বদলে যাচ্ছে দক্ষিণের জনপদ

বিশেষ প্রতিবেদন

পদ্মার ৯৫ শতাংশ কাজ শেষ


বিজ্ঞাপন

নিজস্ব প্রতিবেদক : বদলে যেতে শুরু করেছে দেশের দক্ষিণের জনপদ। নান্দনিক পায়রা সেতু উদ্বোধনের পর থেকেই বরিশাল থেকে ফেরিবিহীন ১১০কিলোমিটার সড়কে যাতায়াত করেছে যানবাহন। তাই অচিরেই এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নসহ দেশের অর্থনীতিতে পায়রা সেতুটি ব্যাপক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন দক্ষিণাঞ্চলবাসী।
অন্যদিকে পদ্মা সেতু প্রকল্পের সার্বিক কাজ গত রোববার পর্যন্ত এগিয়েছে ৮৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। আর মূল সেতুর কাজের অগ্রগতি ৯৫ শতাংশ। সেই হিসাবে মূল সেতুর মাত্র ৫ শতাংশ কাজ বাকি রয়েছে। মূল সেতুর কাজের চুক্তিমূল্য প্রায় ১২ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা। যার মধ্যে চলতি বছরের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে প্রায় ১১ হাজার ৪০৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। সোমবার সন্ধ্যায় পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী (মূল সেতু) দেওয়ান মো. আবদুল কাদের এ তথ্য জানান।
সেতুর প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে জানা যায়, পদ্মা সেতু প্রকল্পের সর্বমোট বাজেট ৩০ হাজার ১৯১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। যার মধ্যে গত অক্টোবর মাস পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ২৬ হাজার ২৪৮ কোটি ৩৩ লাখ টাকা বা মোট ব্যয়ের ৮৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। আর মূল সেতুর কাজের চুক্তিমূল্য ১২ হাজার ৪৯৩ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। যার মধ্যে এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ১১ হাজার ৪০৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। সেতু প্রকল্পের আওতায় নদী শাসনের অগ্রগতি হয়েছে ৮৬ শতাংশ। নদী শাসন কাজের চুক্তিমূল্য ৮ হাজার ৯৭২ কোটি ৩৮ লাখ টাকার মধ্যে ব্যয় হয়েছে ৭ হাজার ৩১ কোটি ৭১ লাখ টাকা।
প্রকৌশল বিভাগ আরও জানায়, মূল সেতুর মধ্যে দুই হাজার ৯১৭টি রোডওয়ে স্লাব ও পাঁচ হাজার ৮৩৪টি শেয়ার পকেটের সবগুলো বসানো হয়েছে। ১২ হাজার ৩৯০টি প্যারপেট ওয়ালের মধ্যে ১০ হাজার ৩৭৭টি স্থাপন সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া মাওয়া ও জাজিরার ভায়াডাক্টে ৪৩৮টি সুপারটি গার্ডারের মধ্যে ৪৩৮টি ও ৮৪টি রেলওয়ে আই গার্ডারের সব স্থাপন করা হয়েছে। মূল সেতুর মোট ৪১টি ট্রাস রয়েছে, যার সবগুলো এরই মধ্যে স্থাপন করা হয়েছে। যার দৈর্ঘ্য ছয় হাজার ১৫০ মিটার বা ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার।
এদিকে, সেতুর সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এরিয়ার কাজ শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে। এতে ব্যয় হয়েছে এক হাজার ৪৯৯ কোটি ৫১ লাখ টাকা। এছাড়া ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পরিবেশ খাতে বরাদ্দ চার হাজার ৩৪২ কোটি ২৬ লাখ টাকা। অন্যান্য (পরামর্শক, সেনা নিরাপত্তা, ভ্যাট ও আয়কর, যানবাহন, বেতনভাতা ও অন্যান্য) খাতে বরাদ্দ দুই হাজার ৮৮৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকা।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সাথে সারাদেশের সরাসরি সড়ক যোগাযোগের নেটওয়ার্ক তৈরিতে বাধা ছিল পদ্মা, পায়রা আর কচা নদীর ওপর বেকুটিয়া পয়েন্টে অষ্টম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু। পায়রায় এখন যান চলাচল করছে, পদ্মা ব্রিজের কাজও দ্রুত গতিতে শেষ হচ্ছে আর কচা নদীর ওপর বেকুটিয়া পয়েন্টে অষ্টম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুর কাজ প্রায় ৭০ভাগ শেষ। আগামী বছরের জুন-জুলাইতে এই সেতুটি দিয়ে যান চলাচল সম্ভব বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।
সূত্র জানায়, নদীবেষ্টিত বিভাগ বরিশাল। তাই সারাদেশের সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগের ব্যবস্থা ছিল না এ বিভাগের। এমনকি নদী ও খালের কারণে বিভাগের ৬ জেলা ও ৪২টি উপজেলার সঙ্গেও সরাসরি সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। ১৯৯০ সালে সর্বপ্রথম বরিশাল-ঝালকাঠিতে কালিজিরা সেতু নির্মাণ করার ফলে এই দুই জেলার মধ্যে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার সূচনা হয়।
২০০২ সালে বরিশাল-পিরোজপুর সড়কের ঝালকাঠিতে ‘বাংলার সুয়েজখাল’ খ্যাত কৃত্রিম নৌপথ গাবখান চ্যানেলের ওপর ‘পঞ্চম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু’ নির্মাণ করা হলে ঝালকাঠির রাজাপুর ও কাঁঠালিয়া উপজেলা, পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া ও মঠবাড়ীয়া এবং বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার সাথে বরিশালের সরাসরি সড়ক যোগাযোগের সূচনা হয়। ওই রুটের কচা নদীর ওপর বেকুটিয়া পয়েন্টে অষ্টম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী নির্মাণাধীন সেতুটি আগামী বছরের জুন-জুলাইতে চালু হলে পিরোজপুর জেলা শহর ও খুলনা বিভাগের সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগের শক্তিশালী মাধ্যম হবে। তবে ২০১৭ সালে বরিশালের উজিরপুর উপজেলার হারতা বাজারের কাছে কচা নদীর উপর সেতু নির্মাণের ফলে বিকল্প পথে বরিশাল থেকে খুলনা বিভাগে সরাসরি সড়ক যোগাযোগের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বরিশালের সঙ্গে মাদারীপুর, ফরিদপুর, রাজবাড়ী ছাড়াও দেশের উত্তরাঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার শুরু হয় ২০০৩ সালের ৮ এপ্রিল। ওই দিন বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের বাবুগঞ্জে সুগন্ধা নদীর ওপর বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর (দোয়ারিকা) সেতু ও সন্ধ্যা নদীর ওপর মেজর এম এ জলিল (শিকারপুর) সেতু উদ্বোধন করা হয়।
২০০০ সালে পটুয়াখালী শহরের কাছেই লাউকাঠী নদীর ওপর বরিশাল-পটুয়াখালী সড়কে এ সেতুটি নির্মাণের মধ্য দিয়ে ওই রুটে আরও ৫টি সেতু নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এসময় বরিশাল থেকে পর্যটনকেন্দ্র সাগরকন্যা কুয়াকাটা রুটে চলাচল করতে ৬টি ফেরি পার হতে হতো। ২০১১ সালে কীর্তনখোলা নদীর ওপর শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত সেতু, ২০১৬ সালে পটুয়াখালী-কুয়াকাটা সড়কে কলাপাড়া-নীলগঞ্জ পয়েন্টে আন্ধারমানিক নদের ওপর শেখ কামাল, হাজীপুর-পুরান মহিপুর পয়েন্টে সোনাতলা নদীর ওপর শেখ জামাল ও মহিপুর-আলীপুর পয়েন্টে শিববাড়িয়া নদীর ওপর নির্মিত শেখ রাসেল সেতু নির্মাণ করা হয়।
সর্বশেষ গত ২৪ অক্টোবর ২০২১ ওই রুটে পায়রা সেতুর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে এই রুটে ফেরি যুগের অবসান ঘটে। তাইতো পায়রা সেতুটিই দক্ষিণাঞ্চলের ভাগ্য নির্ধারণের অন্যতম সহায়ক হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে যাচ্ছে।
বর্তমানে উন্নয়নের মহাযজ্ঞ চলছে একসময়ের অবহেলিত জনপদ দক্ষিণাঞ্চলে। এর অন্যতম বাধা ছিল পায়রা নদী। ওই নদীতে নান্দনিক সেতুটি চালু হওয়ায় আগামী কয়েক বছরেই বরিশাল দেশের অন্যতম শিল্প-বাণিজ্যের কেন্দ্রে পরিণত হবে বলে আশা এখানকার ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতিকদের। তাদের মতে, এখনকার জমিজমার দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। পায়রা বন্দর ঘিরে ওই এলাকায় অর্থনৈতিক কার্যক্রম বেড়েছে। পাল্টে যাচ্ছে এ অঞ্চলের চেহারা। সেতুটি চালুর ফলে কুয়াকাটার পর্যটন কেন্দ্রের উন্নয়ন, পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, শেখ হাসিনা সেনানিবাস স্থাপন, বিমানবাহিনীর রাডার স্টেশন, প্রকৌশল কলেজ, তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র ও পায়রা বন্দরের কার্যক্রম আরও বেগবান হবে বলে জানিয়েছেন এ অঞ্চলের মানুষ।
এদিকে, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ বরিশাল জেলা শাখার পক্ষ থেকে পায়রা সেতুর নাম ‘শহীদ আলাউদ্দিন স্মৃতি পায়রা সেতু’ করার দাবি জানিয়ে আসছে। সংগঠনটির সদস্য সচিব ডা. মনীষা চক্রবর্তী বলেন, ‘লেবুখালি সেতুর নামকরণ পায়রা সেতুর নামে ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের প্রাণের দাবি ছিল এই সেতুর নাম শহীদ আলাউদ্দিনের নামে নামকরণ করা।’
কলাপাড়া উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি মো. হুমায়ুন কবির বলেন, ‘বহুল আকাঙ্ক্ষিত পায়রা বন্দর পুরোদমে চালু হওয়া নির্ভর ছিল পায়রা সেতুর ওপর। সেতুটি চালু হওয়ায় এই অঞ্চলে দ্রুত শিল্পের প্রসার ঘটবে। আগের তুলনায় সময় কম লাগায় কমে আসবে খরচও। কমবে ঢাকামুখী পণ্যের মূল্য।
শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত বরিশাল প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক কাজী মিরাজ মাহমুদ বলেন, ‘পায়রা সেতু চালু হওয়ার ফলে নতুন করে জমে উঠবে এ এলাকার পর্যটনশিল্প। ব্যস্ততা বাড়বে পায়রা বন্দরের। সহজ হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থা।
বরিশাল পটুয়াখালী মিনি বাস মালিক সমিতির সভাপতি কাওছার হোসেন শিপন বলেন, ‘পায়রা সেতু চালু হওয়ায় এই রুটে বাস চলাচলে এখন আর সময় নষ্ট হচ্ছে না। তাই এই রুটে বাস চলাচল আরও বৃদ্ধি করা হচ্ছে।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসারর্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বাহাউদ্দিন গোলাপ বলেন, ‘পায়রা সেতু চালু হয়ে গেছে; পদ্মা সেতুর কাজও দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। এর সাথে বেকুটিয়া সেতুটি চালু হলে এ অঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাবে।
বরিশালের সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদের সাবেক সভাপতি অ্যাড. এস এম ইকবাল বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর পৈতৃক নিবাস পদ্মার পশ্চিম পাড়ে। বরিশালের প্রতি তার বেশ আবেগ। একযুগ আগেও অবহেলিত দক্ষিণাঞ্চলে তিনি ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন।
বরিশাল চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের সভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, ‘অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে দক্ষিণাঞ্চল পিছিয়ে থাকার জন্য অবকাঠামোগত দুর্বলতাই প্রধানত দায়ী। এই অঞ্চলে ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগের অন্যতম সমস্যা হলো ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগের সময় ও দূরত্ব। পায়রা চালু হয়েছে। পদ্মা ও বেকুটিয়া সেতু চালু হবে অচিরেই। আগামী বছর ওই দুটি সেতু চালু হলে এ অঞ্চলের উন্নয়নে আর কোনো বাঁধা থাকবে না।
বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. তালুকদার মো. ইউনুস বলেন, ‘বরিশালে স্বপ্নের পায়রা সেতু নির্মাণ হওয়ায় বরিশাল বিভাগের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও জীবন-জীবিকা বদলে যাবে।
কলাপাড়া পৌর মেয়র বিপুল চন্দ্র হালদার বলেন, ‘সমুদ্র শহর কুয়াকাটার সঙ্গে রাজধানীসহ সারাদেশের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগের নতুন দুয়ার খুললো পায়রা সেতু।
পর্যটন করপোরেশনের কুয়াকাটার ব্যবস্থাপক সুভাষ চন্দ্র নন্দি জানান, পদ্মা ও পায়রা সেতুকে সামনে রেখেই পায়রা সমুদ্র বন্দর, গঙ্গামতী, কাউয়ারচর, কুয়াকাটাসহ বিভিন্ন পর্যটন এলাকায় গড়ে উঠছে আধুনিক মানের হোটেল-মোটেল, শিল্পায়নসহ নানা স্থাপনা। পায়রা সেতু চালু হয়েছে। এখন পদ্মা ও বেকুটিয়া সেতু চালু হলে দেশ-বিদেশের পর্যটকরা দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বিঘ্নে এখানকার পর্যটন এলাকাগুলো ঘুরে যেতে পারবেন।
পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামাল হোসেন বলেন, পায়রা সেতু উন্মুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগে আরেক ধাপ এগোবে দক্ষিণাঞ্চল।’
বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ অঞ্চলে ১০টি সেতু নির্মাণ করে ফেরি যুগের অবসান ঘটিয়েছেন। সবশেষ পায়রা সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করেছেন। আগামীতে বরিশালের সঙ্গে ভোলার যোগাযোগে সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা আছে প্রধানমন্ত্রীর। ভোলা-বরিশাল সেতু নির্মাণ হলে সহজেই দুই এলাকার গ্যাস সরবরাহ সহজ হবে।’
বরিশালের বিভাগীয় কমিশনার মো. সাইফুল হাসান বাদল বলেন, ‘দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের স্বপ্নের পায়রা সেতু অত্যন্ত নান্দনিক নকশায় নির্মাণ করা হয়েছে। এটি নির্মাণের মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থার যুগান্তকারী উন্নতি সাধিত হয়েছে।


বিজ্ঞাপন