বিশেষ প্রতিবেদক : একাধিকবার তাগাদা দিয়েছেন সরকার প্রধান। কিন্তু নড়চড় নেই স্বাস্থ্য বিভাগে। সরকারি হাসপাতালে বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা চালুতে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই। যদিও বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে এই সেবা হাসপাতালটির চিত্রই পাল্টে দিয়েছে।
সরকারি হাসপাতালগুলোতে আউটডোর সকাল আটটা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত চালু থাকে। আর এই ছয় ঘণ্টায় রোগীর চাপ এত বেশি থাকে যে হিমশিম খেতে হয় চিকিৎসকদের। আবার এই সময়ের পর কেউ ডাক্তার দেখাতে গেলে তাকে যেতে হয় বেসরকারি। সেখানে আবার ফি লাগাম ছাড়া।
এই পরিস্থিতিতে ২০১১ সালে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু হয় বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা। সকাল থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত ৩০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে ডাক্তার দেখাতে হলেও বিকালে অবশ্য বেশি টাকা দিতে হয়। সেখানে সহযোগী অধ্যাপক পর্যন্ত দুইশ টাকা আর অধ্যাপককে দেখাতে তিনশ টাকা নেয়া হয়, যা বেসরকারি হাসপাতালের তুলনায় ক্ষেত্রবিশেষে চার ভাগের এক ভাগ মাত্র।
এই সেবাটি এখন তুমুল জনপ্রিয় এবং হাসপাতালের স্বাভাবিক সময়ে যে রকম ভিড় থাকে, বিকালেও একই রকমের ভিড় দেখা যায়। যদিও হাসপাতালের প্রতিটি বিভাগে এই সেবা এখনো চালু করা যায়নি। আর বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের দেখানো পথ ধরে এগিয়ে আসেনি সরকারি অন্য চিকিৎসালয়গুলো।
তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাস ছয়েক আগেই জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি চান সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা বাইরের হাসপাতালে গিয়ে রোগী দেখবেন না। তারা দরকার পড়লে সরকারি টিকিটের বাইরে নির্দিষ্ট অংক নিয়ে সরকারি হাসপাতালেই রোগী দেখবেন।
গত মার্চ মাসে একনেক বৈঠকে সরকার প্রধান এ বিষয়ে তাগাদাও দেন। তিনি বলেছিলেন, সরকারি সব হাসপাতালে ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস করার জন্য আলাদা কর্নার রাখতে।
কিন্তু স্বাস্থ্য বিভাগ এই সময়ে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগই নেয়নি। আর গত মঙ্গলবার একনেক বৈঠকে চিকিৎসকদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন শেখ হাসিনা।
প্রায় ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও কেন উদ্যোগ নেই- এমন প্রশ্নে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেন, এটি বাস্তবায়নের আগে এ ব্যপারে বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা করা প্রয়োজন। কীভাবে এর বাস্তবায়ন হবে-সেটাও বলা নেই। আবার বাংলাদেশে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের সংকট রয়েছে। তাই নির্দেশনা পেলেও এখনও কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা হয়নি।
তবে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে আট বছর ধরে কার্যকরভাবে এই সেবা চালুর পর কর্মপরিকল্পনা করতে কেন এত দেরি হবে, সে প্রশ্নের সুরাহা মেলেনি।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আসাদুল ইসলাম বলেন, সরকারি সব হাসপাতালে ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস করার জন্য আলাদা কর্নার রাখার নির্দেশনা পেয়েছি। এ ব্যপারে আমরা পরিকল্পনা করছি কীভাবে এটা বাস্তবায়ন করা হবে।
কবে হবে এটা- এমন প্রশ্নে সচিব বলেন, এখনও এর আউটলুক হয়নি। কীভাবে করব, কখন করব, কোথায় হবে এ বিষয়গুলো এখনও ঠিক হয়নি। তবে আমরা এ বিষগুলো নিয়ে কাজ করছি।
বঙ্গবন্ধু কন্যা চান, তবে আওয়ামী লীগপন্থী চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ-স্বাচিপেরও তেমন কোনো উদ্যোগ নেই এ বিষয়ে। সংগঠনটির সভাপতি এম ইকবাল আর্সনাল এ বিষয়ে বলেন, প্রধানমনন্ত্রীর ইচ্ছের ব্যাপারে আমাদের কোনো দ্বিমত নেই। এখন এটা কোন পদ্ধতিতে হবে সেটা দেখতে হবে। হাসপাতালে প্রাইভেট প্র্যাকটিসের জন্য আলাদা কর্নার করতে কেমন লোকবল প্রয়োজন, সেই জায়গা রয়েছে কি না সেটাও দেখতে হবে। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আমাদের ডাকতে পারেন। আলোচনা করে একটা পদ্ধতি বের করা যাবে।
ভারতে কয়েকটি হাসপাতালে এ সেবা চালু আছে। যে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বেশি আছে প্রথমে সেই বিভাগে পরীক্ষামূলকভাবে এই পদ্ধতি চালু হতে পারে। তবে এর জন্য সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা প্রয়োজন আছে। যে এ পদ্ধতি আছে সেখানের অভিজ্ঞতা নেয়া যায়।
চিকিৎসকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি রশিদ-ই মাহবুব বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চান দেশের মানুষ মানসম্পন্ন স্বাস্থ্য সেবা পাক। এ জন্য তিনি এ নির্দেশনা দিয়েছেন। এ বিষয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটা কর্মপরিকল্পনা করতে পারে। যে সব দেশে এ পদ্ধতি চালু আছে তাদের সহায়তা নেয়া যেতে পারে।
এখানে ভেবে দেখতে হবে এতে করে দুই ধরনের স্বাস্থ্য সেবা চালু হবে কি না। যাদের টাকা থাকবে না তারা আবার সেবা থেকে বঞ্চিত হবে কি না। কারণ যাদের টাকা থাকবে তারা যাবে প্রাইভেট চেম্বারে।
দেশের প্রথম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বৈকালিক সেবায় রোগী কিন্তু কম না। আর দুইশ বা তিনশ টাকার টিকিট নেয়ার লাইন কিন্তু স্বাভাবিক সময়ে ৩০ টাকার টিকিটের লাইনের চেয়ে কম থাকে না কোনো মতে।
এখানে সবমিলে প্রায় ৬০০ জনের মতো রোগীকে চিকিৎসা দেয়া হলেও প্রতিদিন প্রায় দেড় হাজারের মতো রোগী আসেন। প্রতি বিভাগে ১৫ থেকে ২০টা করে টিকিট দেয়া হয়। এ ছাড়া প্রতিটি বিভাগে প্রতিদিন পাঁচ জনের মতো ফলোআপে আসা রোগী দেখেন। তবে সব বিভাগে এখনও সেবাটি চালু হয়নি।
বিকাল তিনটা থেকে বেশি টাকায় বিকালের রোগী দেখা শুরু হয়। টিকিট দেয়া শুরু হয় দুপুর দুইটায়। তবে টিকিটের জন্য লাইন থাকে সকাল থেকেই। এমনকি নির্ধারিত সংখ্যক টিকিটের বিপরীতে রোগী বেশি হওয়ায় অনেককে ফিরেও যেতে হচ্ছে। তাই দাবি উঠেছে টিকিট সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি অন্যান্য হাসপাতালেও এ ধরনের সেবা চালু হোক।
বেসকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রেহমান সাবিত বলেন, মেডিসিন বিভাগের ডাক্তার দেখাতে ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই চলে এসেছি। লাইনে আগেই দাঁড়াতে হয়। না হলে টিকিট পাওয়া যায় না। দেখা যায় একটা বিভাগে ২০ জনের মতো নতুন রোগী দেখা হয়। তাই এত ভোরে লাইন ধরা।
ঢাকার বাইরেও অন্তত তিনটি উপজেলা হাসপাতালে বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা চালুর তথ্য মিলেছে। এর তিনটিই নওগাঁ জেলায়, যদিও সেই জেলাতেও এটি আর ছড়িয়ে দেওয়া যায়নি।
২০১৫ সালে ১৬ আগস্ট বলগাছী, পরের বছরের ২৬ মার্চ মান্দা এবং একই বছরের ১ অক্টোবরে পতœীতলা উপজেলা হাসপাতালে বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা চালু হয়।
তিনটি উপজেলা হাসপাতালে চালু হলেও সদর হাসপাতালে এই ধরনের উদ্যোগ কেন নেই- এমন প্রশ্নে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক রওশন আরা খানম বলেন, আমরা এ বিষয় শুনেছি। কিন্তু এখন এ ব্যপারে নির্দেশনা পাইনি। পেলে আমরা এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেব।
নওগাঁর সিভিল সার্জন মুমিনুল হক বলেন, মান্দা ও বদলগাছী হাসপাতালে বৈকালিক সেবা চালু আছে। দুপুর আড়াইটায় এ সেবা শুরু হয় চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। টিকিটের মূল্যও দিনের মতোই। ইচ্ছে আছে উপজেলার সব কয়টি হাসপাতালে এ সেবা চালু করার। কিন্তু ডাক্তার সংকটের কারণে এটা সম্ভব হচ্ছে না। আসলে স্বাভাবিক সেবা দিতেই ডাক্তার সংকট। সেখানে বৈকালিক চিকিৎসা সেবার জন্য ডাক্তার কোথায় পাব?
আওয়ামী লীগ সরকারের গত মেয়াদের শেষ দিকে সে সময়কার স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ১০ হাজার ডাক্তার নিয়োগের কথা জানিয়েছিলেন। সেই ঘোষণা অনুযায়ী এতদিনে ডাক্তার নিয়োগ হয়ে যেত। কিন্তু তা এখনো হয়নি। আর চিকিৎসক সংকটের কোনো সুরাহা হয়নি।
এর পাশাপাশি মফস্বলের হাসপাতালে চিকিৎসকদের গড় হাজিরার প্রবণতাও দূর হয়নি। প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন, হাসপাতালে না গেলে চাকরি থাকবে না। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে কর্মস্থলে না গেলেও বেতন বন্ধ হয়নি, এমন তথ্য হরহামেশাই গণমাধ্যমে আসছে। আর এ জন্য কারো চাকরি যাওয়ার তথ্যও প্রকাশ হয়নি।