টিকায় অনাগ্রহ?

বিশেষ প্রতিবেদন

দেশে মাত্র ২৪ শতাংশ মানুষকে টিকার পূর্ণ দুই ডোজ দেওয়া হয়েছে। ‘এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়’ বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘টিকার সরবরাহ রয়েছে, টিকা আমরা পাচ্ছি, কিন্তু টিকা দিতে আমরা ধীরগতি। কিন্তু টিকাতো ধরে রাখার জন্য না’।


বিজ্ঞাপন

 

নিজস্ব প্রতিবেদক : গত ১০ ডিসেম্বর রাজধানীর একটি সরকারি হাসপাতালে করোনাভাইরাসের টিকার দ্বিতীয় ডোজ নিতে যান জামিল বিন মাহবুব। সেখানে যাওয়ার পর তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, তিনি টিকা নিতে এসেছেন কিনা। তিনি ‘হ্যাঁ’ জানালে তার টিকা কার্ড দেখে নির্ধারিত বুথে যাওয়ার পরার্মশ দেওয়া হয় এবং তিনি সেখানে গিয়ে টিকা নেন।
জামিল বিন মাহবুব টিকা নেওয়ার পরে বিস্ময় প্রকাশ করে এই প্রতিবেদকের কাছে জানান, সর্বোচ্চ তিন মিনিটের মতো সময় লেগেছে তার টিকা নিতে। তিনি যে টেবিলে টিকা নিয়েছেন সেখানে দুই পাশে দু’জনের বসার ব্যবস্থা রয়েছে, দুটি চেয়ারই ফাঁকা ছিল। এমনকি নির্ধারিত বুথেও কোনও ভিড় ছিল না।
তার কথায়, ‘আসলে টিকা কেন্দ্রেই কোনও ভিড় নেই, কিন্তু দেশের মাত্র নাকি ২৪ শতাংশ মানুষকে এখন পর্যন্ত টিকার পূর্ণাঙ্গ ডোজ দেওয়া হয়েছে। সরকারের হাতে পর্যাপ্ত টিকাও রয়েছে বলে গণমাধ্যমে সংবাদ আসছে। তাহলে টিকা নেওয়ার মানুষ কোথায়?’
জামিল বিন মাহবুবের কথা মিলে যায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের বক্তব্যের সঙ্গেও। খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী একাধিকবার এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তিনি নিজে অনেকবারই গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে দেশের সাধারণ মানুষের প্রতি করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
গত ৩০ নভেম্বর ওমিক্রন বিষয়ে আন্তমন্ত্রণালয়ের বৈঠকের পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, দেশে ‘নো মাস্ক নো সার্ভিসের’ পর এবার ‘নো ভ্যাকসিন নো সার্ভিস’ চালু হচ্ছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী সেদিন বলেন, জনগণকে টিকা গ্রহণে উৎসাহিত করতে প্রতিটি সরকারি দফতরে ‘নো ভ্যাকসিন, নো সার্ভিস’ ক্যাম্পেইন চালুর কথা ভাবা হচ্ছে। এটি করতে পারলে টিকার কার্যক্রম আরও বেগবান হবে।
বাংলাদেশে দুই ডোজ করে মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ অর্থাৎ ১৩ কোটি ৮২ লাখ ৪৭ হাজার ৫০৮ জনকে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে দেশে করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয় দেশে। গত ৭ ফেব্রুয়ারি টিকাদান কর্মসূচি শুরু হওয়ার পর গত ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে মোট ১০ কোটি ৮২ লাখ ৩০ হাজার ৭১৯ ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে।
এরমধ্যে প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছে ৬ কোটি ৬২ লাখ ৮৭ হাজার ৩৯৬ জনেক আর দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন ৪ কোটি ২০ লাখ ৪৩ হাজার ৩২৩ জন। অর্থাৎ টিকার প্রথম ডোজ পেয়েছেন ৩৯ দশমিক দুই আর দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন ২৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ। সেই হিসাবে দেশের ২৫ শতাংশেরও কম মানুষকে দুই ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু টিকা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৮০ ভাগ। এখনও ৫৫ শতাংশ মানুষই টিকার দুই ডোজের বাইরে।
এর মধ্যে বিপুল সংখ্যক মানুষ টিকার আওতায় এসেছেন গণটিকা কার্যক্রমের মাধ্যমে। দেশে প্রথম গণটিকাদান কর্মসূচি পরিচালতি হয় গত ৭ আগস্ট। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এ কর্মসূচির আওতায় ছয় দিনে দেশে প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছিলেন ৫০ লাখ ৭১ হাজার মানুষ। এরপর গত ৭ সেপ্টেম্বর এ টিকাদান কর্মসূচির দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার কর্মসূচি শুরু হয়ে চলে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কেবল ঢাকায়, ঢাকার বাইরে চলে আরও তিনদিন ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। তবে নিয়মিত টিকাকেন্দ্র ও গণটিকাদান কর্মসূচির তথ্য আলাদাভাবে না আসায় এই কর্মসূচিতে ঠিক কতজন টিকা পেয়েছেন তা জানাতে পারেনি কোনও কর্তৃপক্ষ।
এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষে গত ২৮ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য অধিদফতর বিশেষ গণটিকাদান কর্মসূচি ঘোষণা করে। সেদিন দেশে ৬৭ লাখ ৫৮ হাজার ৯২২ ডোজ টিকার প্রয়োগ হয়েছে, বাংলাদেশে একদিনে করোনাভাইরাসের টিকাদানের এটাই রেকর্ড।
কিন্তু গণটিকাদান কর্মসূচি ছাড়া দেশে এখন টিকায় ধীরগতি দেখা যাচ্ছে। গত ২২ নভেম্বর স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এক অনুষ্ঠানে বলেন, টিকা নেওয়ার লোকও কমে আসছে। আমরা দেখছি টিকা কেন্দ্রগুলোতে আগের মত ভিড় নেই। এরপর গত ৩০ নভেম্বরে তিনি বলেন, দেশে শিক্ষার্থী ও বস্তিবাসীদের টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সব পর্যায়েই টিকা দেওয়া হচ্ছে। তারপরও দেখা যাচ্ছে, এখনও অনেকে টিকা নেননি এবং তাদের টিকা নেওয়ার আগ্রহও কম।
হতাশা ব্যক্ত করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের টিকায় যে পর্যায়ে আশা করেছিলাম সে পর্যায়ে যেতে পারিনি। ৭-৮ লাখ টিকা দেওয়া হয়েছে। আমরা আশা করেছিলাম আরও বেশি দেওয়া হবে। চেষ্টা করছি যাতে এটা বাড়ানো যায়। এখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবরা ছিলেন, তাদের বলেছি আপনারাও আমাদের সহযোগিতা করুন।’
দেশে দুই জনের ওমিক্রন শনাক্ত হওয়ার পর ১২ ডিসেম্বর স্বাস্থ্যমন্ত্রী পুনরায় বলেন, ‘আপনারা টিকা না নিয়ে থাকলে নিয়ে নেবেন। টিকার কোনও অভাব নাই, এখনও হাতে ৪ কোটি ডোজ টিকা আছে।’
টিকা নিতে মানুষের আগ্রহ কম কেন প্রশ্নে জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, কাঙ্ক্ষিত ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনার জন্য যে পরিকল্পনা ও উদ্যোগের দরকার ছিল, যে প্রচার প্রচারণার দরকার ছিল সেটা করা হয়নি শুরু থেকে। যেভাবে টিকা আনা উচিত ছিল, যেভাবে টিকা আনা উচিত ছিল সেখানে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। সেইসঙ্গে তারা বলছেন, এসব কারণে হয়তো দেশে ৮০ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রায় কখনোই যেতে পারবে না।
দেশে মাত্র ২৪ শতাংশ মানুষকে টিকার পূর্ণ দুই ডোজ দেওয়া হয়েছে। ‘এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়’ বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘টিকার সরবরাহ রয়েছে, টিকা আমরা পাচ্ছি, কিন্তু টিকা দিতে আমরা ধীরগতি। কিন্তু টিকাতো ধরে রাখার জন্য না’।
টিকার গতি আনা দরকার জানিয়ে তিনি বলেন, অন্তত দ্রুত কিছু মানুষকে টিকার আওতায় আনা দরকার, বিশেষ করে ষাটোর্ধ্ব মানুষ যারা রয়েছেন তাদেরকে। আর এজন্য একটি স্পেশাল প্রোগ্রাম নেওয়া উচিত। সেটা ৫ থেকে ৭ দিনের হতে পারে, এসময় জনপ্রতিনিধি এবং সামাজিক সংগঠনগুলোকে যুক্ত করতে হবে। যেখানে বিশেষ করে ষাটোর্ধ্ব মানুষদের টিকা দিতে পারবো।
ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘দিনে আমাদের ৭০ থেকে ৮০ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়ার সক্ষমতা বাংলাদেশের রয়েছে, এটা প্রমাণ হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচিতে এমনকি করোনার সময়ে নেওয়া গণটিকাদান কর্মসূচিতেও। তাই এই কাজটা করে ফেলা দরকার।
‘টিকা নিতে কেন্দ্রগুলোতে মানুষ আসছে না কেন’ জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক ও টিকা বিষয়ক ন্যাশনাল ইমিউনাইজেশন টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজরি গ্রুপ নাইট্যাগ-এর সদস্য অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘প্রথম থেকেই টিকাদান কর্মসূচি নিয়ে পরিকল্পনায় ঘাটতি ছিল এবং যে পরিকল্পনায় এ টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয় সেটা ছিল অগোছালো। টিকাকেন্দ্র মানুষের দোড়গোড়ায় নিয়ে যাওয়ার জন্য বলেছিলাম দুই বছর আগে।’
যে উদ্যোগ এখন নেওয়া হচ্ছে কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে, তা আগে নেওয়া হলে ‘এমন সমস্যা তৈরি হতো না’ বলেও তিনি মনে করেন। তার কথায়, ‘কমিউনিটি ক্লিনিকের চারিদিকে ২ হাজার খানা রয়েছে, সে অনুযায়ী যদি পরিকল্পনা করে তালিকা করা হতো সে অনুযায়ী টিকা দেওয়া হলে অনেক মানুষ টিকার আওতায় আসতেন। এবং যারা টিকা পেলনা, তাদের কাছে যদি আমরা পৌঁছাতে পারি, উদ্বুদ্ধ করতে পারি তাহলে আজ এই সমস্যা হতো না।’
সেইসঙ্গে এখন করোনার প্রকোপ কম, তাই করোনার টিকা মানুষের ‘প্রায়োরিটির তালিকায় নেই’ বলেও মন্তব্য করেন অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ। তিনি বলেন, ‘যদি মানুষকে সঠিকভাবে উদ্বুদ্ধ করতে পারা যেতো এবং তালিকাটা থাকতো; তাহলে আমরা এগিয়ে যেতে পারতাম।’
‘পরিকল্পনার ঘাটতির ফলে আমাদের আজ এ অবস্থা’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘মানুষ টিকা নিতে আসছে না। পরিকল্পনায় পরিবর্তন না আনলে আমরা হয়তো কখনোই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে পারবো না।’