জাতীয় তথ্য বেহাতের ঝুঁকি রেখেই বিবিএসের টেন্ডার

বিশেষ প্রতিবেদন

কোনো অবস্থাতেই রাষ্ট্রীয় তথ্য ঝুঁকিতে ফেলার উদ্যোগ সরকার নিতে দিতে পারে না। এ বিষয়ে নিজের কঠোর অবস্থান তুলে ধরার কথা জানান তিনি। বলেন, এ বিষয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে।
মোস্তাফা জব্বার
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী

 

নিজস্ব প্রতিবেদক : বিতর্ক পিছু ছাড়ছেই না জনশুমারি ও গৃহগণনা প্রকল্পের। প্রকল্পের কেনাকাটায় একের পর এক অনিয়মের অভিযোগ উঠছে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। এবার জাতীয় তথ্য-উপাত্তের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে অনুমোদনহীন কারিগরি নির্দেশনার মাধ্যমে টেন্ডার আহ্বানের অভিযোগ উঠল জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২১ প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে।
শুমারিতে গণনা কার্যক্রম ডিজিটালি বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে জনশুমারি ও গৃহগণনা প্রকল্পের আওতায় প্রায় চার লাখ ট্যাব কিনতে দরপত্র (টেন্ডার) আহ্বান করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। কিন্তু দরপত্রে ত্রুটি থাকায় পুনঃদরপত্রের (রি-টেন্ডার) আহ্বান করা হয়। সেই দরপত্রেও জটিলতা দেখা দিয়েছে। দেওয়া হয়েছে কঠিন কিছু শর্ত।
দরপত্রদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো মনে করছে, নির্দিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেই ট্যাব কিনতে অযৌক্তিক ও অনুমোদনহীন শর্ত আরোপ করেছে বিবিএস।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২১ প্রকল্পের আওতায় ডিজিটাল জনশুমারির জন্য তিন লাখ ৯৫ হাজার ট্যাব কিনতে দরপত্র আহ্বান করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। গত ২৩ জুন আহ্বান করা ওই দরপত্রে ‘ত্রুটি’ থাকায় সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি পুনরায় দরপত্র আহ্বান করতে বিবিএসকে নির্দেশনা দেয়। নির্দেশনা অনুযায়ী ফের দরপত্র আহ্বান করে বিবিএস।
কিন্তু সেখানে আরোপ করা হয় কঠিন কিছু শর্ত। ট্যাব ক্রয় করার প্রক্রিয়ায় ডিপিপিতে বলা হয়ে মোবাইল ডিভাইস ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার- এমডিএম অবশ্যই বিবিএস সার্ভারে স্থাপিত থাকতে হবে। এ ব্যাপারে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলমের আপত্তিকেও আমলে নেয়নি বিবিএস। আপত্তি জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী চিঠি দিলেও তার জবাব দেয়নি সংস্থাটি।
আরডিপিপির প্রযুক্তি পণ্যের বিশেষায়িত ১৩৩ নম্বর পৃষ্ঠা থেকে দেখা যায় ডিপিপিতে সংশোধনী না এনে আহ্বান করা পুনঃদরপত্রে বলা হয়েছে ‘ক্লাউড কন্ট্রোলিংয়ের মাধ্যমে গ্রহণ করা যাবে এমডিএম সফটওয়্যার’ বিশ্লেষকরা মনে করেন, এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণে সরকারি খাতে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ও সংশোধন পদ্ধতি সংক্রান্ত পরিপত্রের ব্যত্যয় ঘটেছে।
এমনকি পুনঃদরপত্রের কারিগরি নির্দেশনা সংক্রান্ত পৃষ্ঠাগুলোতে কোনো কর্মকর্তার স্বাক্ষর নেই এবং পরিবর্তন করা হয়েছে অনুবাদ অংশেও। কিন্তু, কোনো এক অজানা কারণে জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টিকে উপেক্ষা করে অনুমোদন ছাড়াই ডিপিপি পরিবর্তন না করেই বিশেষ কারিগরি নির্দেশনায় ক্লাউড কন্ট্রোলিং সুবিধা অন্তর্ভুক্ত করে বিবিএস। আর এই উদ্যোগ কোনো এক বিশেষ মহলকে সুবিধা প্রদান করার জন্য করা হয়ে থাকতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন প্রযুক্তিবিদরা।
যদিও, জাতীয় তথ্য ভান্ডারের নিরাপত্তা নিশ্চিতে বর্তমান সরকার কালিয়াকৈর হাইটেক পার্কে নির্মাণ করেছে চার টায়ার ডাটা সেন্টার। ইতোমধ্যে যেখানে সরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে।
এরপরও শুমারির মতো গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় তথ্য-উপাত্ত ক্লাউড কন্ট্রোলিংয়ের মাধ্যমে ভিন্ন আরেক প্রতিষ্ঠানের হাতের নাগালে রাখাটা কতটুকু যৌক্তিক বা নিরাপদ এ ব্যাপারে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার জানান, কোনো অবস্থাতেই রাষ্ট্রীয় তথ্য ঝুঁকিতে ফেলার উদ্যোগ সরকার নিতে দিতে পারে না। এ বিষয়ে নিজের কঠোর অবস্থান তুলে ধরার কথা জানান তিনি। বলেন, এ বিষয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে।
আর আরডিপিপি বর্হিভূত অনুমোদনহীন কারিগরি বির্নিদেশের মাধ্যমে আহবান করা টেন্ডার এর বৈধতা কতটুকু এ বিষয়ে সিপিটিইউ- এর মহাপরিচালক এর জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি খতিয়ে দেখে সত্যতা পেলে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন।
কিন্তু, এতোসব অনিয়ম সম্পর্কে জানতে সময় সংবাদ দফায় দফায় যোগাযোগের চেষ্টা করে বিবিএস সচিব ড. শাহনাজ আরেফিন আর প্রকল্প পরিচালক কবির উদ্দিন আহমদের সঙ্গে। কিন্তু দিনভর মিটিংয়ের দোহাই দিয়ে বারবারই গণমাধ্যমকে এড়িয়ে যান দুই কর্মকর্তাই।
এদিকে, বিবিএসের ট্যাব কেনার যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন সংস্থাটির সাবেক কর্মকর্তারা। আর বর্তমান কর্মকর্তারা তো এই প্রকল্পের কেনাকাটায় হরিলুট চলছে এমন অভিযোগ তুলে চিঠিই পাঠিয়েছেন অর্থমন্ত্রীর দপ্তরে।
তারা বলেন, যে জিনিস (ট্যাব) ব্যবহার হবে, এটা আসলে ব্যবহারযোগ্য কি না? যেহেতু জনশুমারি কাজটা জাতীয় পর্যায়ে করা হবে, সেহেতু সরাসরি ব্যবহারে এটার পরীক্ষা-নিরীক্ষার কোনো সুযোগ নেই। বিশাল পর্যায়ে কাজটি করতে হলে আগে পাইলটিং করতে হয়। এর আগে বিবিএসের এনএসডি প্রকল্পের আওতায় রংপুর ও নীলফামারীতে ট্যাবের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহের পরীক্ষা করা হয়েছিল। কিন্তু সেই প্রকল্পে ট্যাব ব্যর্থ হয়। যেটা ব্যর্থ হয়েছিল সেটার ব্যবহার আবার কেন, এমন প্রশ্নও রাখেন তারা।
২০১৯ সালের ২৯ অক্টোবর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি- একনেক সভায় অনুমোদন দেওয়া হয় জনশুমারি ও গৃহগণনা প্রকল্পের। মূল অনুমোদিত প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল এক হাজার ৭৬২ কোটি টাকা।
এবারই প্রথম মূল শুমারির কাজটি ট্যাবের মাধ্যমে করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএস।
এর আগে, ট্যাবে শুমারির কাজ করতে মূল ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) আন্তঃসমন্বয় করে বিবিএস। ফলে শুমারির কাজ ম্যানুয়ালি এবং দুটি জেলায় ট্যাবের মাধ্যমে পাইলটিং বেসিস করার কথা। কিন্তু প্রকল্প কর্তৃপক্ষ পরিবর্তন হওয়ায় ম্যানুয়ালি পদ্ধতি বাদ দিয়ে সম্পূর্ণভাবে ডিজিটালি করার উদ্যোগ নেয় বিবিএস।
ঠিক এই অবস্থায় এতোসব অনিয়মের সুরাহা না করেই বুধবার সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রীসভা কমিটির পরবর্তী সভায় এই কেনাকাটার প্রস্তাবটি আবারও উপস্থাপন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো- বিবিএস।


বিজ্ঞাপন