নড়াইলে জেলা ছাত্রলীগ সভাপতির বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই

অপরাধ এইমাত্র জীবন-যাপন রাজনীতি সারাদেশ

নড়াইল প্রতিনিধি : আওয়ামী লীগের দুর্গ হিসেবে পরিচিত নড়াইলে জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি আশরাফুজ্জামান মুকুলের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। জেলা ছাত্রলীগের বর্তমান এবং সাবেক নেতাদের অনেকে অভিযোগ করেন, গত কয়েক বছর ধরে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, নেতাকর্মীদের পদ দেয়ার নামে টাকা নেয়া, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, টাকার বিনিময়ে সংখ্যালঘুদের জমি দখল, মেলার নামে জুয়ার আসর বসানো এমনকি একাধিক খুনের ঘটনায়ও জড়িত মুকুল।
তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আশরাফুজ্জামান মুকুল। তার দাবি, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকেই এসব অভিযোগ তুলছে তার প্রতিপক্ষ। কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হলে পদত্যাগ করবেন বলেও চ্যালেঞ্জ জানান মুকুল।
কোনো সম্মেলন কিংবা সংবাদ বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই গেল বছরের ২৮ এপ্রিল নড়াইল জেলা ছাত্রলীগের কমিটি দেয়া হয়। আশরাফুজ্জামান মুকুলকে সভাপতি ও নিলয় রায় বাঁধনকে সাধারণ সম্মাদক করে দেয়া ওই কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে প্রায় ছয় মাস আগে। জেলার পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে পারেননি তারা। এছাড়া জেলার মোট ১০টি ইউনিটের মধ্যে এখন পর্যন্ত ৪টিতে কমিটি দেয়া হয়েছে। বাকিগুলোতে এখনো মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি রয়ে গেছে।
কমিটি ঘোষণার পর গেল বছরের ৩ মে নড়াইল জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মুকুল নিজেই কমিটি সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তিটি ফেসবুকে পোস্ট করলেও সময় নিউজের কাছে তিনি দাবি করেন, ওই কমিটি দুই বছরের জন্য দেয়া হয়েছিল এবং তা মেয়াদোর্ত্তীর্ণ হয়নি। যদিও বিজ্ঞপ্তির প্রথম লাইনেই এ কথাটির উল্লেখ ছিল যে, কমিটির মেয়াদ এক বছর।
তিনি জানান, তারা জেলার তিনটি ইউনিটের কমিটি দিয়েছেন এবং একটি কমিটি কেন্দ্র থেকেই দেয়া হয়েছে। বাকি ইউনিটগুলোর কমিটি দেয়ার আগে প্রতিনিধি পাঠিয়ে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য সময় চেয়েছিলো শোভন-রাব্বানির কমিটি। পরে আর সেটা করা সম্ভব হয়নি।
এদিকে আশরাফুজ্জামান মুকুলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগে থানায় একাধিক মামলাও হয়েছে। নড়াইল জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মোস্তফা কামরুজ্জামান কামালকে কুপিয়ে জখম করার মামলার আসামি ছিলেন মুকুল। স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতাদের অনেকের দাবি, ওই মামলার বাদী হওয়ায় ছাত্রলীগ নেতা আমিরুল ইসলাম অপুকে দিনেদুপুরে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সেই মামলারও অন্যতম আসামি ছিলেন তিনি।
বর্তমান কমিটির আগের কমিটিতেও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মুকুল। ওই সময় তার বিরুদ্ধে আছে নারী অপহরণের অভিযোগও। জমি দখলকে কেন্দ্র করে সদর থানার আওড়িয়া এলাকার এক নারীকে অপহরণের অভিযোগে ২০১৭ সালের ২৩ আগস্ট সদর থানায় তার বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীর ছেলে জোবায়ের হোসেন মামলা করেন।
জোবায়ের বলেন, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা জহির কাজী এবং কৃষক লীগ নেতা মাহবুবের সহযোগিতায় আমার মাকে অপহরণ করে মুকুল। অপহরণের যে মামলাটি করেছিলাম, প্রভাব খাটিয়ে সেটার চার্জশিট থেকে নাম প্রত্যাহার করে নেয় সে। হুমকি ধামকি দিয়ে আদালতে আমাকে নারাজি পর্যন্ত দিতে দেয়নি।
এছাড়া পদ পাইয়ে দেয়ার কথা বলে ছাত্রলীগ নেতাদের কাছ থেকে টাকা নেয়ার অভিযোগও আছে মুকুলের বিরুদ্ধে। এ সংক্রান্ত দু’টি ফোনালাপ এবং কিছু ক্ষুদেবার্তা সময় সংবাদের হাতে এসেছে। এতে কালিয়া উপজেলা ছাত্রলীগ নেতা ইমরানের মধ্যস্থতায় নড়াগাতি থানা ছাত্রলীগের সভাপতি প্রার্থী সজীব মোল্লার কাছ থেকে মুকুলের টাকা নেয়ার বিষয়টি উঠে আসে। যদিও সজীব মোল্লা পরে কাঙ্ক্ষিত পদ পাননি।
ফোনালাপটি তাদেরই কিনা তা সময় সংবাদের পক্ষ থেকে নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে সজীব মোল্লার কাছে জানতে চাইলে তিনি ইতস্তত করেন। বলেন, আপনিও বুঝেন এটা নিয়ে জটিলতা আছে। আমি ফোনে এসব কথা বলতে পারবো না। আপনি দেখা করলে সামনাসামনি বলবো।
ফোনালাপটি তার কিনা জানতে চাইলে সজীব মোল্লা বলেন, আমি আমার ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে তারপর আপনাকে জানাবো।
মুকুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, তিনি নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক করেছেন জুবায়ের হোসেন মানিককে; যিনি বর্তমানে কলেজের ছাত্রই নন। কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মনিরুজ্জামান রোজ অভিযোগ করে বলেন, কলেজের নিউ মুসলিম ছাত্রাবাসের ১৩ নম্বর কক্ষের আবাসিক ছাত্র আমি। জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মুকুল আমার রুম দখল করিয়েছে মানিককে দিয়ে। সেখানে সে বহিরাগতদের নিয়ে মাদকের আড্ডা জমায়।
নিউ মুসলিম ছাত্রাবাসের হোস্টেল সুপার এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সায়েম আলী খান বলেন, মানিক আমার হোস্টেলের আবাসিক ছাত্র হওয়ার সুযোগই নাই। কারণ, বর্তমানে সে ভিক্টোরিয়া কলেজেরই ছাত্র নয়। হোস্টেলে বহিরাগতরা মাদক সেবন করে বলে আমাকে মাঝে মধ্যে ছাত্ররা অভিযোগ করেছে। আমি পুলিশ পাঠিয়েছি কিন্তু পুলিশ যাওয়ার আগেই তারা পালিয়ে যায়।
তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আশরাফুজ্জামান মুকুল। তিনি দাবি করেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকেই এসব অভিযোগ তোলা হচ্ছে। তার ছাত্রত্ব নেই বলে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি বিএনপি জামায়াতের হামলার শিকার হয়েছিলাম। তিন চার বছর আমার ডান হাত প্রায় অকেজো হয়ে ছিলো। তখন চার বছরের একটা গ্যাপ হয়ে যায়। পরে আমি অনার্সে নিয়মিতভাবে ভর্তি হতে না পেরে ডিগ্রির জন্য উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। এর প্রমাণও আমি দিতে পারবো।
মামলাগুলোর বিষয়ে মুকুল বলেন, রাজনীতির ক্ষেত্রে মামলাগুলোর বিষয়ে তো আপনারা জানেনই। আমাকে মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছিলো। আর নারী অপহরণের যে মামলাটির কথা বলা হচ্ছে সেখানে আসলে অপহরণের কোনো ঘটনাই ঘটেনি। এমনকি মামলায়ও শুরুতে আমার নাম ছিলো না। পুলিশের নিয়োগবাণিজ্য নিয়ে আমি প্রতিবাদ করায় তখনকার এসপি আমার ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। পরে তিনিই ষড়যন্ত্র করে আমার নাম ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। আমি অধিকতর তদন্তের আবেদন করলে তদন্ত সাপেক্ষে পরে চার্জশিট থেকে আমার নাম বাদ দেয়া হয়। আমাকে আসামি করার প্রতিবাদে নড়াইলে অনেক আন্দোলনও হয়েছে।
এদিকে নেতাকর্মীদের পদ দেয়ার কথা বলে অর্থ গ্রহণের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এই যুগে প্রযুক্তির সাহায্যে এমন কিছু বানানো কঠিন নয়। আমার প্রতিপক্ষের লোকজন একটা ফেক ফোনকল বানিয়ে আমার নামে চালিয়ে দিচ্ছে। এছাড়া কিছু মেসেজের স্ক্রিনশটও ছড়ানো হচ্ছে। আমি বলেছি, এগুলোর ফরেনসিক পরীক্ষা করে যদি প্রমাণ করতে পারেন এগুলো আমার তাহলে আমি নিজেই পদত্যাগ করবো।
সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজে হলের রুম দখল করানো অভিযোগের বিষয়ে মুকুল বলেন, কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদক জুবায়ের হোসেন অনিক কলেজেরই ছাত্র। সে ওই ছাত্রাবাসের আবাসিক ছাত্র। যে এই অভিযোগ করেছে, সে ওই রুম পুরোটা একাই দখল করে রেখেছিলো। অথচ তার পরিবার নিয়ে কলেজের পাশেই সে থাকে। তিন জনের রুমে একজন কেনো থাকবে। নতুন ছেলেরাও উঠছে। ছাত্রাবাসগুলোর কোনো রুমেই এখন তিনজনের কম ছাত্র থাকে না। আমরা উদ্যোগ নিয়েছি এবং কলেজের শিক্ষকরাই এই ব্যবস্থা করেছেন।
আশরাফুজ্জামান মুকুলকে নিয়ে অস্বস্তিতে জেলা ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের অনেকেই। কেউ কেউ ক্ষোভও প্রকাশ করেন।
নড়াইল জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এবং জেলা স্বেচ্ছাসেবক লিগের সাধারণ সম্পাদক জিএস পলাশ বলেন, সাবেক ছাত্রনেতা হিসেবে আমরা সবাই এটা নিয়ে খুবই মর্মাহত। একটা ছেলে যার কিনা ছাত্রত্ব নাই, দলীয় শৃঙ্খলা মানে না, মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত, ছাত্রলীগের বিভিন্ন পদধারী নেতা তার হাতে নিহত এবং আহত হয়েছে, সে অপহরণ মামলার আসামি, সিনিয়র নেতাদের মারধর করার আসামি; এরকম বহু অভিযোগ তার নামে আছে।
তিনি বলেন, জননেত্রী শেখ হাসিনা বর্তমান ছাত্রলীগকে যেভাবে পরিচ্ছন্ন ইমেজের মধ্যে নিয়ে আসতে চাচ্ছেন। বিতর্কিত হওয়ার কারণে কেন্দ্রীয় নেতাদের সরিয়ে দেয়া হলো। সেখানে তাকে শুরুতেই বাদ দেয়া উচিৎ ছিল। সে আগে যখন সংগঠনের সেক্রেটারি ছিলো তখনও সংগঠন বেচাকেনা করেছে এবং বর্তমান সভাপতি হওয়ার পরও একাধিক লোকের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে পদ দেয়ার লোভ দেখিয়ে। সে যেভাবে মোটরসাইকেল নিয়ে মহড়া দেয় এবং ক্যাডারদের নিয়ে চলাফেরা করে তাতে সাধারণ মানুষও অতিষ্ঠ।
জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং যুবলীগ নেতা খোকন শাহা বলেন, ‘আওয়ামী লীগের উর্বর ভূমি নড়াইল। এমন কি আকাল পড়লো যে একজন অছাত্রকে ছাত্রলীগের সভাপতি বানাতে হবে। এটা প্রচণ্ড বেদনাদায়ক।’
তবে আশরাফুজ্জামান মুকুল বলছেন, আমি যখন জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম তখন থেকে দলীয় রেষারেষির কারণে আমার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ দিয়ে আসছে অনেকে। পরে আমি যখন সভাপতি হই তখন এই অভিযোগগুলো তদন্ত করেই আমাদের কমিটি দেয়া হয়।
তিনি বলেন, গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আমাদের ছাত্রলীগের চারজন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছে। বিষয়টা সিনিয়রদের মাঝেও আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। এখন অনেকে চায় আমাকে চেপে রাখতে পারলে রাজনীতিতে তারা সুবিধা পাবে। আমাকে কোণঠাসা করার জন্য সবাই মিলে এক হয়ে যায়।
স্বাধীনতার পর ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিতর্কিত নির্বাচন ছাড়া নড়াইলের দুটি আসন আওয়ামী লীগ অথবা আওয়ামী লীগের জোটের বাইরে যায়নি। খোদ আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনাও নড়াইল থেকে নির্বাচন করেছেন। নড়াইলকে তাই বরাবরই আওয়ামী লীগের দুর্গ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর এই জেলায় ছাত্রলীগের নেতৃত্বে বিতর্কিত লোক নিয়ে অস্বস্তি আছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনগুলোতেও।
নড়াইল সদর থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতা বলেন, আমি নিজেও ছাত্রলীগ করেছি। ভবিষ্যতের নেতা উঠে আসার জন্য ছাত্রলীগকে সবচেয়ে বড় পাইপলাইন হিসেবে আমরা বিবেচনা করি। আর তাই এই সংগঠনে বিতর্কিত এবং নড়বড়ে নেতৃত্ব থাকলে তা ভবিষ্যতের জন্য অবশ্যই শুভ নয়।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুভাস চন্দ্র বোস বলেন, সাবেক সভাপতি এবং সম্পাদক বিভিন্ন জায়গায় তড়িৎ গতিতে যে কমিটি করেছে সেটা স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা না বলেই করেছেন। একটা ছেলে দক্ষ-মেধাবী, ছাত্রদের কাছে গ্রহণযোগ্য, সংগঠন এবং জনগণের কাছে তার ভাবমূর্তি, জননেত্রী শেখ হাসিনার নীতি আদর্শ এগিয়ে নেয়া, দুর্নীতি টেন্ডারবাজি পরিহার করা এবং সঠিকভাবে ছাত্র রাজনীতি করা; এগুলোই তো ছাত্র রাজনীতির মূলমন্ত্র। আমি এই ছেলেটিকে নিয়ে কিছু বলবো না। শুধু বলবো, যারা অভিযুক্ত তাদের দেখা উচিৎ।
তিনি বলেন, (জেলা ছাত্রলীগের) যখন সভাপতি-সম্পাদক করা হয়েছিলো তখন বলা হয়েছিলো এটা শুধু এক বছরের জন্য। তারপরে আর সম্মেলন হয়নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে ছাত্রলীগ সম্পর্কে তথ্য আছে। যে যতটুকু করেছে তার ফল সে নিশ্চয়ই পাবে।
দলের মধ্যে শুদ্ধি অভিযানকে স্বাগত জানিয়ে সুভাস চন্দ্র বোস বলেন, নেত্রী যে বিশুদ্ধতা চাইছেন সেটা জনগণেরও চাওয়া। আমি ১৪ বছর নড়াইল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। আমি চাই যারা দুর্নীতিবাজ, টেন্ডারবাজ, পদে থেকে অপরাধ করেছে তাদের শাস্তি হোক। অচিরেই শুদ্ধি অভিযান হোক।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *