নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের অন্যতম বৃহত্তম কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি দি কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লীগ অব বাংলাদেশ(কালব) বার লাইসেন্স করার ছলে চেয়ারম্যান জোনাস ঢাকী ও বোর্ডের কয়ক জন সদস্যদের বিরুদ্ধে ৭ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গেছে। টাকা আত্মসাতের ঘটনায় নিরপরাধ পরিচালকদের মধ্যে এরিয়ান কেমিকেল কেলেংকারির দৃষ্টান্ত অনুসরন করে দায়ধারা নির্ধারন হতে পারে মর্মে আতংক বিরাজ করছে। এরিয়ান কেমিকেল কোম্পানীতে বিনিয়োগের নামে আত্মসাতকৃত টাকা চেয়ারম্যান-জিএম ছাড়াও নিরপরাধ ১১জন পরিচালকের ওপর দায়ধারা নির্ধারন করে দিয়েছে সমবায় অধিদপ্তর। এবিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলা চলমান রয়েছে। যে কারনে বর্তমান বোর্ডের ৭ জন সরকারি চাকরিজীবি আতংকের মধ্যে আছেন। কেননা আত্মসাতকৃত টাকা উদ্ধার করা না গেলে ; দায়ধারা নির্ধারন হলে প্রত্যেক কে সরাসরি উত্তোলিত সোয়া পাঁচ কোটি টাকার বিপরীতে ৫২ লাখ ২ হাজার ২৭৩ টাকা দিতে হবে। ভিন্ন ভাউচারে উত্তোলিত টাকা ধরলে ও সুদ আরোপিত হলে এই দায়ধারা আরো বাড়বে। আবার টাকা আদায়ে মামলা হলে তাদের সরকারি বেনিফিট আটকা পড়ে যাবে। এমনকি চাকরিচ্যুত হতে পারেন। কক্সবাজারের কালবের সদস্য সমিতি পেকুয়া কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন সহ কালবের সদস্য সমিতিতে যার পূর্ব দৃষ্টান্ত রয়েছে। এবিষয়ে নাম প্রকাশ না করার একান্ত শর্তে একজন বোর্ড সদস্য বলেন, চেয়ারম্যান নিরীহ নিরপরাধ বোর্ড সদ্যদের ভূল বুঝিয়ে ও লোভ দেখিয়ে প্রতিবাদ করা থেকে বিরত রাখছেন। আত্মসাতকৃত টাকা থেকে বোর্ড সদস্যদের ”ভাগ” দিবেন বলে মুলা ঝুলিয়ে রেখেছেন। তাই ”কিছু” পাওয়ার আশায় লোভি ও দুর্বল চিত্তের বোর্ড সদস্যরা নিরব ভূমিকা পালন করছেন। এমতাবস্থায় আমরা দু’এক জন প্রতিবাদি সদস্য সংখ্যাগরিষ্ঠ সুবিধাবাদি সদস্যদের কাছে অসহায়। তাছাড়া, চেয়ারম্যান কর্তৃক হেনস্তা হবার ভয় তো আছেই। নানা ভাবে হয়রানির ভয়ে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সমবায় অধিদপ্তর সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অভিযোগ করতে কেউ সাহস পায়না।
১/১/২০২১ থেকে ২৪/১১/২০২১ তারিখ পর্যন্ত কালবের জেনারেল লেজার একাউন্ট স্টেটমেন্ট অনুযায়ী, ৩/২/২০২১ তারিখে পি১০০১২১০২০০৬ নং ভাউচারে ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা এবং ১৬/৩/২০২১ তারিখে পি১০০১২১০৩০৪০ নং ভাউচারে এক কোটি পচাত্তর লাখ টাকা বার লাইসেন্সের জন্যে নিয়োগকৃত কথিত ব্রোকার এন. সরকার এন্ড এসোসিয়েটস’র অনুকুলে কালবের একাউন্ট থেকে ট্রান্সফার করা হয়েছে।
এদিকে ২০ নভেম্বর কালবের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ফাহমিদা সুলতানা সিমা’র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিশেষ বোর্ড সভায় বোর্ডের একাধিক সদস্য বারের বিষয় উত্থাপন করেন। সভায় সিদ্ধান্ত হয় চেয়ারম্যান ঢাকী দেশে ফিরলে টাকা কালবের একাউন্টে ফেরত দিবে। কিন্ত টাকা কার কাছে আছে, কে বা কোন প্রক্রিয়ায় টাকা ফেরত দিবে তা নিয়ে স্পষ্ট কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। কালব ডেলিগেটদের আশংকা জোনাস ঢাকী দুর্নীতির বিচারের ভয়ে কানাডা থেকে আর দেশে নাও ফিরতে পারেন। তিনি কানাডায় বাড়ি কিনেছেন। তার পরিবার কানাডায় বসবাস করছেন। জোনাস ঢাকী কানাডার নাগরিকত্ব পাওয়ার চেষ্টা করছেন। তিনি দেশে না ফিরলে তার দুর্নীতির তথ্য কানাডার দুতাবাস কে অবগতকরনের ব্যবস্থা গ্রহন অথবা কালবের চুড়ান্ত সর্বনাশের জন্যে আবার দেশে ফিরলে তার পাসপোর্ট জব্দ করার জন্যে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহবান জানিয়েছেন কালবের সদস্যগণ।
অন্যদিকে কালবের সদ্য সাবেক সেক্রেটারী ও ডেলিগেট এমদাদ হোসেন মালেক ও দি খ্রিষ্টান কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন এর সভাপতি ও কালব ডেলিগেট পংকজ গিলবার্ট কস্তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে লিখিত আবেদন করেছেন। আবেদনকারিদ্বয় সমবায় মুল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক মদের ব্যবসার নেতিবাচক দিক তুলে ধরে; ট্রেনিং সেন্টারের পরিবেশ রক্ষার জন্যে কালবের অনুকুলে বার লাইসেন্স ইস্যু না করার জন্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী’র প্রতি অনুরোধ জানান।
তাছাড়া, ১৭ অক্টোবর কালবের ৩৪তম বার্ষিক সাধারন সভায় সকল ডেলিগেট বার স্থাপনের বিরোধিতা করেন এবং কণ্ঠভোটে বার স্থাপনের প্রস্তাব নাকচ করে দেন। এদিকে সরকারি সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানাগেছে, শর্ত পরিপালন না হওয়ায় কালবের বার লাইসেন্স পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। যে কারনে ৭কোটি টাকা উদ্ধার করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ বলে সংশ্লিষ্টগণ মনে করেন।
সূত্রমতে,সমবায় আইন ও বিধিমালা অনুযায়ী যে কোন বিনিয়োগের পূর্বে কালবের সাধারন সভা ও সমবায় অধিদপ্তরের অনুমোদন নেয়ার বিধান রয়েছে। কিন্ত চেয়ারম্যান সেক্রেটারী সমবায় অধিদপ্তরের অনুমোদন না নিয়ে মদের বারের লাইসেন্স ইস্যৃ করার জন্যে কেবল ৭ কোটি টাকা বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মদের বার স্থাপন ও এ সংক্রান্ত ব্যয় নিয়ে সর্বশেষ ২৮ নভেম্বর-২০২০ তারিখে কালবের ৩৩তম বার্ষিক সাধারণ সভায় সুষ্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট কোন আলোচনাও হয়নি। এজন্যে মদের বারের অর্থ ব্যয় সহ কোন কিছুই ডেলিগেটগণ অবগত নয়। এমনকি ৬.১.২০২১ তারিখে কালবের ষষ্ঠ বোর্ড সভায় বার লাইসেন্স নেয়ার অনুমোদন হলেও এক্ষেত্রে কি পরিমান অর্থ ব্যয় করা হবে তা নিয়ে কোন আলোচনা বা অনুমোদন হয়নি। চেয়ারম্যান জোনাস ঢাকী ও মদের কারবারের মূল উদ্যেক্তা পরিচালক নোয়েল চার্লস গমেজ ছাড়া বাকী বোর্ড সদস্যগণ ৭ কোটি টাকা ব্যয়ের বিষয়ে যথাযথ ভাবে অবগত নয়। এজিএম ও বোর্ডের সুনির্দিষ্ট অনুমোদন ছাড়া চেয়ারম্যান-সেক্রেটারী একক ভাবে ৭ কোটি ব্যয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহন বা অনুমোদন দিতে পারেনা
অন্যদিকে বারের লাইসেন্স প্রাপ্তির জন্যে ২ ফেব্রুয়ারি-২০২১ তারিখে এন সরকার এন্ড এসোসিয়েটস (কনসালট্যান্ট নিতিশ সরকার, ৫৫/এ এইচ,এম সিদ্দিক ম্যানশন, ৫ম তলা, পুরানা পল্টন, ঢাকা।) নামে একটি প্যাড সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের সাথে ৩০০ টাকার স্টাম্পে কালবের সাথে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানটি ভূয়া ঠিকানা ব্যবহার করে কালবের সাথে চুক্তি সম্পাদন করেছে। উক্ত ঠিকানায় গিয়ে এন সরকার এন্ড এসোসিয়েটস নামে কোন প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। দ্বি-পাক্ষিক সমঝোতা চুক্তির ৫ নং শর্ত অনুযায়ী মোট ব্যয় ৭ কোটি টাকার ৫০ শতাংশ অর্থ্যাৎ তিন কোটি পঞ্চাশ লাখ টাকা টাকা পরিশোধের কথা। কিন্ত বার লাইসেন্স বাবদ একাউন্ট থেকে সরাসরি বারের নামে উত্তোলন করা হয়েছে সোয়া ৫ কোটি টাকা। অন্য ভাউচারে আরো পৌনে ২ কোটি টাকা একাউন্ট থেকে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠান কে কনসালটেন্সি ফি বাবদ ১১ লাখ টাকা দেয়ার কথা সমঝোতা চুক্তিতে বলা হয়েছে। তিন মাসের মধ্যে বার লাইসেন্স করে দেয়ার কথাও সমঝোতা চুক্তিতে বলা হয়েছে। কিন্ত ১১ মাস পার হলেও লাইসেন্সের কোন খবর নাই।
প্রচুর লোকবল থাকা সত্তে¦ও নিজেরা না করে লাইসেন্স করার জন্যে ১১ লাখ টাকা ব্যয়ে তৃতীয় পার্টি কেন নিয়োগ করা হল এবং তিন মাসের স্থলে ১১ মাস অতিক্রান্ত হলেও লাইসেন্স কেন পাওয়া যায়নি, সমঝোতা চুক্তির শর্ত ভঙ্গের কারনে এন সরকার এন্ড এসোসিয়েটস এর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কিনা, সোয়া ৫ কোটি টাকার এখন পর্যন্ত ৯ মাসের সুদ বাবদ ৪৭ লাখ ২৫ হাজার টাকা(এখন সুদ আরো বৃদ্ধি পেয়েছে) কে প্রদান করবে-এই বিষয়ে কালবের ডেলিগেটগণ অন্ধকারে।
আর লাইসেন্স করা বাবদ ব্যয় দেখানো হয়েছে ৭ কোটি টাকা। প্রয়োজনে আরো টাকা ব্যয় করার কথা বোর্ডের নোটশীটে বলা হয়েছে। অথচ এ্যালকোহল নিয়ন্ত্রণ(লাইসেন্স ফিস) বিধিমালা-১৯৯১ অনুসারে বারের লাইসেন্স ফিস সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা। কালব বারের ক্যাটাগরী অনুযায়ী সরকারী লাইসেন্স ফি সবোর্চ্চ ৫০ হাজার টাকা। যেখানে সরকারের লাইসেন্স ফি ৫০ হাজার টাকা সেখানে ৭ কোটি টাকা কি কাজে ব্যয় হবে? ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে কেন বার লাইসেন্স নিতে হবে? অর্থ ব্যয়ের কোন বিল ভাউচার বা ডকুমেন্টস দিতে পারবেন কিনা? সমবায় অধিদপ্তর ও ইন্টারনাল অডিট কমিটির চলতি অডিটে সরাসরি উত্তোলিত সোয়া পাঁচ কোটি টাকা কি আনসিন মানি হিসেবে প্রদর্শিত হবে? তা এখনো স্পষ্ট নয়।
বার লাইসেন্স করার ছলে আত্মসাতকৃত টাকার দায়ধারা নির্ধারনের জন্যে ৪৯ ধারায় তদন্ত করার জন্যে সমবায় অধিদপ্তরের প্রতি আহবান জানিয়েছেন কালবের ডেলিগেটগণ।