রামপুরায় বাস চাপায় শিক্ষারথীর মৃত্যুর ঘটনা ভিন্ন খাতে নেওয়ার পেছনের রহস্য উদঘাটন করেছে র‍্যাব

অন্যান্য এইমাত্র

নিজস্ব প্রতিবেদক ঃ নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের সাম্প্রতিক আন্দোলনের মধ্যে ঢাকার রামপুরায় বাসচাপায় এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু এবং তার প্রতিক্রিয়ায় ১০/১১টি বাসে অগ্নিসংযোগের পেছনে ভিন্ন ঘটনা উদ্ঘাটনের কথা জানিয়েছে র‌্যাব।


বিজ্ঞাপন

এই পরিকল্পিত ঘটনায় সম্পৃক্ত ছিল বিএনপির অঙ্গ সংগঠন শ্রমিক দলের নেতা ও তার সহযোগীরা। যাদের পরিকল্পনা ছিল সারাদেশে সহিংসতা ছড়িয়ে দেওয়ার। শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনাকে পুঁজি করে সেদিনের ঘটনাটি ঘটানো হয়েছিল।

ঘটনার ১ মাস পর বাসে অগ্নিসংযোগে জড়িত ৪ জনকে গ্রেপ্তারের পর র‌্যাব বুধবার সংবাদ সম্মেলন করে গত ২৯ নভেম্বরের প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরে।

র‌্যাব কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, অনাবিল পরিবহনের একটি বাসে ভগ্নিপতির সঙ্গে পরিবহনকর্মীর সঙ্গে ঝগড়ার জেরে ওই বাসটি আটকাতে গিয়ে তার নিচে চাপা পড়েছিলেন মাঈনউদ্দিন নামের ওই শিক্ষার্থী। আর এরপর একটি সুযোগসন্ধানী চক্র পরিকল্পিতভাবে একের পর এক বাসে আগুন ধরায়।

ঢাকায় হাফ ভাড়ার দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে গত ২৫ নভেম্বর নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন জোরদার হলে রামপুরায় কর্মসূচি পালিত হতে থাকে।

তার মধ্যেই ২৯ নভেম্বর রাতে রামপুরায় বাসের চাপায় এসএসসি পরীক্ষার্থী মাঈনউদ্দিন নিহত হন। সেই রাতেই সড়কে অন্তত ১০টি বাস জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে স্ফুলিঙ্গ তৈরির মাধ্যমে সারাদেশে সহিংসতা ছড়িয়ে দেওয়ার ঘৃণ্য পরিকল্পনা করেছিল বিএনপি।

রামপুরা একরামুন্নেছা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া মাঈনউদ্দিন নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন বলে তার স্বজনরা জানিয়েছিলেন।

মাঈনউদ্দিনের মৃত্যু ঘটেছিল যেভাবে,

বাসের চাপায় মাঈনউদ্দিনের মৃত্যুর পর তার পরিবার ও স্থানীয়দের ধারণা ছিল, রাস্তা পার হতে গিয়ে বাসচাপায় তার মৃত্যু হয়। তখন আহত হন তার ভগ্নিপতি মো. সাদ্দাম।

সাদ্দামের ভাই মো. বাদশা ইসলাম গণমাধ্যমকে সেদিন বলেছিলেন, আমরা সেখানে (ঘটনাস্থলে) গিয়ে শুনেছি, অনাবিল পরিবহন ও রাইদা পরিবহনের দুটো বাস পাল্লাপাল্লি করে যাচ্ছিল, সেই সময় তারা (মাঈনউদ্দিনরা) রাস্তা ক্রস করছিল। তারা হাত তুলে বাস থামানোর সংকেত দিলেও দুই বাসের মধ্যে পড়ে মাঈনউদ্দিন পিষ্ট হয়।

তবে র‌্যাবের তদন্তের ঘটনার ভিন্ন চিত্র পাওয়া গেছে বলে বুধবার সংবাদ সম্মেলনে জানান বাহিনীর মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

তিনি বলেন, ওইদিন সন্ধ্যায় মাঈনউদ্দিনের ভগ্নিপতি সাদ্দাম তার এক বন্ধুকে নিয়ে গাজীপুর থেকে অনাবিল সুপার পরিবহনের একটি বাসে উঠে কন্ডাক্টরের সাথে বাগবিতণ্ডায় জড়ান।

পরে তারা অন্য একটি বাসে উঠে রামপুরায় আসেন। পথেই মাইনউদ্দিনসহ এলাকার কয়েকজনকে ফোন করে ওই বাসকর্মীদের ‘শিক্ষা দিতে’ রামপুরা টিভি ভবনের সামনে থাকতে বলেন সাদ্দাম।

রাত ১০টার দিকে সাদ্দাম ও তার বন্ধু রামপুরা এলাকায় আসেন। আর মাইনউদ্দিনসহ কয়েক তরুণ ফোন পেয়ে আগে থেকেই সেখানে জড়ো হন বলে র‌্যাব জানায়।

আল মঈন বলেন, অনাবিল সুপার পরিবহনের সেই বাসটি ওই এলাকায় আসা মাত্রই তারা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। হামলা থেকে বাঁচতে বাসচালকও গতি বাড়িয়ে দেন।

আনুমানিক ৪০০ মিটার যাওয়ার পর মাইনউদ্দিন বাসে লাফ দিয়ে ওঠার চেষ্টা করে। এ সময় হেলপার তাকে উঠতে না দিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলে ওই বাসের পেছনের চাকায় পিষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই মাঈনউদ্দিন নিহত হন।

পরিকল্পিত অগ্নিসংযোগে বিএনপির সন্ত্রাসীরা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে বাসের চাপায় মাঈনউদ্দিনের মৃত্যুর পর রামপুরায় সহস্রাধিক বিক্ষুব্ধ মানুষ জড়ো হন। সেই সুযোগে বিএনপি ও দলের অঙ্গ সংগঠনগুলো পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বাসে আগুন ধরাতে শুরু করে।
র‌্যাবের তদন্তে উঠে আসে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের মধ্যে মনির হোসেন (৫৪) ছিলেন এর হোতা। তিনি বিএনপির রাজনীতির সাথে সরাসরি জড়িত।
র‌্যাব মুখপাত্র আল মঈন বলেন, মনির হোসেন ও তার অনুসারীরা কয়েকটি বাসে ভাঙচুর চালান। আরও কয়েকটি বাসে অকটেন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেন।
মঙ্গলবার রাতে কুমিল্লা ও ঢাকার রামপুরা এলাকা থেকে মনির ছাড়াও গ্রেপ্তার করা হয় হৃদয় হাসান পারভেজ (১৯), আলাউদ্দিন সিফাত (২৫) ও নাঈম হাসান মীর (২৪) নামে ৩ জনকে।
আল মঈন বলেন, গ্রেপ্তার হওয়া আলাউদ্দিন সিফাতের মোটর গ্যারেজ থেকে আধা লিটার করে বোতলে ভরা অকটেন সবার হাতে হাতে দেওয়া হয়। সেই অকটেন ঢেলেই বাসগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। মনির ও তার চক্রের পরিকল্পনা ছিল নাশকতার এই আগুন পুরো দেশে ছড়িয়ে দেওয়া।

এর মধ্যেই একটি চক্র পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তোলার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আগের বিভিন্ন ঘটনার ছবি ও ভিডিও শেয়ার করে পোস্ট দিতে থাকে। তবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় তাদের সেই প্রচেষ্টা সফল হয়নি।
মনির ‘একটি রাজনৈতিক দলের’ ওয়ার্ড সভাপতি জানিয়ে আল মঈন বলেন, মনিরের বিরুদ্ধে এর আগে বিস্ফোরক আইনে ৭টি মামলা রয়েছে। তার চক্রে যারা আছেন, তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্য।
মনির কোন রাজনৈতিক দলে যুক্ত- প্রশ্ন করলে র‌্যাবের কর্মকর্তারা জানান, তিনি বিএনপির সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের সাথে যুক্ত।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ওই ঘটনার পর র‌্যাব ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দার (এনএসআই) কর্মকর্তারা তদন্তে নামে। নানা তথ্য, ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরার ভিডিও বিশ্লেষণ ও প্রযুক্তিগত তথ্য বিশ্লেষণ করে ১৫-২০ জনকে চিহ্নিত করেছে।

বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় এর আগে স্বপন রেজা (২৫) এবং শহীদ ব্যাপারী (২২) নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করেছিল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। স্বপন ব্যক্তিগত গাড়ির (প্রাইভেটকার) চালক এবং শহিদ সবজি ব্যবসায়ী।