ভয়ঙ্কর কিশোর গ্যাং

অপরাধ আইন ও আদালত এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন সারাদেশ

*পরিবারের উদাসীনতা ও নোংরা রাজনীতি
* কিশোর গ্যাং বিস্তৃত শহর থেকে গ্রামে
* প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই দুর্নীতি-অপকর্মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা
*ছাত্র-যুব ও আওয়ামী নামধারীদের আশ্রয়-প্রচ্ছয়ে ভয়ঙ্কর রূপ

 

মহসীন আহমেদ স্বপন : পরিবারের উদাসীনতা ও নোংরা রাজনীতির কারণেই ক্রমেই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে কিশোর গ্যাং। রাজধানীতে এলাকা ভিত্তিক গড়ে উঠছে আলাদা আলাদা গ্যাং। কোনো কোনো এলাকায় একাধিক গ্রুপ গড়ে উঠেছে। এসব গ্যাং ছিনতাই, আধিপত্য বিস্তারে মারামারি, খুনখারাবি, মাদক ব্যবসা, মাদক সেবন, ইভটিজিং সবই করছে। নিজেদের অবস্থান জানান দিতে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা স্ট্যাটাস দেয়। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, ইমুতে তারা একে অপরের সঙ্গে ভাব বিনিময় করে। বিপক্ষ গ্রুপকে প্রতিহত করার জন্য প্রকাশ্য হুমকি-ধমকি দেয়া তাদের নিত্যদিনের কাজ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র জানায়, এরা কথায় কথায় মারামারিতে জড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি ভাড়াটে হিসাবেও ব্যবহার হচ্ছে। এদের বেশিরভাগই মাদকাসক্ত। কেউ কেউ আবার মাদকের ব্যবসার সাথেও জড়িত। প্রভাবশালীরা তাদের ফায়দা হাসিলের জন্য এদেরকে ব্যবহার করে থাকে।
শহর থেকে গ্রামে কিশোর গ্যাংয়ের ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে স্থানীয় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ছাত্র-যুব নেতাদের আশ্রয় প্রচ্ছয়ে। তাদের কারণে অপরাধ করেও এরা সহজে পার পেয়ে যাচ্ছে। কিশোর গ্যাংয়ের ভয়ঙ্কর রূপ নেওয়ায় সরকার প্রধান দুর্নীতি ও অপকর্মের বিরুদ্ধে কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ছাত্রলীগ দিয়ে শুরু করে যুবলীগ ও আওয়ামী নামধারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন। ছাত্রলীগ-যুবলীগ ও আওয়ামী নামধারীদের আশ্রয়-প্রচ্ছয় সারাদেশে কিশোর গ্যাংয়ের ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে।
সন্ধ্যা নামলেই রাজধানীর বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক নেমে আসে। বিকাল থেকেই ফাস্টফুডের দোকানের সামনে শত শত মোটরসাইকেল নিয়ে হাজির হয় একাধিক কিশোর গ্যাং। ফুটপাত ও অলিগলিতে তারা অবস্থান নিয়ে নানা অঙ্গভঙ্গি ও ইভটিজিংয়ে মত্ত থাকে। তাদের ভিড়ে সাধারণ পথচারিরাও চলতে পারে না। কোনো কোনো গ্রুপ গলিতে ঢুকে দলেবলে প্রকাশ্যে মাদক সেবন করে। রাত ৮টার পর তারা চিৎকার, চেঁচামেচি, ধস্তাধস্তি শুরু করে। চলে রাত ১০-১১টা পর্যন্ত। সন্ধ্যার পর থেকে ওই এলাকার রাস্তা দিয়ে মেয়েরা চলাচল করতে ভয় পায়। অবিভাবকরা জানান, কিশোর গ্যাংয়ের বেশ কয়েকটি গ্রুপ ফাস্টফুড খাওয়ার নামে প্রতিদিনই আশেপাশের দোকানের সামনে আড্ডা জমায়। কখনও কখনও দুই গ্রুপের মধ্যে মারামারিও বাঁধে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বেশ কিছুদিন ধরেই এখানে ক্রমেই কিশোর গ্যাংয়ের আড্ডা। দিন যতো যাচ্ছে গ্যাংয়ের সংখ্যা ততোই বাড়ছে। তবে বেশিরভাগ সদস্যই এলাকার বাইরে থেকে আসে। তাদেরকে স্থানীয়রা চেনে না। অচেনাদের মধ্যে স্থানীয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের ছেলেরাও আছে। এদের প্রত্যেকেরই আছে মোটরসাইকেল।
আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র মতে, রাজধানীতে কিশোর গ্যাংয়ে কয়েক হাজার কিশোর জড়িত। এদের মধ্যে অনেকেই স্কুলের গন্ডি পার হতে পারেনি। অথচ তারা ভয়ঙ্কর সব অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। র‌্যাব ও পুলিশের অভিযানে গত এক মাসে অন্তত অর্ধশতাধিক কিশোরকে আটক করে কিশোর সংশোধনাগারে পাঠানো হয়েছে।
জানা গেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় সবচেয়ে বেশি কিশোর গ্যাং উত্তরা এলাকায়। উত্তরায় কিশোর গ্যাংয়ের মধ্যে রয়েছে, পাওয়ার বয়েজ, ডিসকো বয়েজ, বিগ বস, নাইন স্টার ও নাইন এমএম বয়েজ, এনএনএস, এফএইচবি, জিইউ, ক্যাকরা, ডিএইচবি, ব্ল্যাক রোজ, রনো, কেনাইন, ফিফটিন গ্যাং, ডিসকো বয়েজ, পোটলা বাবু, সুজন ফাইটার, আলতাফ জিরো, ক্যাসল বয়েজ, ভাইপার, তুফান, থ্রি গোল গ্যাং। কিশোর গ্যাং এর উৎপাত দ্বন্দ্বে উত্তরা এলাকার বাসিন্দারা অতিষ্ঠ। বিশেষ করে বিকালে কোচিং সেন্টারগুলোতে কিশোর গ্যাং সদস্যদের উৎপাতে অবিভাবকরা তটস্ত থাকেন।
ডিএমপির উত্তর বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, আগে যে অবস্থা ছিল, এখন তার অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে পুলিশের তৎপরতার কারণে। সাইবার ক্রাইম বিভাগের অফিসাররা সাইবার পেট্রোলিংয়ের মাধ্যমে কিশোর গ্যাংদের গতিবিধি নজরদারি করে।
শুধু ওই গ্রুপই নয়, ঢাকার হাজারীবাগ ও গেন্ডারিয়ায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ‘বাংলা’ ও ‘লাভলেট’ নামে আরও গ্যাং গ্রুপ। শ্যামপুর এলাকায় আছে জাহাঙ্গীর গ্রুপ। বাইক গ্রুপ নামে এরা পরিচিত। দ্বীপ, সবুজ, রিদম, রাজু, খোকন, রিংকু এই গ্রুপের সক্রিয় সদস্য। কদমতলীর পাটেরবাগ বাগিচায় আছে রাকিব ও তুষার। এ ছাড়া আলমবাগে জুবায়ের, বাবু, কামরুল, মদিনা মসজিদের গলির সাজু, রেললাইনের আলমগীর, শ্যামপুরে ইমরান, রুমান গ্রুপ এদের গ্যাং এর নাম পেটকাটা গ্রুপ। এদের দলে আছে লিটন, খোকন, আইজি গেইটের আসলাম, তুলা বাগিচার ইমরান আলী, সাঈদ, সাজ্জাদ। এ সব গ্যাং এর বিরুদ্ধে থানায় একাধিক মামলা রয়েছে বলে পুলিশ জানায়। যাত্রাবাড়ীর মীরহাজীরবাগে আছে অন্তু গ্যাং, পাড় গেন্ডারিয়া এলাকায় সক্রিয় পালোয়ান গ্রুপ, গেন্ডারিয়া থানার নামাপাড়ার বাপ্পি স্কোয়াড, কাঠের পুলের সবুজ গ্যাং, গেন্ডারিয়ার হীরা বাহিনী, নবীন ভাই ভাই গ্রুপ, সুত্রাপুরের কালা ফয়সাল, নারিন্দার বাবু বাহিনী। এরাই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পুরান ঢাকা এলাকায়। এছাড়া তেজগাঁওয়ে মাঈনুদ্দিন গ্রুপ, মিরপুর-১১ তে বিহারি রাসেল গ্যাং, মিরপুর ১২ তে বিচ্চু বাহিনী, পিচ্চি বাবু ও সাইফুলের গ্যাং, সি ব্লকে সাব্বির গ্যাং, ডি ব্লকে বাবু রাজন গ্যাং, চ ব্লকে রিপন গ্যাং, ধ ব্লকে মোবারক গ্যাং। কাফরুলের ইব্রাহিমপুরে নয়ন গ্যাং, তুরাগে তালাচাবি গ্যাং, ধানমন্ডিতে রয়েছে, নাইন এম এম, একে ৪৭ ও ফাইভ স্টার গ্রুপ, রায়ের বাজারে স্টার বন্ড গ্রুপ ও মোল্লা রাব্বি গ্রুপ, দক্ষিণখানে শাহীন-রিপন গ্যাং, উত্তরখানের বড়বাগে নাজিম উদ্দিন গ্যাং, আটি পাড়ার শান্ত গ্যাং, মেহেদী গ্যাং, খ্রিস্টান পাড়ার সোলেমান গ্যাং, ট্র্যান্সমিটার মোড়ের রাসেল ও উজ্বল গ্যাং, হাজারীবাগে বাংলা ও গেন্ডারিয়ায় লাভলেট, বংশালে জুম্মন গ্যাং, মুগদায় চান-জাদু, ডেভিল কিং ফুল পার্টি, ভলিয়ম টু ও ভান্ডারি গ্যাং, চকবাজারে টিকটক গ্যাং, পোঁটলা সিফাত গ্যাং সক্রিয় রয়েছে।
র‌্যাব জানায়, গত ২৪ আগস্ট রায়েরবাজার ও মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে স্টার বন্ড গ্রুপের ১৭ সদস্যকে আটক করেছে র‌্যাব। পরে তাদেরকে কিশোর সংশোধনাগারে পাঠানো হয়েছে। একই দিন ঢাকার বংশালে জুম্মন গ্রুপের প্রধান জুম্মনসহ ৫ জন কিশোরকে আটক করে র‌্যাব। ২৫ আগস্ট মুগদার মান্ডা এলাকায় অভিযান চালিয়ে চান-জাদু গ্রুপ, ডেভিল কিং ফুল পার্টি, ভলিয়ম টু ও ভান্ডারি গ্রুপের ২৩ সদস্যকে আটক করা হয়। ১০ আগস্ট মিরপুর -১ নম্বর থেকে কিশোর গ্যাংয়ের ২৪ জনকে আটক করে র‌্যাব। ৭ আগস্ট রাতে কাওরান বাজার, ফার্মগেট, কলেজগেট, শিশুমেলা, শ্যামলী ও মোহাম্মদপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৪৬ জনকে আটক করে র‌্যাব-২। তাদের মধ্যে ১১ জনকে রায়েরবাজারে ছিনতাই করার সময় হাতেনাতে গ্রেফতার করা হয়। এর আগে ২৮ জুলাই মোহাম্মদপুরে অভিযান চালিয়ে লাড়া দে ও লেভেল হাই গ্রুপের ২ সদস্যকে আটক করে র‌্যাব। ১৫ জুলাই রাতে তুরাগের বাউনিয়া থেকে নিউ নাইন স্টারের ১১ সদস্যকে আটক করে র‌্যাব-১।
ভুক্তভোগিদের মতে, সম্প্রতি বরগুনায় আলোচিত নয়ন বন্ডের ‘০০৭’ গ্রুপের চেয়েও কিশোর গ্যাং সদস্যরা দুর্ধর্ষ ও ভয়ঙ্কর। স্থানীয় প্রভাবশালী বড় ভাই বা নেতা পেছন থেকে এদেরকে সহায়তা করে বলেই ভয়ে কেউ মুখ খোলার সাহস করে না। একই কারণে এসব গ্রুপের কর্মকান্ড সম্পর্কে সব জেনেও এলাকার পুলিশ নির্বিকার।
একিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল জানিয়েছেন, সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই দুর্নীতি ও অপকর্মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। শনিবার দুপুরে রাজধানীতে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠান শেষে তিনি এ কথা বলেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর অভিযান অব্যাহত থাকবে জানিয়ে অন্যায় করে কেউই পার পাবেনা বলে হুঁশিয়ার দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
তিনি বলেন, অবৈধ ব্যবসা, অনৈতিক কাজ, টেন্ডার বাজি যেটাই করুক তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। আমরা যার বিরুদ্ধে উপযুক্ত প্রমাণ পাব তার বিরুদ্ধেই আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা এটাই যে, সে যেই হোক জনপ্রতিনিধি বা প্রশাসনের লোক প্রমাণ পেলেই তার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কিশোর গ্যাং বিস্তৃত গ্রাম থেকে শহরে : শান্তির আর সৌহার্দ্যরে নগরী রাজশাহীতে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে কিশোর গ্যাং। নগর থেকে গ্রাম পর্যন্ত বিস্তার লাভ করছে এদের তৎপরতা। অসুস্থ রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতাদের আনূকুল্যে কিশোর গ্যাং কালচার দ্রুতই তার ডালপালা মেলছে। মহল্লায় মহল্লায় এরা ছোট ছোট গ্রুপ গড়ে তুলেছে। আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গ্রুপ সৃষ্টি করে জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধমূলক কাজে।
শিক্ষা নগরী রাজশাহীতে গ্যাং কালচার সামনে আসে গত আগস্টে। ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাবার জন্য সিটি কলেজের ছাত্র আশারিয়া রাব্বি (১৮) স্টেশনে যাবার সময় ভোরে হেতমখা এলাকায় তাকে কুপিয়ে খুন করা হয়। এ নিয়ে শুরু হয় তোলপাড়। পুলিশ পরে রনক (২৬) নামে এক যুবককে গ্রেফতার করে। সে নেশার টাকা যোগাড়ের জন্য রাব্বিকে খুন করেছে বলে আদালতে জবানবন্দী দিয়েছে।
ঈদের দুদিন আগে নগরীর ব্যাস্ততম এলাকায় কয়েকজন বখাটের হাতে নাজেহাল হন রুয়েটের শিক্ষক ও তার স্ত্রী। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করলে ঝড় ওঠে আলোচনা সমালোচনার। বেশ কদিন পর পুলিশ পাঁচজনকে আটক করে। এরা সবাই স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী। এ রেশ কাটতে না কাটতেই রুয়েটের এক ছাত্রী অটোরিকশায় নাজেহাল হন।
এসব কিশোর গ্যাং শুধু নগরীতে নয় তৎপর এখন উপজেলা পর্যায়েও। সম্প্রতি রাজশাহীর মোহনপুরে নবম শ্রেণির ছাত্রী বর্ষাকে প্রতিবেশী বখাটে মুকুল প্রেমের প্রস্তাব দেয়। তা ফিরিয়ে দেয়ায় তাকে অপহরণের পর ধর্ষণ করে। লজ্জায় আত্মহত্যা করে বর্ষা। বাঘা উপজেলায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা একই ডিজাইন করে মাথার চুলকেটে জানান দেয় গ্রুপের। তাদের অপতৎপরতার খবরে স্থানীয় প্রশাসন অমন চুল না কাটার জন্য সেলুন গুলোর প্রতি নির্দেশনা জারী করে। কিশোর গ্যাং এলাকায় আধিপত্য নিয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারিতে লিপ্ত হচ্ছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এনামুল হক বলেন, বহুকাল ধরে চলে আসা সমাজের রীতিনীতিতে তাদের শ্রদ্ধাবোধ নেই। অসুস্থ রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতাদের আনুকুল্যে কিশোর গ্যাং কালচার বাড়ছে। পরিবারের ছেলেরা কোথায় যাচ্ছে কাদের সাথে মিশছে এসব খোজ খবর রাখতে হবে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাহবুবা কানিজ কেয়া বলেন, বড় হয়ে ওঠার সময় কিশোরদের প্রতি বিশেষ যত্ম নেয়া হচ্ছে না। বেশীরভাগ বাবা-মা সন্তানদের কাছ থেকে সামর্থ্যরে চেয়ে বেশী প্রত্যাশা করছেন। ফলে হতাশা ও মানসিক চাপ থেকে মুক্তির জন্য মাদকাসক্তে আসক্ত হচ্ছে। মাদকের সহজলভ্যতা রোধ করতে হবে।
নোয়াখালীতে কিশোর অপরাধীরা তৎপর : নোয়াখালী জেলা শহর থেকে শুরু করে বিভিন্ন উপজেলা এমনকি ইউনিয়নেও এক শ্রেণির উঠতি তরুণ ও কিশোরের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও মাদক বিক্রিতে জড়িয়ে পড়ছে এসব কিশোররা। এর জন্য পরিবারের উদাসীনতা দায়ী হলেও অনেক অভিভাবক উশৃঙ্খল সন্তানদের ভয়ে এখন রীতিমত নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
বিশেষ করে ১৩ বছর থেকে ১৮/২০ বছর বয়সীরা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে বেশি। হাটবাজার, সুপার মার্কেট, বাস ও রেলস্টেশন, প্রতিটি পাড়া মহল্লায় এদের অবাধ বিচরণ লক্ষনীয়। এসব কিশোর অপরাধীর মুখে ‘বড় ভাই’ এর নাম শোনা যায়। বিপদ আপদে এরা বড় ভাইয়ের নাম ব্যবহার করে থাকে।
জানা গেছে, এসব বড় ভাইদের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক পরিচিতি রয়েছে। ফলে অপরাধ করেও এরা সহজে পার পেয়ে যাচ্ছে। নোয়াখালী জেলা শহরে মেহেদী হাসান শাওন ও আনোয়ার হোসেন হৃদয়ের নেতৃত্বে ১৫/২০ জনের সদস্যের ভয়ঙ্কর কিশোর মামা গ্রুপ তৎপর রয়েছে। এ গ্রুপের কাজ হচ্ছে, কেনাকাটা করতে আসা নবদম্পতি, গৃহিনীকে ইভটিজিংয়ের ফাঁদে ফেলে টাকা পয়সা, স্বর্ণালংকার, মোবাইল হাতিয়ে নেয়া এবং সুযোগ বুঝে চাঁদাবাজি করা।
গত মঙ্গলবার দুপুরে মেহেদী হাসান শাওন ও আনোয়ার হোসেন হৃদয়ের নেতৃত্বে ৬/৭ জন যুবক হাতিয়া উপজেলার ভূমিহীন বাজারে মো. জাফরকে হঠাৎ মারধর ও এক পর্যায়ে তাকে পাশের একটি হোটেলে নিয়ে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবী করে। এ সময় জাফরের চিৎকারে আশপাশের লোকজন এসে সন্ত্রাসী অপরাধী শাওন ও হৃদয়কে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে। একইদিন বিকালে আটককৃত দুইজনের নাম উল্লেখ করে ৪/৫জনের বিরুদ্ধে সুধারাম থানায় দ্রুত বিচার আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন জানান, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা দীর্ঘদিন যাবত জেলা শহরে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মহিলাদের উত্যক্ত করে আসছে। এ ছাড়া পুরো জেলা জুড়ে একটি শক্তিশালী হোন্ডা চোর চক্র সক্রিয় রয়েছে। গত দুই বছরে জেলা শহর ও আবাসিক এলাকা থেকে শতাধিক হোন্ডা চুরি হয়। কিন্তু পুলিশ একটি হোন্ডাও উদ্ধার কিংবা হোন্ডা চোর চক্রের কাউকে আটক করতে পারেনি। ফলে হাট বাজারে কেনাকাটা করতে আসা হোন্ডা চালকরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
সরজমিনে কয়েকটি উপজেলা পর্যবেক্ষন করে দেখা গেছে, মেঘনাবেষ্টিত হাতিয়া উপজেলা, সূবর্ণচর, কবিরহাট ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার গ্রামাঞ্চলে যাত্রীবাহী কয়েক হাজার হোন্ডা রয়েছে। স্থানীয় ভাষায় এগুলোকে ‘টানা হোন্ডা’ বলে। এগুলোর বৈধ কোন কাগজপত্র নেই। নোয়াখালীর প্রতিটি উপজেলায় মদ, গাঁজা, হেরোইন, ইয়াবা বিক্রি হচ্ছে। অপরদিকে পুলিশ ও র‌্যাব দীর্ঘদিন ধরে মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছে। পুলিশ ও র‌্যাবের হাতে মাদকদ্রব্যসহ আটককৃতদের অধিকাংশ কিশোর ও যুবক বয়সের। পাচারকারীরা এসব কিশোর যুবককে ব্যবহার করছে। নোয়াখালীতে গত এক বছর ৫০টি ইভটিজিংয়ের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে বিভিন্ন উপজেলা থেকে পুলিশ ২৫ জনকে আটক করেছে। লক্ষনীয় যে, আটককৃতদের সবাই কিশোর। এ অঞ্চলে কিশোর যুবক বিপদগামী হবার জন্য অভিভাবকদের দায়ী করছে অনেকে। কিশোর ও উঠতি বয়সের সন্তানের বিষয়ে অনেক পরিবারের উদাসীতার সুযোগে এরা অপরাধীচক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ৪/৫ জনের ছোট ছোট দল জেলা শহরের বিভিন্ন স্পটে অবস্থান করে থাকে।
নোয়াখালী পুলিশ সুপার মো. আলমগীর হোসেন বলেন, নোয়াখালী জেলা শহরের কিশোর গ্যাং, বাহিনী কিংবা কোন অপরাধীর স্থান নেই। যে অপরাধ করবে তাকে তাৎক্ষনিকভাবে আটক করে আইনের আওতায় আনা হবে।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *