বিশেষ প্রতিবেদক : পেঁয়াজ নিয়ে রীতিমতো তুঘলকি কা- ঘটে গেছে বাংলাদেশে। সারা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দামে প্রায় ৩০০ টাকা কেজিতে পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে। এখনো প্রতি কেজি পেঁয়াজের মূল্য ২২০ টাকার বেশি, কোথাও কোথাও ২৫০ টাকা। পেঁয়াজের বাজারে এই অস্থিরতার জন্য অনেকেই বাণিজ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক ট্রল হয়েছে এই পেঁয়াজ নিয়ে। সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে বিমানে পেঁয়াজ আমদানি করেছে, এখনো করছে। তবুও কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। অবস্থাটা এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যেন কেউ শোনে না কারও কথা। যেখানে বিমানে পেঁয়াজ পরিবহন শুল্ক মওকুফ করা হয়েছে, আমদানি শুল্কও নেই। এরপরেও ৪০-৪২ টাকায় কেনা পেঁয়াজ দেশে এসে ২২০-২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে কেন— এর কোনো জবাব কারও কাছে নেই। যদিও বাণিজ্যমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে তাদের মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করার আহ্বান জানিয়েছেন। রীতিমতো এটিতে অসহায় আত্মসমর্পণ বলছেন বিশ্লেষকরা। একই সঙ্গে পদত্যাগই সমাধান নয় বলে জানিয়েছেন তিনি। পদত্যাগ করলে যদি পেঁয়াজের দাম কমত তবে তিনি তা-ই করতেন বলে জানিয়েছেন। এদিকে প্রতিদিনই বাজারে আসছে আমদানি করা পেঁয়াজ, একই সঙ্গে আসতে শুরু করেছে নতুন পেঁয়াজও (পাতাসহ)। একই সঙ্গে টিসিবির মাধ্যমে বিভিন্নস্থানে ট্র্যাকসেল অব্যাহত রয়েছে। এরপরেও পেঁয়াজের মূল্য কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। মঙ্গলবার খুচরা পর্যায়ে নতুন করে দাম না বাড়লেও পাইকারি পর্যায়ে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজে ১০ টাকা বেড়েছে। রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ২৩০-২৪০ টাকা, আমদানি করা পেঁয়াজ ১৩০-২২০ টাকা। এ ছাড়া পাইকারি পর্যায়ে বিক্রি হয়েছে ১২০-২৩০ টাকা। ঢাকার বাইরের চিত্রও প্রায় একই রকম বলে জানিয়েছেন আমাদের প্রতিনিধি ও সংবাদদাতারা। অন্যদিকে বৃহস্পতিবার তুরস্ক থেকে জাহাজে করে সিটি গ্রুপের ২ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন পেঁয়াজ চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছাবে। এই পেঁয়াজের পুরোটাই টিসিবির মাধ্যমে খোলাবাজারে ৪৫ টাকা কেজি ধরে বিক্রি করা হবে। এর আগে, গত মাসে তুরস্ক থেকে আকাশপথে দুই দফায় ২০ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি করে সিটি গ্রুপ। মঙ্গলবার দুপুরে সিটি গ্রুপের উপদেষ্টা অমিতাভ চক্রবর্তী বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, পেঁয়াজের চলমান সংকট মোকাবিলায় তুরস্ক থেকে সমুদ্র ও আকাশপথে ২ হাজার ৫২০ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি করেছে সিটি গ্রুপ। এর মধ্যে ২২ নভেম্বর তার্কিশ এয়ার লাইন্সযোগে সিটি গ্রুপের পেঁয়াজের প্রথম চালান ১০ মেট্রিক টন এবং নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে দ্বিতীয় চালানটি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছে। পরে তা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) কাছে হস্তান্তর করা হয়।
সিটি গ্রুপ পেঁয়াজ আমদানি করে না জানিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, চলমান পেঁয়াজের সংকট ও উচ্চমূল্য রোধে সরকার ও দেশের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে সিটি গ্রুপ। বর্তমানে ভোক্তাসাধারণের চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে সিটি গ্রুপ তুরস্ক থেকে আকাশ ও সমুদ্রপথে পেঁয়াজ আমদানি করেছে। সিটি গ্রুপ আমদানি মূল্যেই পেঁয়াজ সরকারের কাছে হস্তান্তর করছে। তিনি বলেন, দুই দফায় ১০ মেট্রিক টন করে ২০ মেট্রিক টন পেঁয়াজ প্লেনে করে আনা হয়েছে। পেঁয়াজের সবচেয়ে বড় চালানটি ২ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন আগামী ৫ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে পৌঁছাবে। আমদানি করা পেঁয়াজগুলো দ্রুত খালাস করে সরবরাহের যাবতীয় ব্যবস্থা ইতোমধ্যে শেষ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত আগস্ট থেকে ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত সাড়ে তিন মাসে দেশে ১ লাখ ৬৭ হাজার ৮০৬ দশমিক ৪৭ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে, যার আমদানি মূল্য ৬৫৯ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এদিকে গত ১৮ নভেম্বরের পরও দেশে দেশে প্রায় কয়েক হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে। পেঁয়াজের বাজারের অস্থিরতা বিষয়ে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান সাংবাদিকদের বলেন, পেঁয়াজ ইস্যুতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। কোনোভাবেই সরকার পণ্যটির দাম ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতায় আনতে পারেনি। বাজারে এখনো পণ্যটি আকাশচুম্বী দামে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া যেদিন ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করল, ঠিক সেদিন থেকে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে সব ধরনের পেঁয়াজের দাম বাড়িয়েছিল। সেসব ব্যবসায়ীকেও চিহ্নিত করা হয়নি। ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। তাই সরকারের উচিত, পণ্যটির সরবরাহ বাড়িয়ে দাম ভোক্তা সহনীয় করা। আর অসাধুদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা। সঙ্গে বাজার মনিটরিং জোরদার করা। শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বলেন, বিভিন্ন সেক্টরের ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে বাজারকে অশান্ত করে তুলছে। অধিক মুনাফা করার জন্য তারা জনগণকে জিম্মি করে ব্যবসা করতে চায়। তারা দেশকে অচল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে অধিক মুনাফা করছে। বড় বড় দেশে এ প্রবণতা নেই। কিন্তু আমাদের দেশে এগুলো এখনো বিদ্যমান। একধরনের অসাধু ব্যবসায়ী এটা করছে। এদিকে পেঁয়াজের দাম কমাতে রাজধানীর ৫০টি স্থানে সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) খোলা ট্রাকে ৪৫ টাকা কেজি দরে পণ্যটি বিক্রি করছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন অধিদপ্তর বাজার মনিটরিং অব্যাহত রেখেছে। একই সঙ্গে সোমবার থেকে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন অঞ্চলে টিসিবি নতুন করে ৪৫ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রি শুরু করেছে। তবে শেরপুর ও যশোরে টিসিবির পেঁয়াজের মান নিয়ে ক্ষোভ জানান ভোক্তারা। এ ছাড়া ফেনীতে টিসিবির বিরুদ্ধে পচা পেঁয়াজ বিক্রি করে প্রতারণা করার অভিযোগ উঠেছে।