবে দিঘাপতিয়া রাজবংশের ও জমিদারীর গোড়াপত্তন হয় ১৭৬০ সালে।

রাজবংশের ষষ্ঠ রাজা প্রমদানাথ রায়ের আমলে ১৮৯৭ সালে নাটোরের ডোমপাড়া মাঠে তিনদিনব্যাপী বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের এক অধিবেশন আয়োজন করেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তি এ অধিবেশনে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে যোগ দেন। তবে শেষ দিন ১৮৯৭ সালের ১২ জুন প্রায় ১৮ মিনিটব্যাপী এক প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পে রাজপ্রাসাদটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে রাজা প্রমোদনাথ রায় সম্পূর্ণ প্রাসাদ কমপ্লেক্সটি পুনর্নির্মাণ করেন। রাজা প্রমোদনাথ রায় চারদিকে সীমানা প্রাচীর দিয়ে বেষ্টিত রাজবাড়ির ভেতরে বিশেষ কারুকার্য খচিত মূল ভবনসহ ছোট-বড় মোট ১২টি ভবন নির্মাণ করেন। তিনি ১৮৯৭ সাল থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত ১১ বছর সময় ধরে বিদেশি বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী ও চিত্রকর আর দেশিয় কারিগরদের সহায়তায় সাড়ে ৪১ একর জমির উপর এই রাজবাড়িটি পুনর্নির্মাণ করেন। তিনি মোগল ও প্রাশ্চাত্য রীতির মিশ্রণে কারুকার্যময় নান্দনিক এই ভবনটিকে এক বিরল রাজ ভবন হিসেবে গড়ে তোলেন।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর দিঘাপতিয়া রাজ পরিবারের কিছু সদস্য দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যান। ১৯৫০ সালে জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন পাশ হওয়ার পর দিঘাপতিয়ার রাজ প্রাসাদটির রক্ষণাবেক্ষণে বেশ সমস্যা দেখা দেয়, ১৯৫২ সালে দিঘাপতিয়ার শেষরাজা প্রতিভানাথ রায় সপরিবারে রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করে কলকাতায় চলে যান। পরবর্তীতে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত রাজ প্রাসাদটি পরিত্যাক্ত থাকে, সমস্যা সমাধানে দিঘাপতিয়ার মহারাজাদের এই বাসস্থানকে ১৯৬৭ সালের তৎকালীন গভর্নরের বাসভবন করা হয়। পরবর্তি সময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ সালে এর নাম পরিবর্তন করে উত্তরা গণভবন করা হয়।

প্রাসাদের পিছন দিকে রয়েছে ফোয়ারাসহ একটি সুদৃশ্য বাগান। বাগানের এক কোণে রয়েছে প্রমাণ আকৃতির মার্বেল পাথরের তৈরি একটি নারীমূর্তি। ১৯৫২ সালের পর অবশ্য এ ভবনে আর কেউ বসবাস করেনি। পুরাতন ট্রেজারিভবনে স্থাপিত একটি সংগ্রহশালা রয়েছে এই প্রাসাদে, রাজ পরিবারের ব্যবহৃত ঐতিহাসিক দ্রব্যসামগ্রী ও তাদের ইতিহাস।
বর্তমানে এটি দর্শনার্থীদের জন্য স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতিসাপেক্ষে উন্মুক্ত রয়েছে।