জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ আতশবাজি–উচ্চ শব্দ, ৯ হাজার অভিযোগ

অন্যান্য এইমাত্র

নিজস্ব প্রতিবেদক ঃ ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে উচ্চ শব্দের কারণে অভিযোগ বেড়েছে ১৬ শতাংশ। চার মাস বয়সী উমায়েরের ঘটনাটি ঘুরছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। জন্মগতভাবেই হৃদ্‌যন্ত্রে ছিদ্র ছিল শিশুটির। বাবা ইউসুফ রায়হান গণমাধ্যম কে জানিয়েছেন, ৩১ ডিসেম্বর খ্রিষ্টীয় নববর্ষ উদ্‌যাপনে আতশবাজি ও পটকা ফোটানোর বিকট শব্দে তাঁর সন্তান কেঁপে কেঁপে উঠছিল। সারা রাত ঘুমাতে পারেনি। পরদিন ১ জানুয়ারি সকালে শ্বাসকষ্ট শুরু হলে রাজধানীর মিরপুরের ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে নিয়ে যান।


বিজ্ঞাপন

হাসপাতালে ভর্তির তিন ঘণ্টা পর তাঁর ছেলে মারা যায়। সন্তান হারানো দিয়ে নতুন বছর শুরু করা এই বাবা ছেলের এই পরিণতির জন্য পটকা,আতশবাজি, নাকি নিজের অদৃষ্টকে দায়ী করবেন, বুঝতে পারছেন না।

মৃত্যুর কারণ হিসেবে চিকিৎসকেরা ইউসুফ রায়হানকে জানিয়েছেন, উমায়ের হৃদ্‌যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছে। উমায়েরের বিষয়ে জানতে সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদক চারজন হৃদ্‌রোগ চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁরা জানিয়েছেন, উমায়ের জন্মগত হৃদ্‌যন্ত্রের ত্রুটি ‘টিএপিভিসি জটিলতা’য় আক্রান্ত ছিল।

স্বাভাবিক অবস্থায় ফুসফুসীয় শিরা ফুসফুস থেকে অক্সিজেনযুক্ত বিশুদ্ধ রক্ত হৃৎপিণ্ডের বাঁ অলিন্দে বহন করে নিয়ে যায়। টিএপিভিসি জটিলতায় রক্ত ভিন্ন দিকে প্রবাহিত হয়। দ্রুত অস্ত্রোপচার এটির একমাত্র চিকিৎসা। উমায়ের অস্ত্রোপচারের অপেক্ষমাণ সারিতে ছিল।

শিশুটির হৃদ্‌যন্ত্রে ছিদ্রও ছিল। পটকা-আতশবাজির সঙ্গে শিশুটির অসুস্থতার সরাসরি কোনো সম্পর্ক না থাকলেও যেকোনো শব্দ বা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি অসুস্থ কাউকে আরও বেশি অসুস্থ করে ফেলতে পারে।

জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরের তথ্য বলছে, গত বছর আতশবাজি, পটকা, উচ্চ স্বরে গান-বাজনা, অনুষ্ঠান ইত্যাদি নিয়ে অভিযোগ এসেছে ৯ হাজার ২৩৮টি।

২০২০ সালে অভিযোগ জানিয়েছিলেন ৭ হাজার ৯৫২ জন। অর্থাৎ ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে উচ্চ শব্দের কারণে অভিযোগ বেড়েছে ১৬ শতাংশ।

২০১৯ সালে অভিযোগ জানিয়েছিলেন ৫ হাজার ১৭ জন। ৯৯৯ জানিয়েছে, বছরজুড়ে রাতে গানবাজনাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান, নির্মাণকাজ, পটকা, আতশবাজি ইত্যাদির কারণে পরীক্ষার্থী, বয়স্ক ও অসুস্থ লোকদের সমস্যা হচ্ছে, ঘুমের ব্যাঘাত ঘটছে জানিয়ে কল আসে।

৯৯৯-এর ফোকাল পারসন (গণমাধ্যম ও জনসংযোগ) পুলিশ পরিদর্শক আনোয়ার সাত্তার গণমাধ্যম কে জানান, , রাতে উচ্চ শব্দ করার ক্ষেত্রে লোকজনের বিবেচনাবোধ থাকা উচিত। থানাগুলোকে না জানিয়েই বাড়িতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য লাউড স্পিকার ব্যবহার করা হচ্ছে।

সাধারণত রাত ১২টার শব্দ অসহনীয় হয়ে উঠলেই লোকজন অভিযোগ জানাতে ফোন করতে থাকেন। পুলিশ এসব সামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধ করতে গেলে অন্য ধরনের প্রতিক্রিয়াও হতে পারে।

৯৯৯ জানিয়েছে, ৩১ ডিসেম্বর রাত নয়টা থেকে পরদিন ভোর ছয়টা পর্যন্ত শব্দদূষণের ১১২টি অভিযোগ এসেছিল। এর মধ্যে রাজধানী থেকে ৫৪ টি অভিযোগ আসে।

ওই রাতে আতশবাজি ও ফানুস থেকে রাজধানীর ছয় জায়গায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। যাত্রাবাড়ী ও ধোলাইখাল এলাকায় ফায়ার সার্ভিসকে আগুন নেভাতে যেতে হয়েছে।

‘আনন্দ করুক সীমার মধ্যে’

রাজধানীর লালমাটিয়ার বাসিন্দা ও একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা শাহানা হুদা গণমাধ্যম কে বলেন, তাঁর ৯৭ বছর বয়সী শাশুড়ি ওই রাতে ঘুমাতে পারেননি। তাঁর মতে, আনন্দ উদ্‌যাপিত হোক, তবে সেটা অন্যের অসুবিধা না করে সীমার মধ্যে।

পুরান ঢাকার চকবাজারের উর্দু রোডে ‘রহমত মাইক সার্ভিস’ নামের লাউড স্পিকার, মাইকের কয়েক যুগের পারিবারিক ব্যবসা চালান আমানউল্লাহ শোভন।

গণমাধ্যমে তিনি জানান, শীতকালে, বিশেষ করে জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ—এই তিন মাসে মূলত মাইক ও লাউড স্পিকারের চাহিদা বেশি। গণমাধ্যমের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘শব্দের বিষয়টি আমাদের দেখার বিষয় নয়। যারা ভাড়া করে, তাদের ব্যাপার।’

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাইকিয়াট্রি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুনতাসীর মারুফ গণমাধ্যম কে বলেন, উচ্চ শব্দ, খুব বেশি আলো সাধারণভাবে বিরক্তির উদ্রেক করে, মনোযোগের ব্যাঘাত ঘটায়, চিন্তাভাবনায় বাধা সৃষ্টি করে।

আইন কী বলে?

শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ অনুসারে, আবাসিক এলাকায় দিনের বেলা (ভোর ৬টা থেকে রাত ৯টা) ৫৫ এবং রাতে (রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা) ৪৫ ডেসিবল (শব্দের তীব্রতা পরিমাপের একক) নীরব এলাকায় দিনে ৫০ ও রাতে ৪০, মিশ্র এলাকায় দিনে ৬০ ও রাতে ৫০, বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৭০ ও রাতে ৬০ এবং শিল্প এলাকায় দিনে ৭৫ ও রাতে ৭০ ডেসিবল পর্যন্ত শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করা আছে। কোনো ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হলে অনধিক এক মাসের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের যুগ্ম সম্পাদক ইকবাল হাবিব গণমাধ্যম কে বলেন, শব্দদূষণ বিপজ্জনক অবস্থায় চলে গেছে। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে আইন থাকলেও প্রয়োগে দুর্বলতা আছে। কে প্রয়োগ করবে, সেটাও স্পষ্ট নয়।