বিশেষ প্রতিবেদক : দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দুর্নীতিতে জড়িতদের ধরতে আড়ি পাতছে। ইতিমধ্যে দুদকের ভা-ারে দুর্নীতিবাজ অনেক সরকারি কর্মকর্তা ও বেসরকারি ব্যক্তির তথ্য রয়েছে। যাদের নজরদারি ও মোবাইল ট্র্যাকিং করে দুর্নীতির তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। ওই তালিকায় অন্তত ৫০ জনের নাম রয়েছে, যাদের মধ্যে কয়েকজন জনপ্রতিনিধি, দু’জন ইউএনও, একজন বিতর্কিত জেলা প্রশাসক, এক ডজন সাবরেজিস্ট্রার, সচিবালয়ের কয়েকজন কর্মচারীও রয়েছে। তাছাড়া দুদকের জালে চাকরি দেয়ার নাম করে চাকরিপ্রর্থীদের ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া একাধিক চক্রও রয়েছে। দুদক সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে গোপনে মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের অনুমতি পায় দুদুক। তারপর আনুষ্ঠানিকভাবে সন্দেহভাজনদের বিষয়ে কার্যক্রম শুরু করা হয়। সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজের গতিবিধি অনুসরণ, তাদের কথোপকথন রেকর্ড, চলাফেরা ও পলাতক আসামির অবস্থান শনাক্তে দুদক এ সুবিধা ব্যবহার করছে। তাতে দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্তে বড় ধরনের সহায়তা মিলছে। দুর্নীতিতে জড়িত সরকারি কর্মকর্তারা ঘুষ লেনদেন বা দুর্নীতি সংক্রান্ত কী ধরনের আলাপচারিতা করছে তা জানতে দুদক সতর্কতার সঙ্গে এ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তাছাড়া অর্থ পাচার, ঘুষ লেনদেন, কমিশন দিয়ে টেন্ডার হাতিয়ে নেয়া, অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ সুনির্দিষ্ট দুর্নীতির অভিযোগে বেসরকারি পর্যায়ের অনেককেও নজরদারি করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, দুদক চায় সংস্থাটির কার্যক্রম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা- ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) ও ভারতের সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (সিবিআই) আদলে পরিচালনা করতে। আর ওই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দুদকের একটি উচ্চপর্যায়ের টিম একজন মহাপরিচালকের নেতৃত্বে সিবিআইয়ে প্রশিক্ষণে অংশ নিতে যাচ্ছে। এরপর আরেকটি টিমকে এফবিআইয়ের ট্রেনিংয়ে পাঠানো হবে। ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সহায়তায় দুদক পুরো কাজটি পরিচালনা করছে। সেজন্য একটি বিশেষ সফটওয়্যার ব্যবহার করা হচ্ছে, যা অন্য সংস্থার হাতেও রয়েছে। দুদকে এ কাজের দায়িত্বে রয়েছে বিশেষভাবে দক্ষ একটি টিম। দুদকের গোয়েন্দা ইউনিটের প্রধান পরিচালকের তত্ত্বাবধানে মোবাইল ট্র্যাকিংসহ গোয়েন্দা নজরদারি পরিচালিত হচ্ছে বলে জানা গেছে। তাছাড়া দুদকের আইটি ও সফটওয়্যার টিমও যৌথভাবে কাজ করছে। ওই টিমের সদস্যরা সন্দেহভাজন বা দুদকের তালিকাভুক্ত ব্যক্তির গতিবিধি অনুসরণসহ তাদের নজরদারি করছে। তাদের সবকিছু (কথা, গতিবিধি, অবস্থান ইত্যাদি) ট্র্যাকিং করে সার্ভারে ধারণ করা হচ্ছে।
সূত্র আরো জানায়, দুদকের নাম ব্যবহার করে, এমনকি দুদকের কমিশনার, মহাপরিচালক, পরিচালক ও উপপরিচালকের নাম ব্যবহার করে একাধিক চক্র বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষকে ফাঁদে ফেলছে। ওই চক্রের হাতে হয়রানির শিকার একাধিক ভুক্তভোগী দুদকের কাছে অভিযোগ দিলে ওই সূত্র ধরে চক্রটিকে শনাক্তে কাজ শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে ওই চক্রের ৭-৮ জনের নাম ও ফোন নম্বর সংগ্রহ করা হয়েছে। তাদের ধরতেও ট্র্যাকিং করা হচ্ছে। তাছাড়া দুদকের মামলার পলাতক আসামিদের মধ্যে যারা জামিনে নেই, আবার দেশেই আছেন- এমন আসামিদের ধরতেও ফোন নম্বর সংগ্রহের পর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে গ্রেফতার করা হচ্ছে। বড় বড় দুর্নীতির ঘটনায় অনুসন্ধান পর্যায়েই জড়িত সন্দেহভাজন অনেকের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলার পর দুদক আসামির দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে পুলিশের বিশেষ শাখা ও ইমিগ্রেশনে চিঠি দিয়ে থাকে। তাতে আসামির নাম, ঠিকানা, পাসপোর্ট নম্বরসহ তালিকা দেয়া হয়। কিন্তু তারপরও অনেকে দেশ থেকে চলে যায়। অনেক আসামি দেশে থাকলেও দুদক খুঁজে পায় না। তাদের (পলাতক আসামি) অবস্থান শনাক্ত করাসহ কোনো আসামি দেশ ছাড়ার পরিকল্পনা করছে কিনা, আগেভাগে তা জানতেও প্রযুক্তির সহায়তা নেয়া হচ্ছে।
এদিকে দুর্নীতিবাজদের ট্র্যাকিংয়ের বিষয়টি দুদক চেয়ারম্যানের হাতে রয়েছে। কারো কথা বলার স্বাধীনতা যেন খর্ব না হয়, কমিশন তা নিশ্চিত করতে চায়। তবে যাদের বিষয়ে দুর্নীতির অভিযোগ আছে, পর্যায়ক্রমে তাদের সবাইকে এর আওতায় আনা হবে। মূলত যাদের ট্র্যাকিং করা দরকার, দুদকের আইটি টিম তাদেরই ট্র্যাকিং করছে। এর মাধ্যমে অভিযুক্তদের দুর্নীতির প্রমাণ নিয়ে গ্রেফতার করাও সহজ হচ্ছে। পাশাপাশি দুদকের সক্ষমতা আরো বাড়াতে একটি ডিজিটাল ল্যাব স্থাপনের কাজও শুরু হয়েছে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ জানান, সতর্কতার সঙ্গে এ সংক্রান্ত কিছু কাজ করা হচ্ছে। দুদকের গোয়েন্দা টিম নানা মাধ্যম থেকে তথ্য সংগ্রহ করছে। দুদকের হটলাইন-১০৬ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলছে। অকারণে কেউ যেন হয়রানি না হন, সেদিকেও নজর রয়েছে। টিমকে সেভাবেই নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।