পাটপণ্যের চাহিদা বাড়ছে বিশ্ববাজারে রফতানির সম্ভাবনা

অর্থনীতি এইমাত্র জাতীয় বানিজ্য

বিশেষ প্রতিবেদক
পাট খাতকে বিশেষ অগ্রাধিকার দিচ্ছে সরকার। রফতানিপণ্যে বৈচিত্র্য আনার পদক্ষেপ হিসেবে পাটপণ্যসহ কিছু পণ্যকে অগ্রাধিকার দেয়ায় বিশ্ববাজারে বিভিন্ন ধরনের পাটপণ্যের চাহিদা এখন বাড়ছে। ফলে পাটপণ্যের রফতানি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগাতে চায় সরকার। অন্যদিকে পাটপণ্যের রফতানিতে গত দু’বছর ধরেই মন্দা চলছে। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণভাবেও নামমাত্র পাটপণ্যের চাহিদা। দেশে বর্তমানে ৬শ কোটি টাকা মূল্যের প্রায় ৭০ হাজার টন পাটপণ্যের মজুদ পড়ে রয়েছে। অবিক্রীত পণ্যের এ বড় মজুদ নিয়ে বিপাকে রয়েছেন উদ্যোক্তারা। এমন পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়েই অনেক কারখানা উৎপাদন সক্ষমতার অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে। তারপরও উৎপাদিত পাটপণ্য বিক্রি বা রফতানি না হওয়ায় গুদামে পণ্য সংরক্ষণের ব্যয়, ব্যাংকের ঋণ পরিশোধের তাগাদা তীব্র হচ্ছে। এসব কারণে পাট খাতে চরম সংকট চলছে। পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় এবং বেসরকারি উদ্যোক্তা সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশের ভেতরে পাটপণ্যের বাজার ভালো না। রফতানিতেও চলছে খরা। বিগত দু’বছরের বেশি সময় ধরে ধারাবাহিকভাবে কমছে পাটপণ্যের রফতানি আয়। পাটপণ্য বলতে হোসিয়ান (চট), সেকিং (বস্তা), সিবিসি (কার্পেট প্যাকিং) ও পাটের সুতাকে বোঝানো হয়। তার বাইরে বহুমুখী পাটপণ্য হিসেবে কিছু পণ্য রফতানি হয়ে থাকে। সমাপ্ত (২০১৮-১৯) অর্থবছরে পাট ও পাটপণ্যের রফতানি কমেছে আগের বছরের তুলনায় ২১ শতাংশ। রফতানি হয়েছে ৮২ কোটি ডলারের পাট ও পাটপণ্য। আগের অর্থবছরে এই পরিমাণ ছিল ১০৩ কোটি ডলার। তারমধ্যে সবচেয়ে বেশি হারে রফতানি কমেছে পাটের ব্যাগ এবং বস্তার। আগের অর্থবছরের তুলনায় ৩৩ শতাংশ কমেছে রফতানি। পাটের সুতার রফতানি কমেছে ২১ শতাংশ।
সূত্র জানায়, এদেশের পাটপণ্য রফতানি কমে যাওয়ার প্রধানতম একটি কারণ হচ্ছে প্রতিবেশী ভারত সরকারের অ্যান্টিডাম্পিং শুল্কারোপ। কারণ ভারত এদেশের পাটের একটি বড় বাজার। বিগত ২০১৭ সালের শুরুতে বাংলাদেশি পাটপণ্যে টনপ্রতি সর্বোচ্চ ৩৫২ ডলারসহ বিভিন্ন হারে অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক্কারোপ করেছে দেশটি। তারপরই দেশটিতে পাটপণ্যের রফতানি কমছে ব্যাপক হারে। ভারতীয় উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা উৎপাদন ব্যয়ের তুলনায় কম দামে ভারতে পাটপণ্য রফতানি করে। তবে বাংলাদেশ এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে আসছে। তাছাড়া ভারত ছাড়াও পাটপণ্যের প্রায় সব বাজারেই নানান সঙ্কট চলছে। উল্লেখযোগ্য বাজারের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের সংঘাতময় পরিস্থিতিতে রফতানি কমেছে। আফ্রিকান দেশগুলোতে ঘানা ছিল বাংলাদেশের পাটের প্রধান বাজার। বছর দুয়েক আগে দেশটিতে পাটকল চালু করেছে ভারত। এ কারণে সেখানেও এখন আর বাংলাদেশের পাটপণ্যের চাহিদা নেই।
সূত্র আরো জানায়, বেসরকারি পাটকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএমএ) তথ্যানুযায়ী, সর্বশেষ হিসাব পর্যন্ত তাদের মিলগুলোর অবিক্রীত পাটপণ্যের পরিমাণ ৭০ হাজার টন। বর্তমান বাজার দরে মূল্য ৫৮০ থেকে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। প্রায় দুই বছর ধরে এসব পণ্য গুদামে পড়ে আছে। বিক্রি না হওয়ায় সক্ষমতার তুলনায় উৎপাদন অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে অনেক কারখানা। তারপরও মজুদ বাড়ছে। গত বছরের জুলাইয়ে মজুদের পরিমাণ ছিল ৪০ হাজার টন। অর্থাৎ উৎপাদন কমিয়ে আনার পরও এক বছরে অতিরিক্ত মজুদ বেড়েছে ৩০ হাজার টন। এ বাস্তবতায় কয়েকটি মিল বন্ধ হয়ে গেছে। একরম একটি মিল খুলনার আফিল জুট মিলস। লোকসানজনিত অর্থ সংকটেই কারখানাটি বন্ধ করতে হয়েছে।
এদিকে পাটের অভ্যন্তরীণ ব্যবহার বৃদ্ধি এবং পরিবেশ সুরক্ষায় ২০১০ সালে আইন করে সরকার। সেখানে বিভিন্ন পণ্যে পাটের মোড়ক ব্যবহারে বাধ্যবাধকতার বিধান করা হয়। প্রথমে ৬টি, পরে ১৩টি এবং সবশেষ মোট ১৯টি পণ্যে পাটের মোড়ক ব্যবহারে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয় ওই আইনে। আইনে জেল-জরিমানাসহ কঠোর শাস্তির বিধানও রাখা হয়। তবে এ আইনের প্রয়োগ সাম্প্রতিককালে তেমন একটা চোখে পড়ে না। মূলত বিগত ২০১৭ সালে বন্যায় সিলেট অঞ্চলের হাওরের ধান তলিয়ে যায়। তখন ধান-চালের মজুদ সংকট তীব্র হয়। বন্যার পর চাল আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক কমানোসহ পাটের ব্যাগ ব্যবহারে শিথিলতার সুযোগ দেয়া হয়। তারপর থেকে ওই আইনের আর তোয়াক্কা করছেন না ব্যবসায়ীরা। বিগত বছরগুলোতে আইন বাস্তবায়নে বিচ্ছিন্ন এবং মৌসুমি অভিযান থেকে কিছু সুফল পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু অনেক দিন ধরে সেরকম কোনো অভিযানও আর চোখে পড়ছে না। পাটের মোড়কের ব্যবহারও কমে গেছে নিদারুণভাবে। পলিথিনসহ অন্যান্য ব্যাগই এখন পণ্যের অন্যতম মোড়ক। তবে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণলায়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পাটের অভ্যন্তরীণ বাজার বাড়াতে ১৯ পণ্যে পাটের মোড়ক ব্যবহারে বাধ্যবাধতামূলক আইন কার্যকরে আগামি মাসে রাজধানীসহ সারাদেশে অভিযান চালানো হবে। ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান পরিচালনা করবে। রাজধানীর প্রবেশপথ, সকল স্থল ও নৌবন্দর, সড়ক-মহাসড়কসহ সারাদেশে একসঙ্গে চালানো অভিযানে র‌্যাব-পুলিশসহ অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অংশ নেবেন। এবারই প্রথম উপজেলা পর্যায়েও অভিযান চালানো হবে। এই ১৯ পণ্য হচ্ছে- ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার, চিনি, মরিচ, হলুদ, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, ডাল, ধনিয়া, আলু, আটা, ময়দা ও তুষ-খুদ-কুঁড়া, পোলট্রি ফিড ও ফিস ফিড। আইনটি বাস্তবায়ন করা গেলে প্রতি বছর ১০০ কোটি পাটের বস্তার চাহিদা তৈরি হবে। স্থানীয় বাজারে পাট ও পাটজাত পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাবে, চাষিরাও পাটের ন্যায্য মূল্য পাবেন।
অন্যদিকে বিশ্নেষকদের মতে, পাট খাতের বিদ্যমান সংকট উত্তরণে বাজেটে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। চার বছর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাটপণ্যকে প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্যের মর্যাদা দেয়ার জন্য সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। কিন্তু আজও তা কার্যকর হয়নি। এই মর্যাদা দেয়া হলে অন্যান্য কৃষিপণ্যের মতো পাটপণ্য রফতানি করে উদ্যোক্তারা ২০ ভাগ প্রণোদনা পেতেন। এতে করে পাটচাষিরাও দাম বেশি পেতেন। চাষও বাড়ত। ফিরত পাটের সুদিন। কিন্তু সুদিন তো দূরে থাক, এ খাতে সংকট প্রকট হচ্ছে। তবে পাটের বাণিজ্য বাড়াতে এখনও আশাবাদী সরকার। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, পাট খাতকে বিশেষ অগ্রাধিকার দিচ্ছে সরকার। রফতানিপণ্যে বৈচিত্র্য আনার পদক্ষেপ হিসেবে পাটপণ্যসহ কিছু পণ্যকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। বিশ্ববাজারে বিভিন্ন ধরনের পাটপণ্যের চাহিদা এখন বাড়ছে। ফলে পাটপণ্যের রফতানি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগাতে চায় সরকার।
এ বিষয়ে বিজেএমএর সচিব আবদুল বারিক খান জানান, পাটপণ্য রফতানিতে মন্দা পরিস্থিতি মোকাবেলায় অভ্যন্তরীণ বাজার বাড়াতে সিমেন্ট প্যাকিংয়ে পলিথিন ব্যাগের পরিবর্তে পাটের মোড়ক বাধ্যতামূলক করার দাবি জানিয়েছেন তারা। এখন বছরে ৭০ কোটি সিমেন্টের ব্যাগের চাহিদা রয়েছে। দুই বছর আগে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে এই অনুরোধ জানানো হলেও এখন পর্যন্ত কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। তাছাড়া পাটপণ্যের রফতানি বাজার সম্প্রসারণে সরকারি উদ্যোক্তা এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে বিভিন্ন দেশে মিশন পাঠানোর অনুরোধ রক্ষা করা হয়নি। আগামি সপ্তাহে ভারতের একজন মন্ত্রী ঢাকায় আসবেন। তার সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে অ্যান্টিডাম্পিং নিয়ে আলোচনা হবে। উৎপাদন ব্যয়ের তুলনায় কম দামে ভারতে রফতানির তথ্য যে সঠিক নয় সেসব তথ্য তুলে ধরে অ্যান্টিডাম্পিং প্রত্যাহারে ভারতীয় মন্ত্রীকে অনুরোধ করা হবে।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *