দেশীয় ওষুধ শিল্প ধ্বংসের পায়তাঁরা

অর্থনীতি বানিজ্য স্বাস্থ্য

নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের ওষুধ নিয়ন্ত্রনে ড্রাগ এ্যাক্ট-১৯৪০, ড্রাগ রুলস্-১৯৪৫, বেঙ্গল ড্রাগ রুলস্-১৯৪৬, ড্রাগ কন্ট্রোল অর্ডিন্যান্স-১৯৮২, জাতীয় ওষুধ নীতিমালা-২০০৫ এর সঠিক মুল্যায়ন না হওয়ায় স্বাস্থ্য সেবার অবনতি ঘটছে। ওষুধ নীতিমালা-২০০৫ এর আলোকে ওষুধ নীতিমালা-২০১৬ প্রণয়ন করা হয়। প্রণীত নীতিমালায় ওষুধের নিরাপত্তা, কার্যকারিতা, যৌক্তিক ব্যবহার ও কার্যকর, ওষুধ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, উৎপাদন, বিপণন, বিতরণ, সংরক্ষণ ও আমদানী-রপ্তানীর দিক নির্দেশনা রয়েছে। ওষুধ নিয়ন্ত্রণ সংস্থাটি লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন, প্রকল্প হস্তান্তর, স্থানান্তর, রেসিপি অনুমোদন, নিবন্ধন, নমুনা পরীক্ষা, মান নিয়ন্ত্রণ, আমদানী-রপ্তানীর নিবন্ধনসহ সকল কার্যক্রম তদারকি করেন। বর্তমানে অ্যালোপ্যাথিক-২৬৬টি, ইউনানী-২৬৭টি, আয়ুর্বেদিক-২১৮টি, হোমিও প্যাথিক-৭৯টি ও হারবাল-৩২টি কোম্পানীর কারখানা রয়েছে। অ্যালোপ্যাথিক কোম্পানীর ক্ষেত্রে যে সব সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করা হয়েছে, তা ইউনানী, আয়ুর্বেদিক ও হারবাল কোম্পানীর ক্ষেত্রে করা হয়নি। ফলে ভেষজ শিল্পে একের পর এক জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। সূত্র সকালের সময়
এদিকে, হোমিও কোম্পানীগুলো ওষুধ নীতিমালা তোয়াক্কা না করে ইচ্ছে মাফিক ব্যবসা করছে। তথ্য মতে, সরকার ১৯৮২ইং সালে ওষুধ নীতিমালা ঘোষণা করে স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে ১৯৮৪ইং সালে ৪১৭০টি ঔষধের মধ্যে ১৭০৭টি ওষুধ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। নিষিদ্ধ ঘোষিত ওষুধের মধ্যে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ ছিলো ৭৮০টি। ৭৮০টি হোমিও ওষুধ নিষিদ্ধ হলেও ড্রাগ প্রশাসন অজ্ঞাত কারণে ৩৭ বছরে সেই তালিকা প্রকাশ না করে স্বার্থন্বেষী ব্যবসায়ীদের নিষিদ্ধ ঘোষিত ওষুধ বাজারজাতের অনুমতি দিয়েই যাচ্ছেন। ১৯৬৫ইং সালে তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ‘দ্য হোমিওপ্যাথিক আয়ুর্বেদী এন্ড ইউনানী অ্যাক্ট-১৯৬৫’ প্রণয়নের ধারাবাহিকতায় সরকার ১৯৮৩ইং সালে প্রণয়ন করেন ‘দ্য হোমীওপ্যাথিক প্রাকটিশনার্স অর্ডিন্যান্স-১৯৮৩’। ১৯৮২’র নীতিমালার আলোকে হোমীওপ্যাথিক চিকিৎসায় কোনো প্রকার মিশ্রণ, প্যাটেন্ট, টনিক নামের ওষুধ উৎপাদন, কাঁচামাল আমদানী ও বিক্রয় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। অথচ, নীতিমালা উপেক্ষা করে ট্রেড নামে কম্পাউন্ড ওষুধ উৎপাদন ও বিপণনে হোমিওপ্যাথিক কোম্পানীর স্বঘোষিত নীতিমালা এখনো চলমান।
দেশের স্বাস্থ্যসেবায় অ্যালোপ্যাাথিক ২৪%, হোমিওপ্যাথিক ১১%, ইউনানী ৯% ও আয়ুর্বেদিক ৮% পার্সেন্ট স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকলেও ৪৮% মানুষ এখনো স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। জাতীয় ওষুধ নীতিমালার অধ্যাদেশ ১৯৮২-এর আলোকে ওষুধ শিল্প আইন স্বীকৃতি প্রাপ্ত হওয়ার পরও ইউনানী, আয়ুর্বেদিক ও হারবাল শিল্পের উন্নয়ন ও বিকাশে ৩৭ বছরে আলাদা সেল গঠন করে লোকবল নিয়োগ, অর্গানোগ্রাম এবং পদ সৃজনের তালিকায় বিশেষজ্ঞ পদ যুক্ত না করায় ভেষজ শিল্প উন্নয়ন ধারায় বিকশিত হতে পারেনি। ভারত, চীন, কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরের সাথে তুলনা করে দেখা যায়, ভেষজ শিল্প স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে। ওষুধ নীতিমালা-১৯৮২’র আলোকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যৌথ উদ্যোগে অ্যালোপ্যাথিক, ইউনানী, আয়ুর্বেদিক ও হোমীও’র যে রুলস ১৯৯০ইং সালে প্রণয়ন করা হয়, তা একটি মহলের স্বার্থ রক্ষায় কোন কারন ছাড়াই ১৯৯০ইং সালে বাতিল করা হয়। এই সুযোগে অ্যালোপ্যাথিক কোম্পানী রাতারাতি ব্যবসায়ীক সফলতা অর্জন করলেও ইউনানী-আয়ুর্বেদিক-হারবাল শিল্পের উন্নয়ন ও বিকাশে বাধা হয়ে আছে। ৩৭ বছরে আলাদা সেল গঠন করে একজন পরিচালকের সমন্বয় ড্রাগ সুপার নিয়োগ দেয়া দুরে থাক, স্থায়ীভাবে একজন বিশেষজ্ঞ নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়নি। শিল্প মালিকদের অভিযোগ, বিশেষজ্ঞ নিয়োগে ১৯৮২’র ধারাকে পাশ কাটিয়ে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে ড্রাগ প্রশাসনের মতামতকে প্রধান্য দিয়ে পছন্দের কোনো ডাক্তারকে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ দিচ্ছে। ফলে, দক্ষতার বদলে অদক্ষদের নিয়োগ দেয়ায় স্বাস্থ্য সেবায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি এবং সেবার বদলে ওষুধ কোম্পানীকে হেনস্থা করে অর্থ উপার্জন করাই তাদের মূল টার্গেট। বর্তমানে যারা প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করছেন, তারা ফার্মাসিষ্ট হওয়ায় ইউনানী, আয়ুর্বেদিক ও হারবাল ঔষধের গুনাগুণ সম্পর্কে কোনো ধারনাই নেই।
সংশ্লিষ্ট ওষুধ শিল্প সমিতির অনেকেই বলছেন, ড্রাগ প্রশাসনের ক’জন কর্মকর্তার ভারত প্রীতি রয়েছে। তারা অজ্ঞাত কারণে নকল ও ভেজাল ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে ভারতীয় এজেন্ডা হয়ে কাজ করছেন। তাদেরই যোগসাজসে ‘আয়ুর্বেদ এন্ড ন্যাচারোপ্যাথি এসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ’ (আয়ুনস্) নামের একটি সংগঠন ভারতীয় এজেন্ডা হয়ে প্রচার ও প্রসারে সক্রিয় থাকায় এদেশীয় কিছু ওষুধ কোম্পানী ব্যবসায়ীক স্বার্থে ভারতীয় ডাবর, হিমালয়া, আয়ুর্বেদ, প্রজ্ঞা ও অর্গানিক কোম্পানির এজেন্ট হওয়ায় ভেষজ শিল্প ধংশের পাঁয়তারা চলছে। আর ভারতের আয়ুস’র অনুকরণে ইউনানী, আয়ুর্বেদীক ও হারবাল কোম্পানীর কারখানা আধুনিকরণের নামে ক’জন কর্মকর্তা ভারতীয় এজেন্ডা হয়ে আয়ুস’র আমন্ত্রণে কয়েকবার ভারত সফর করার পর ওষুধ কারখানা আধুনিকরণের নামে যে প্রক্রিয়া চালু করেছেন, তাতে আর্থিক স্বার্থই প্রধান্য পেয়েছে। অর্থলোভী কিছু কর্মকর্তাদের চাহিদা মিটিয়ে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে গিয়ে অনেকেই হিমশিম খেয়েছেন। ভেষজ শিল্পকে জিম্মী করে যারা আলিশান বাড়ি ও ফ্লাটের মালিক হয়েছেন, তারাই স্বার্থন্বেষী মহলের ব্যবসায়ীক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ইউনানী, আয়ুর্বেদিক ও হারবাল ওষুধ শিল্প নিয়ে কারসাজী করছেন।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ মতে, জুন-জুলাই মাসে দৈনিক সকালের সময়সহ বিভিন্ন দৈনিক ও ম্যাগাজিন পত্রিকায় নকল-ভেজাল কোম্পানীর বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশের আলোকে বর্তমান ডিজির উদ্যোগে অনেক কোম্পানির প্রোডাক্ট সংগ্রহ করে ড্রাগ টেষ্টিং ল্যাবরেটরীতে পাঠানো হলেও কোন কোম্পানির কোন কোন প্রোডাক্ট মানবর্হিভূত হয়েছে, তা এখানো প্রকাশ করা হয়নি। তবে, অভিযোগ ছাড়াই সন্দেহবশত যে সব কোম্পানির প্রোডাক্ট জব্দ করা হয়েছে, তা গণহারে মানবর্হিভূত বলে রিপোর্ট প্রদানের প্রক্রিয়া চলছে। ভুক্তভোগীদের প্রশ্ন, ডিজির সাহসী উদ্যোগ জনস্বার্থে হলেও তার নির্দেশে যারা প্রডাক্ট জব্দ করেছেন, তারা সঠিক বিষয়টি জেনেও অভিযুক্তদের সাথে ভুক্তভোগীদের কেন অভিযুক্ত করার চেষ্টা করছেন। তাদের মতে, ভিন্ন স্বার্থে যেন মানসম্মত কোনো কোম্পানীকে শাস্তি দেয়া না হয়। ওষুধ বিশেষজ্ঞদের অভিমত, আল সাফা ল্যাবরেটরীজ ইউনানী, ম্যাবকো ল্যাবরেটরীজ ইউনানী, ঢাকা ফার্মা ইউনানী, নাফিউ ফার্মাসিউটিকালস ইউনানী, জেবিএল ড্রাগ ইউনানী, বিডি ফার্মাসিউটিকালস ইউনানী, সানরাইজ ইউনানী ল্যাবরেটরীজ, সেইফকো ফার্মাসিউটিকালস ইউনানী, হামজা ল্যাবরেটরীজ ইউনানী, বি.এন ল্যাবরেটরীজ ইউনানী, ম্যানহার্ট ল্যাবরেটরীজ ইউনানী, বর্ণালী ফার্মাসিউটিকালস ইউনানী, সিকো ফার্মাসিউটিকালস ইউনানী, বি.পি.এইচ ল্যাবরেটরীজ ইউনানী, এমী ল্যাবরেটরীজ আয়ু, সানড্রাগ ল্যাবরেটরীজ আয়ু, ইন্ট্রা ফার্মাসিউটিকালস ইউনানী, মুসলিম ফার্মাসিউটিকালস ইউনানী, ঔষধি ল্যাবরেটরীজ আয়ু, সুরমা ল্যাবরেটরীজ ইউনানী, ফেম ফার্মাসিউটিকালস আয়ু, রয়েল ইউনানী ল্যাবরেটরীজ, একরাম ল্যাবরেটরীজ আয়ু, পেট্রন ল্যাবরেটরীজ ইউনানী, গ্রামো ফার্মাসিউটিকাল ইউনানী, জৈন ফার্মাসিউটিকাল আয়ু, কার্লো ফার্মা ইউনানী, কেয়া ড্রাগ ইন্ডাষ্ট্রিজ ইউনানী, এম.এম. ফার্মাসিউটিকাল আয়ু, বায়োনিড ফার্মা আয়ু, নিকন ল্যাবরেটরীজ ইউনানী, র‌্যাম ফার্মাসিউটিকাল ইউনানী, আর.কে ইউনানী ল্যাবরেটরীজ, প্রিভেন্টিজ বাংলাদেশ ইউনানী, ইনডেক্স ল্যাবরেটরীজ আয়ু, প্যারেন্ট ইউনানী ল্যাবরেটরীজ, রবিন ফার্মাসিউটিকাল আয়ু, ফাস্ট ফার্মাসিউটিকালস আয়ু, প্রাপ্তি ফার্মাসিউটিকালস আয়ু, নিকো আয়ুর্বেদিক ল্যাবরেটরীজ, বায়োমেডিক্স ফার্মাসিউটিকাল আয়ু, সেভিয়ার ল্যাবরেটরীজ ইউনানী, এস কে ল্যাবরেটরীজ আয়ু, কেয়ার ল্যাবরেটরীজ ইউনানী, কে.ইউ ফার্মাসিউটিকালস আয়ু, ডেলকো ফার্মা ইউনানী, রেপিটেক ফার্মাসিউটিকালস ইউনানী, এইড হেলথ ল্যাবরেটরীচ ইউনানী, গুড হেলথ ফার্মাসিউটিকালস ইউনানী, বি.জি ল্যাবরেটরীজ ইউনানী, ফেমাস ফার্মাসিউটিকালস ইউনানী, ইয়ুথ ল্যাবরেটরীজ ইউনানী, নেপলস ল্যাবরেটরীজ ইউনানী, ফিউচার ইউনানী, নবীন ল্যাবরেটরীজ ইউনানী, ভারটেক্স ফার্মাসিউটিকালস হোমিও, জেবক্স এন্ড হোমিও, ইউনিসন হোমিও, ইউনিক হোমিও ভেজাল ও ক্ষতিকারক ওষুধ বাজারজাত করেও এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। যদি ওষুধ পরীক্ষা করে মান যাচাই পূর্বক আইনী ব্যবস্থা নেয়া হয়, তাহলে এসব কোম্পানির ওষুধ সবার আগে পরীক্ষা করা উচিত। তাছাড়া ক’জন কর্মকর্তার যোগসাজসে বেনামী অভিযোগ দিয়ে একটি অসাধু চক্রের আর্থিক সুবিধা আদায়ের হয়রানি বন্ধ না হলে এবং ড্রাগের অনিয়ম ও দুর্নীতি চলমান থাকলে ভেষজ ওষুধ শিল্প ধ্বংস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সেক্ষেত্রে চলমান জটিলতা নিরসনে অভিযুক্ত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুদক সঠিক তদন্ত করলে সব কারসাজী বেরিয়ে আসবে।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *