ডেঙ্গুর মহামারী রূপ

জাতীয় জীবন-যাপন জীবনী ঢাকা রাজধানী স্বাস্থ্য

উদ্বিগ্ন প্রধানমন্ত্রী

মহসীন আহমেদ স্বপন : মহামারী আকার ধারণ করেছে ডেঙ্গু। জ্বর হলেই হাসপাতালে গিয়ে পরীক্ষা করলে ধরা পড়ছে ডেঙ্গু। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে এখন আর তিল ধারণের ঠাঁই নেই। ভর্তি ৮০ ভাগই ডেঙ্গু রোগী। মিনিটে মিনিটে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী। মায়েরা আসছে রুগ্ন শিশুকে কোলে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে। হাসপাতালে একটাও সিট খালি নেই! কী মর্মান্তিক পরিস্থিতি। রোগীর জায়গা না হলে কী হবে অ্যাডিস মশারা ঠিকই রয়েছে হাসপাতালে। ডেঙ্গু উদ্বেগজনক হারে বাড়লেও এখনই মহামারী বলা যাবে না বলে জানিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন।
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে শকে গিয়ে ইতিমধ্যে বক্ষব্যাধি হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স হাসি সমাদ্দার (১৮) মারা গেছেন। ডেঙ্গুর এমন ভয়াবহ প্রকোপ নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বর্তমানে লন্ডন সফরে থাকলেও তিনি প্রায় প্রতিদিন টেলিফোনে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেকের কাছে পরিস্থিতি জানতে চাচ্ছেন।
বিশেষ করে রোগীরা যেন সুচিকিৎসা পান সে বিষয়ে সতর্ক থাকার নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। এদিকে রাজধানীসহ সারা দেশে সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসায় ওয়ান স্টপ সেন্টার চালু হচ্ছে। এ সেন্টার থেকে ডেঙ্গু রোগীদের প্রাথমিক সেবা প্রদান, প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও জটিল রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। ভয়ানক ডেঙ্গু জ্বরের অসহনীয় পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য এবং পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। রোগীদের দিতে হবে না কোন ধরনের ফি।
এদিকে, কোনো কোনো বেসরকারি হাসপাতাল ডেঙ্গু জ্বর পরীক্ষার নামে প্রয়োজন নেই এমন পরীক্ষাও দিচ্ছে। এভাবে হাসপাতালগুলো ব্যবসা করছে- বেসরকারি হাসপাতালের কয়েকজন চিকিৎসক এমন অভিযোগ করেছেন।
জানা গেছে, এ বছর অ্যাডিস মশার কামড়ে আক্রান্ত হচ্ছেন ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলে। তবে দরিদ্র ও মধ্যবৃত্তি মানুষের মাধ্য আক্রান্তের হার এ বছর বেশি। কর্মক্ষম মানুষের ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ায় অনেক পরিবার আর্থিক সংকটে পড়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেল্থ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকার সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ৫৩৬ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন।
এদিকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল প্রশাসনিক ভবন ভরে গেছে ডেঙ্গু রোগীতে। হাসপাতালে সিট নেই। রোগীদের ক্যান্টিনের সামনে করিডরে রেখেই চিকিৎসা দিচ্ছেন ডাক্তাররা।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ হাসপাতালগুলোতে ওয়ান স্টপ সেন্টার চালুর বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ডেঙ্গু রোগীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই একই স্থান থেকে প্রয়োজনীয় সেবা দিতে ওয়ান স্টপ সেন্টার চালুর সিদ্ধান্ত হয়েছে। আগামী দু-তিন দিনের মধ্যেই এ সেন্টার চালু হবে। তিনি আরো বলেন, ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে গাইড লাইন সঠিকভাবে অনুসরণ করলেই ঝুঁকি বহুলাংশে কমে যাবে। ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. শফি আহমেদ বলেন, এ হাসপাতালে ৭০ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন। ডেঙ্গু রোগীর চাপে অন্য রোগীদের চিকিৎসা বিঘিœত হচ্ছে। কিন্তু কিছুই করার নেই। ডেঙ্গু রোগীদের জন্য বহিঃবিভাগে রক্ত পরীক্ষা ফ্রি করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মিলন অডিটরিয়ামে বাংলাদেশ সোসাইটি অব মেডিসিন কর্তৃক আয়োজিত একটি বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে ডেঙ্গু জ্বরের বর্তমান সময়ের ভয়াবহতা ও কার্যকরী ব্যবস্থাপনার’ উপর আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক এমপি বলেছেন, ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসায় বাংলাদেশের সাফল্য বিশ্বের যেকোন দেশের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত দেশগুলোর মধ্যে ফিলিপাইনে প্রায় ৫০০ জন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ায় প্রায় ১০০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। অথচ বাংলাদেশে গত জানুয়ারি থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ৭৭৬৬ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হলেও ৫৯৩৮ জন ডেঙ্গু রোগীই দেশের সরকারি হাসপাতালগুলো থেকে সেবা নিয়ে সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরে গেছেন। এর মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরে দেশে মাত্র ৮ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। সুতরাং ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্কিত হবার কিছু নেই। ডেঙ্গু রোগে সুচিকিৎসার সব ধরনের ব্যবস্থাপনা সরকারি হাসপাতালে রয়েছে। তবে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে মশা মেরে ফেলতে আরো জোড়ালো ভূমিকা রাখতে হবে।
তিনি বলেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। মিডিয়াকে আতঙ্ক ছড়ানোর মতো সংবাদ প্রকাশ না করতে অনুরোধ জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী। জাহিদ মালেক বলেন, বর্তমানে অ্যাডিস মশা অনেক হেলদি। তাদের প্রজনন ক্ষমতাও বেশি। রোহিঙ্গাদের মতই তাদের প্রজনন ক্ষমতা। যেভাবে রোহিঙ্গা পপুলেশন আমাদের দেশে এসে বেড়েছে, সেভাবেই এই মসকিউটো পপুলেশনও বেড়েছে। আমরা তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি।
সিটি করপোরেশনের উদ্দেশে মন্ত্রী বলেন, ভালো ওষুধ স্প্রে করেন। যাতে অ্যাডিস মশা না বাড়তে পারে। সেইসঙ্গে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান মন্ত্রী।
অধিবেশনে আরো উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব মো. আসাদুল ইসলাম, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব শেখ ইউসুফ হারুন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ, ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক খান আবুল কালাম আজাদ, বাংলাদেশ সোসাইটি অব মেডিসিনের সভাপতি অধ্যাপক মো. বিল্লাল আলম ও মহাসচিব অধ্যাপক আহমেদুল কবির প্রমূখ। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন। অধিবেশনে দেশে ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে বিদ্যমান ভয়াবহতা ও ডেঙ্গু জ্বরের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বিষদ আলোচনা করা হয়।
অ্যাডিস মশা নিধনে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। বিশেষ করে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার চিত্র ভয়াবহ। রাজধানীর মশা নিধনে দুই সিটি করপোরেশনের ব্যবহার করা ওষুধের সমালোচনা করেছেন হাইকোর্ট। এদিকে ঢাকা সেনানিবাস এলাকায় ডেঙ্গু নির্মূল অভিযান শুরু হয়েছে। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ ২৫জুলাই ঢাকা সেনানিবাসস্থ অফির্সাস ক্লাব প্রাঙ্গনে ডেঙ্গু নির্মূল অভিযান-২০১৯ এর উদ্বোধন করেন।
আক্রান্তের সংখ্যা রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে : বিগত কয়েক বছরের মধ্যে ২০১৮ সালে ১০ সহস্রাধিক নারী-পুরুষ ও শিশু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার নতুন রেকর্ড হয়েছিল। চলতি বছরের (২০১৯) পাঁচ মাসেরও বেশি সময় বাকি থাকতেই ডেঙ্গু আক্রান্তে গত বছরের রেকর্ড ভঙ্গ হতে চলছে। চলতি বছরের ২৫ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ৯ হাজার ২৫৬ জন। তাদের মধ্যে চলতি মাসেই সর্বোচ্চসংখ্যক ৭ হাজার ১১২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, কয়েক দিন ধরে যে হারে ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে তাতে আশঙ্কা করা হচ্ছে এ মাস শেষ হওয়ার আগেই গত বছরের আক্রান্ত হওয়ার রেকর্ড ভেঙে যাবে। এদিকে ৯ হাজারেরও বেশি রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলছেন, দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সিঙ্গাপুর, তাইওয়ানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ তত্ত্ব নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআরবি) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জাদি সাবরিনা ফ্লোরা বলেন, গণমাধ্যম বা অন্যান্য যে কেউ ডেঙ্গুতে মৃত্যু দাবি করলেও রোগ তত্ত্ব ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে গঠিত কমিটি মৃত্যুর সঠিক কারণ নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে এমন ঘোষণা দিতে পারেন না।
ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হোক প্রতিটি ঘরে : ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন নেই। ডেঙ্গুর ভাইরাস চার টাইপের, এই চার ভাইরাসের প্রতিরোধে কাজ করে, এমন ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়নি। তাই ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধের মূলমন্ত্রই হলো অ্যাডিস মশার বিস্তার রোধ এবং এই মশা যেন কামড়াতে না পারে, তার ব্যবস্থা করা। মনে রাখতে হবে, সুন্দর সুন্দর দালান কোঠায় এডিস মশা বাস করে। স্বচ্ছ পরিষ্কার পানিতে এই মশা ডিম পাড়ে।
ময়লা, দুর্গন্ধযুক্ত ড্রেনের পানি এদের পছন্দসই নয়। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে অ্যাডিস মশার ডিম পাড়ার উপযোগী স্থানগুলোকে পরিষ্কার রাখতে হবে এবং একইসঙ্গে মশক নিধনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এই রোগ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হলো ব্যক্তিগত সতর্কতা এবং অ্যাডিস মশা প্রতিরোধ।
এডিস মশা মূলত দিনের বেলা, সকাল ও সন্ধ্যায় কামড়ায়। তবে রাত্রে উজ্জ্বল আলোতেও এডিস মশা কামড়াতে পারে। মশার কামড় থেকে বাঁচতে ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করতে হবে। সম্ভব হলে ঘরের দরজা ও জানালায় নেট লাগানো যেতে পারে। প্রয়োজনে মসকুইটো রিপেলন্ট স্প্রে, লোশন, ক্রিম, কয়েল ম্যাট ব্যবহার করা যেতে পারে। শিশুদের হাফপ্যান্টের বদলে ফুলপ্যান্ট বা পায়জামা পরাতে হবে।
এডিস মশা জমা হওয়া স্বচ্ছ পানিতে ডিম পাড়ে। তাই ঘরে সাজানো ফুলদানি, অব্যবহৃত কৌটা, যেকোনো পাত্র বা জায়গায় জমে থাকা পানি তিন থেকে পাঁচ দিন পরপর ফেলে দিতে হবে। এতে এডিস মশার লার্ভা মারা যায়। পাত্রের গায়ে লেগে থাকা মশার ডিম অপসারণে পাত্রটি ভালোভাবে ঘষে পরিষ্কার করে নিতে হবে।
ঘরের বাথরুমে কোথাও জমানো পানি পাঁচ দিনের বেশি যেন না থাকে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। ঘরের অ্যাকুয়ারিয়াম, ফ্রিজ বা এয়ার কন্ডিশনারের নিচে এবং মুখ খোলা পানির ট্যাংকে যেন পানি জমে না থাকে, সে ব্যবস্থা করতে হবে।
বাড়ির ছাদে অনেকেই বাগান করে থাকেন। সেখানে টবে বা পাত্রে যেন কোনো ধরনের পানি পাঁচ দিনের বেশি যেন না জমে, সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। বাড়ির আশপাশে ঝোপঝাড়, জঙ্গল, জলাশয় ইত্যাদি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। ঘরের বাইরে মাঝেমধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে বৃষ্টি হওয়ার ফলে পানি জমতে পারে যেমন: ফুলের টব, প্লাস্টিকের পাত্র, পরিত্যক্ত টায়ার, প্লাস্টিকের ড্রাম, মাটির পাত্র, টিনের কৌটা, ডাবের পরিত্যক্ত খোসা, কন্টেইনার, মটকা, ব্যাটারির শেল, পলিথিন, চিপসের প্যাকেট ইত্যাদি। এসব জায়গায় জমে থাকা পানি পরিষ্কার করতে হবে।
সপ্তাহে অন্তত তিন দিন মশা নিধনের জন্য স্প্রে বা ফগিং করতে হবে। বিভিন্ন রাস্তার আইল্যান্ডে সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য ফুলের টব, গাছপালা, জলাধার ইত্যাদি দেখা যায়। এখানে বৃষ্টির পানি জমে থাকতে পারে। সেগুলোতেও যেন পানি জমে না থাকে, সেদিকে খেয়াল দিতে হবে।
এ ছাড়া আরও কতগুলো বিষয়ে খেয়াল রাখা জরুরি: এডিস মশা সাধারণত সূর্যোদয়ের আধা ঘণ্টার মধ্যে ও সূর্যাস্তের আধা ঘণ্টা আগে কামড়াতে পছন্দ করে। তাই এই দুই সময়ে মশার কামড় থেকে সাবধান থাকুন।
বর্ষাকালে ঘুমানোর আগে অবশ্যই মশারি ব্যবহার করুন। এটা ডেঙ্গু প্রতিরোধের সর্বোত্তম পন্থা। এডিস মশা দিনের বেলাতেও কামড়ায়। তাই দিনের বেলা ঘুমালেও মশারি ব্যবহার করুন। সম্ভব হলে শুধু দিন নয়, রাতের বেলাও সারা শরীরে মশা নিরোধক ক্রিম ব্যবহার করা দরকার। মশা তাড়াতে অনেকে তেলও ব্যবহার করে থাকে।
বাসাবাড়ি, হাসপাতাল, অফিস-আদালতের আনাচকানাচে মশার স্প্রে বা ওষুধ ছিটান। তাহলে এসব জায়গায় মশা বাড়বে না।
বাসার আশপাশে ময়লা পানি যাতে জমতে না পারে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
জানালার পাশে তুলসীগাছ লাগান। এই গাছে এমন কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রয়েছে, যা মশা তাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
মশা নিধনে নতুন বাহিনী হলো গাপ্পি মাছ। সব ধরনের আবহাওয়ায় গাপ্পি মাছ দ্রুত মানিয়ে নিতে পারে। পানির ওপরের অংশে ঘোরাফেরা করে। এ মাছ মশার লার্ভা খেয়ে ফেলে বলে বিভিন্ন দেশে মশা নিয়ন্ত্রণে গাপ্পির ব্যবহার রয়েছে। একটি গাপ্পি মাছ দিনে গড়ে ৫০টি লার্ভা ধ্বংস করতে পারে। প্রতিবেশী ভারতে এ মাছের সাহায্যে মশা ধ্বংস করা হচ্ছে।
প্রাকৃতিক উপায়ে মশা তাড়াতে কর্পূর ব্যবহারের বিকল্প নেই। দরজা-জানালা বন্ধ করে কর্পূর জ্বালিয়ে রুমের ভেতর রাখুন। ২০ মিনিট পর দেখবেন মশা একেবারেই চলে গেছে। মশার হাত থেকে বাঁচতে প্রতিদিন সকালে এবং সন্ধ্যায় কর্পূর জ্বালিয়ে রাখুন।
একটি বেসরকারি হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের একজন চিকিৎসক এম এ আজহার জানান ডেঙ্গু জ্বর হলে প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেওয়াও জরুরি। ডেঙ্গু প্রধানত দুই ধরনের হয়—ক্ল্যাসিক্যাল ডেঙ্গু ফিভার ও হেমোরেজিক ফিভার। ক্ল্যাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরে সাধারণত তীব্র জ্বর এবং শরীরে প্রচ- ব্যথা হয়ে থাকে। জ্বর ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে। শরীরের বিভিন্ন অংশে, বিশেষ করে মাথায়, চোখের পেছনে, হাড়, কোমর, পিঠসহ অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশিতে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়। জ্বর হওয়ার চার থেকে পাঁচ দিন পর সারা শরীরে লালচে দানা দেখা যায়, সঙ্গে বমি বমি ভাব বা বমি, রোগীর অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ করা, রুচি কমে যাওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যেতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দুই বা তিন দিন পর আবার জ্বর আসে।
ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বরে শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্ত পড়া, পায়খানার সঙ্গে তাজা রক্ত বা কালো পায়খানা, মেয়েদের বেলায় অসময়ে ঋতুস্রাব বা রক্তক্ষরণ, বুকে বা পেটে পানি আসা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়। ডেঙ্গু জ্বরের সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ হলো ডেঙ্গু শক সিনড্রোম।
ডেঙ্গু জ্বর সন্দেহ হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করাতে হবে। চিকিৎসক এম এ আজহার বলেন, জ্বরের চার থেকে পাঁচ দিন পর সিবিসি এবং প্লাটিলেট টেস্ট করতে হবে। এর আগে টেস্ট করলে রিপোর্টে ডেঙ্গু রোগের জীবাণু ধরা নাও পড়তে পারে। সাধারণত প্লাটিলেট কাউন্ট এক লাখের কম হলে ডেঙ্গু ভাইরাসের কথা মাথায় রেখে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
ডেঙ্গু অ্যান্টিবডির পরীক্ষা পাঁচ থেকে ছয় দিন পর করা যেতে পারে। এটি রোগ শনাক্তকরণে সাহায্য করে। যেহেতু রোগের চিকিৎসায় এর কোনো ভূমিকা নেই, তাই এই পরীক্ষা না করলেও কোনো সমস্যা নেই। প্রয়োজনে ব্লাড সুগার, লিভারের পরীক্ষা, যেমন: এসজিওটি, এসজিপিটি, এলকালাইন ফসফাটেজ ইত্যাদি করাতে হতে পারে।
আবার চিকিৎসক যদি মনে করেন, রোগী ডিআইসি–জাতীয় জটিল কোনো সমস্যায় আক্রান্ত, সে ক্ষেত্রে প্রোথ্রোম্বিন টাইম, এপিটিটি, ডি-ডাইমার ইত্যাদি পরীক্ষা করাতে হতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বরের জন্য দিনে সর্বোচ্চ চারবার প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ সেবন করতে হবে। পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে।
জ্বর কমানোর জন্য বারবার শরীর মুছে দিতে হবে। জ্বরে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। তাই প্রচুর পানি ও তরলজাতীয় খাবার, যেমন: ফলের জুস, শরবত ইত্যাদি পান করতে হবে। বমির কারণে যদি কোনো রোগী পানি পান করতে না পারেন, সে ক্ষেত্রে শিরাপথে স্যালাইন দিতে হবে। অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যাসপিরিন বা অন্য কোনো ব্যথানাশক ওষুধ একেবারেই সেবন করা যাবে না।
সাধারণত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত সব রোগীকেই রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। রক্তের প্লাটিলেটের পরিমাণ কমে গেলে জরুরি ভিত্তিতে প্লাটিলেট দিতে হবে।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *