এম এ স্বপন : এক সময়ে ঢাকার ফুলবাড়িয়া বাস টার্মিনালের হকার থেকে ধীরে ধীরে হয়ে উঠেন টার্মিনালের আতঙ্ক। যোগ দেন সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নে। প্রভাব খাটিয়ে হয়ে যান সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক। জড়িয়ে পড়েন খুন-অপহরণ, হামলা ও চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধে। তখনকার প্রভাবশালী এই নেতা বেপরোয়া চাঁদাবাজি, শ্রমিক নির্যাতন, মালিকদের হামলা-মামলাসহ একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে শ্রমিক ইউনিয়নের তহবিল হাতিয়ে নেন। এমন অভিযোগের ভিত্তিতে ইউনিয়ন থেকে বিতাড়িতও হন তিনি। যার কথা এতক্ষন বলা হলো তিনি আর কেউ নন ‘বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্যলীগ’ এর সদস্য সচিব ইসমাইল হোসেন বাচ্চু। এখন এই সংগঠনের নামেই বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি করে আসছেন। তার এসব কাজের প্রতিবাদ করায় আপন ভাতিজি জামাইকেও খুনের শিকার হতে হয়েছে। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা এমন অভিযোগ করেছেন। সূত্র :দৈনিক সকালের সময়কে।
পরিবহন সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, এক সময় বাচ্চু ফুলবাড়িয়া এলাকার হকার ছিলেন। সেখান থেকে গাড়ির হেলপার হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হন। এরপর নিজ এলাকার চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হয়েছেন। তার অপরাধমূলক কর্মকান্ডের কারণে ২০১৭ সালে শ্রমিকদের তোপের মুখে ফুলবাড়িয়া বাস টার্মিনাল থেকে বিতাড়িত হন। ফলে ‘অবৈধ” আয়ের উৎস হারান তিনি। পরে তার ক্যাডার বাহিনী দিয়ে টার্মিনাল দখলের চেষ্টাও করেন। বর্তমানে তিনি ‘বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্যলীগ’ নামে একটি সংগঠন করে এর সদস্য সচিব। সংগঠনটির প্রভাব খাটিয়ে পরিবহন খাতে চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধ করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইসমাইল হোসেন বাচ্চু কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম থানার আলকড়া ইউনিয়নের মৃত আশরাফ আলীর ছেলে। তিনি ২০১১ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ওই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। এ সুবাধে এলাকায়ও তার একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। তার এমন অপরাধের প্রতিবাদ করলেই তার ওপর সন্ত্রাসী বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে হামলা চালানো হতো। বাচ্চুর কোনও দল না থাকলেও পরিবহন নেতা সেজে এলাকার বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে চাঁদা দাবি করতেন। তার এমন চাঁদাবাজি থেকে রেহাই পায়নি আওয়ামী লীগ, যুবলীগ এমনকি আপন ভাতিজি জামাইও।
২০১৫ সালে শেষের দিকে বাচ্চু তার বড় ভাইয়ের মেয়ের জামাই ও আলকড়া ইউনিয়নের যুবলীগের সভাপতি ও বাস মালিক জামাল উদ্দিন ওরফে বাক্কা’র পাওয়া একটি উন্নয়ন কাজ থেকে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। চাঁদা না দেওয়ায় তার পাওয়া চৌদ্দগ্রাম থানাধীন বিজয় করা স্কুল অ্যান্ড কলেজের মেরামত কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই অভিযোগে বাক্কা বাদী হয়ে ওই বছরের ৩০ নভেম্বর কুমিল্লার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বাচ্চুর বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন। এতে ক্ষিপ্ত হন বাচ্চু। পরে বেশ কয়েকবার হামলাও করা হয় বাক্কার ওপর। এর একমাস পর ২০১৬ সালের ৮ জানুয়ারি রাতে প্রকাশ্যে গুলি করে বাক্কাকে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় ইসমাইল হোসেন বাচ্চুকে প্রধান আসামি করে বাক্কার বড় বোন ও বাচ্চুর ভাতিজি জোহরা আক্তার বাদী হয়ে ১০ জানুয়ারি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলাটি বর্তমানে বিচারাধীন রয়েছে।
বাক্কার কাছ থেকে চাঁদা চাওয়ার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় সাক্ষী হওয়ায় স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা সাজ্জাদ হোসেন শাকিলকেও (১৮) সন্ত্রাসী বাহিনী লাগিয়ে খুন করার অভিযোগ রয়েছে বাচ্চুর বিরুদ্ধে। শাকিল ওই মামলার ৯ নম্বর সাক্ষী। তিনি খুন হন ২০১৮ সালের ৮ অক্টোবর চৌদ্দগ্রাম থানার কচুয়া রাস্তার মাথায়। এই মামলায় বাচ্চু এক নম্বর আসামি হলেও পরবর্তীতে প্রভাবশালী একজন মন্ত্রীর তদবিরে তাকে মামলার চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেন বাক্কা হত্যা মামলার বাদী জোহরা আক্তার।
এ ব্যাপারে জোহরা আক্তার বলেন, আমার ভাই স্থানীয় যুবলীগের পাশাপাশি এলাকায় ঠিকাদারি কাজ করতো। তার একটা কাজ থেকে বাচ্চু ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। না দেওয়ায় তাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। এজন্য আমার ভাই খুন হওয়ার আগে আদালতে একটি মামলাও করেছিল। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে আমার ভাইকে প্রকাশ্যে হত্যা করে সে। ভাইয়ের মামলায় সাক্ষী হওয়ায় এক ছাত্রলীগ নেতাকেও হত্যা করা হয়। আমি জানি না বিচার পাবো কিনা। সে এখনও আমাদেরকে বিভিন্ন ভাবে হুমকি দিয়ে আসছে। আমি চাই আমার ভাই হত্যার বিচার হোক। জোহরা অভিযোগ করেন, সে (বাচ্চু) আরও বহু হত্যা মামলার আসামি।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির অভিযোগ, বাচ্চু এলাকায় চাঁদাবাজি ও নানা হত্যাকা- ঘটিয়ে এলাকা থেকে বিতাড়িত হয়ে ঢাকার ফুলবাড়িয়া বাস টার্মিনালে ফেরত এসে ফের শ্রমিক নেতা সাজেন। সেখান থেকে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় পরিবহন চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়েন। সর্বশেষ চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি রাতে শাহআলী থানাধীন চিড়িয়াখানা সড়কের তাবানি বেভারেজ লিমিডেট কোম্পানির গেটে দিশারী পরিবহনের ঢাকা মেট্রো-ব ১১-৯৮৬১ বাস থেকে তার ক্যাডার বাহিনী রিপন মোল্লাকে দিয়ে চাঁদা দাবি করেন। চাঁদা না দেওয়ায় তাদের ওপর হামলা করা হয়।
পরদিন ওই বাসটির চালকের সহযোগী মো. বাপ্পী হোসেন বাদী হয়ে শাহআলী থানায় রিপন মোল্লাসহ অজ্ঞাত ১০/১২ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন। তাতে তিনি অভিযোগ করেন, ঘটনার রাতে আসামিরা তার গাড়ি থেকে দৈনিক ১৫০ টাকা করে চাঁদা দাবি করেন। প্রতিদিন এই চাঁদা না দিলে সড়কে বাস চালাতে দেবে না বলেও হুমকি দেয়। এসময় তার কাছ থেকে মোবাইল ফোনসহ নগদ টাকা লুট করে নিয়ে যায়। মামলাটির তদন্ত করেন শাহআলী থানার এসআই মো. মতিউর রহমান।
মামলার চার্জশিটে তিনি উল্লেখ করেন, রিপন মোল্লার মোবাইল ফোনের সিডিআর পর্যালোচনা করে দেখা যায় তিনি ঘটনাস্থলে ছিলেন এবং ঘটনার পূর্বে ও পরে রিপন মোল্লার সঙ্গে বাচ্চু একাধিকবার মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করেন। ওই মামলায় বাচ্চু বেশ কয়েকদিন জেলও খাটেন।
এছাড়াও অভিযোগ পাওয়া গেছে, পরিবহন শ্রমিক নেতা সেজে সায়েদাবাদ টার্মিনালে আধিপত্য বিস্তার করার জন্য চলতি বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি সায়েদাবাদ এলাকায় হামলা চালায় বাচ্চুর ক্যাডার বাহিনী। এসময় চাঁদার জন্য সীমান্ত পরিবহনসহ বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। পরে সীমান্ত পরিবহনের মালিক মো. ফিরোজ ইসলাম লিটন বাদী হয়ে যাত্রাবাড়ী থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে হত্যা, চাঁদাবাজিসহ আরও বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে।
এছাড়াও ২০১২ সালে আলাউদ্দিন নামে কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম থানার আলকড়া ইউনিয়ন পরিষদের একজন মেম্বর প্রার্থী খুন হন। সেই মামলায়ও তার সম্পৃক্ততা আছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব অপরাধের দায়ে বাচ্চুকে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি থেকে বহিষ্কার করা হয়। গত ৩ অক্টোবর তার বিরুদ্ধে জাতীয় প্রেসক্লাবে একটি সংবাদ সম্মেলন করে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ ও ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। সংবাদ সম্মেলনেও এসব অভিযোগ করা হয়। এছাড়া জামাল উদ্দিন বাক্কা হত্যার বিচার চেয়ে বাচ্চুর বিরুদ্ধে নগরীর বিভিন্ন স্থানে পোস্টার ঝুলছে।
এসব বিষয়ে ইসমাইল হোসেন বাচ্চু জানান, আমি ২০১১ সালে আমার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলাম। ২০০৮ সালের আগে আমার এলাকার এমপি ছিলেন এক জামায়াত নেতা। এরপর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেখানে ১২টি হত্যাকা- ঘটে। হাইব্রিড আওয়ামী লীগার ও জামায়াতিরা আমাকে আসামি করে। জামাল হোসেন বাক্কা আমার ভাতিজা ও আপন ভাতিজি জামাই। সেও যুবলীগ করতো এটা সত্য। সেই মামলায়ও আমাকে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে আসামি করা হয়।
তিনি আরও বলেন, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর আমি পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত হই। কিন্তু ২০০১ সাল থেকে আমি আন্দোলন সংগ্রাম করে আসি। সড়ক পরিবহন নেতাদেরকে বলেছি পরিবহনে চাঁদার পরিমাণ কমাতে। কিন্তু তারা কমাননি। সে কারণেই আমার সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্ব। তারাই আমার বিরুদ্ধে এখন অপপ্রচার চালাচ্ছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি আমার বিরুদ্ধে বাসের হেলপার ড্রাইভার দিয়ে বিভিন্ন থানায় হাস্যকর মামলা করায় যা চলমান। এমনকি আমার ভাতিজা হত্যা মামলার বাদীকে তারিখে তারিখে প্রচুর অর্থ দিয়ে আমাকে ফাঁসাতে উঠে পরে লেগেছেন। প্রায় ১০লাখ পোস্টার ছাপিয়ে আমাকে অপমান অপদস্ত করছেন। বর্তমানে সরকার যখন ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু করেছে তখন আমি মুখ খুলেছি।
ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে আগে যখন পরিবহন নেতা ছিলেন তখন কেন এই বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলেননি, তখন কি পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজি ছিল না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তখন আমি তাদের বিরুদ্ধে ভয়ে মুখ খুলতে পারিনি। সে কারণে কথা বলিনি।
ফুলবাড়িয়া শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে তাকে বিতাড়ন করা হয়নি বরং তিনিই ২০১৭ সালে সেই পদ প্রত্যাখ্যান করে বেরিয়ে এসেছেন বলেও দাবি করেন ইসমাইল হোসেন বাচ্চু।