নজরদারিতে এমপি-মন্ত্রীরাও অনেকে আত্মগোপনে

অপরাধ আইন ও আদালত এইমাত্র জাতীয়

বিশেষ প্রতিবেদক : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে সরকার ও দলের সর্বস্তরে চলছে শুদ্ধি অভিযান। ঘোষণা দিয়েছেন, অন্যায়কারী, দুর্নীতিবাজদের কোনো ছাড় দেবেন না তিনি। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছেন অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই। গত বুধবার গ্রেফতার হয়েছেন যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ ভূঁইয়া। গ্রেফতার করা হয়েছে যুবলীগের নেতা নামধারী জি কে শামীম ও কৃষক লীগের নেতা মোহাম্মদ শফিকুল আলম ফিরোজকে।
গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগের দিন এ বিষয়ে কয়েকটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট ভাষায় ক্যাসিনো, জুয়া, মাদক, টেন্ডারবাজি ও সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। অপরাধী যত বড়ো গডফাদার হোক না কেন, চলমান অভিযান অব্যাহত রাখার নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মাদক, অনিয়ম, দুর্নীতির চক্র না ভাঙা পর্যন্ত অভিযান চলবে। এ ব্যাপারে যেন কোনো আপস না হয়, আমি অনুপস্থিত থাকলেও যেন তা কনটিনিউ হয়। সোমবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এ তথ্য জানিয়ে বলেন, নিউইয়র্কের পথে রওনা হওয়ার আগে বিমানবন্দরে এমন নির্দেশনাই দিয়ে গেছেন প্রধানমন্ত্রী। অভিযান শুরুর পর ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতা গা ঢাকা দিলেও কারো কারো ওপর নজর রাখা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এখানে কারো সঙ্গে কোনো আপস বা ছাড় দেওয়ার প্রশ্ন নেই।জানা গেছে, এই তালিকায় রয়েছেন আরো অনেক ‘রাঘব বোয়াল’, যাদের শিগগিরই গ্রেফতার করা হতে পারে। নজরদারিতে রয়েছেন সাবেক মন্ত্রী-এমপি ও বর্তমান এমপিরাও। প্রায় ১ হাজার জনের তালিকা নিয়ে সারাদেশে মাঠে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, মাদক, জুয়া, টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ-অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে তালিকাভুক্ত এসব নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। সারাদেশে চলমান অভিযানে বিতর্কিত অনেক নেতাকর্মী ইতিমধ্যে আত্মগোপনে গেছেন।
প্রায় একই ধরনের বক্তব্য রেখেছেন সোমবার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও। তিনি বলেন, গডফাদার-গ্র্যান্ডফাদার বা রাঘব বোয়াল বলে আমাদের কাছে কিছু নেই। আমরা অপরাধী চিনি। অপরাধী যে-ই হোক, তাকে আমরা আইনের আওতায় নিয়ে আসব। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘জড়িত সংসদ সদস্যরাও সেই আইনের আওতায় চলে আসবেন। কাজেই রাঘব বোয়াল বলে আমাদের কাছে কিছু নেই।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তালিকার ভিত্তিতেই রাজধানীতে ক্যাসিনোতে অভিযান, ক্যাসিনো পরিচালনাকারী, দুর্নীতিবাজ-টেন্ডারবাজদের গ্রেফতারসহ অভিযান চালানো হচ্ছে। জানা গেছে, এলজিআরডি, গণপূর্ত, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের ইঞ্জিনিয়াররাও টেন্ডার-বাণিজ্যের বড়ো অঙ্কের ভাগ পান। গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণে বেশিরভাগ কাজ বাস্তবায়ন করে এলজিআরডি। রাস্তাঘাট, ব্রিজ মেরামত না করে বেশিরভাগ বিল উত্তোলন করা হয়েছে এমন অভিযোগও রয়েছে। জড়িত টেন্ডারবাজ ও ইঞ্জিনিয়ারদেরও এই তালিকায় নাম রয়েছে। এছাড়া টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজির টাকার ভাগ পান যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতারা এবং কিছু এমপি। এ কারণে উপজেলা পর্যায়ে ২০০-৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও কাজের কাজ কিছু হয় না। সবই হয় লুটপাট। এতে কিছু দিন যেতে না যেতেই বেহাল অবস্থা হয় রাস্তঘাটের। দুর্ভোগ পোহায় সাধারণ মানুষ।
দলীয় সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর বিতর্কিত নেতাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান শুরু হওয়ায় আতঙ্কে রয়েছেন ক্ষমতাসীন দল ও সহযোগী সংগঠনের অপরাধে যুক্ত নেতাকর্মীরা। সরকার ও দলের কয়েকজন নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতা জানান, টানা ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার সুবাদে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর একশ্রেণির নেতাকর্মী নানা অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়েছেন। বিশেষ করে অন্য দল থেকে যোগদানকারী হাইব্রিড নেতাকর্মীদের অনেকে মন্ত্রী-এমপিদের ছত্রছায়ায় থেকে এসব অপরাধ করে আসছেন, যা দল ও সরকারের ভাবমূর্তিকে চরমভাবে বিপন্ন করে তুলেছে। বিএনপি-জামায়াত থেকে আসা অনুপ্রবেশকারীরা পদ পেতে যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের একশ্রেণীর শীর্ষ নেতাদের বড়ো অঙ্কের টাকা ঘুষ দিয়েছেন। এই টাকা তুলতেই তারা সব অপকর্ম দলীয় পরিচয়ে করে আসছেন। কয়েকজন হাইব্রিড নেতা এ কথা স্বীকারও করেছেন। অপরাধীদের জন্য সরকারের বিস্ময়কর উন্নয়ন ও অগ্রগতির চিত্র অনেকটাই ম্লান হয়ে পড়েছে।
নীতিনির্ধারক পর্যায়ের দুই জন নেতা জানান, শীর্ষ নেতাদের দুর্নীতি-সন্ত্রাস ও মাদকের অভিযোগ আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুরোপুরি ‘জিরো টলারেন্স’ অবস্থান নেন। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের অনেক নেতার নানা অপকর্মের তথ্যও প্রধানমন্ত্রীর কাছে রয়েছে। এসব নেতা কোথায় কী করছেন, সে সম্পর্কে দলের বিভিন্ন সূত্র এবং একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে নিয়মিত তথ্যও পান তিনি। তাদের অনেকের আমলনামাও এক বছর ধরে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করেছেন তিনি। তাছাড়া আওয়ামী লীগের এবারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলোর অন্যতম প্রধান অঙ্গীকারই হচ্ছে মাদক, সন্ত্রাস ও দুর্নীতি রোধ করে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। আগামী ২১ ও ২২ ডিসেম্বর দলের ২১তম জাতীয় সম্মেলনের আগেই আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে গুণগত পরিবর্তন আনতে এই উদ্যোগ।
এ বছরের জানুয়ারি থেকেই এমপিদের সার্বিক কর্মকা- পর্যবেক্ষণ করেন শেখ হাসিনা। এমপিদের জন্য ১০টি বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। এগুলো হলো টেন্ডারে হস্তক্ষেপ না করা, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহার করা, উন্নয়নকাজে হস্তক্ষেপ না করা, নিয়োগ-বাণিজ্য না করা, থানা-পুলিশে জামিন ও মামলায় তদবির থেকে বিরত থাকা, অন্য দল থেকে লোক না ভেড়ানো, গ্রুপ তৈরি না করা, দলীয় কোন্দল নিরসন করা, স্থানীয় প্রশাসনে রদবদলে ভূমিকা না রাখা, ক্ষমতা ও প্রভাব খাটিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য না করা এবং মাদকসহ অবৈধ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখা। এই নির্দেশনা অমান্যকারী এমপিরা এখন নজরদারিতে রয়েছেন।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *